ফুল থেকে টিস্যু কালচার পদ্ধতিতে দীর্ঘ পাঁচ বছরের গবেষণায় উন্নত জাতের পাঁচ ধরনের কলার চারা উদ্ভাবন করেছেন রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের (রাবি) প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন। তার উদ্ভাবিত নতুন জাতের এই কলা অধিক পুষ্টিগুণসম্পন্ন, উচ্চ ফলনশীল ও কম সময়ে ফলন দেয়ায় দেশব্যাপী চাষিদের মধ্যে এই কলার চারার চাহিদা বেড়েছে বহুগুণ। ইতোমধ্যেই দেশের ৬৪ জেলার কলা চাষিরা রাবির এই গবেষকের নিকট থেকে চারা নিয়ে কলার চাষ করে ব্যাপক লাভবানও হয়েছেন। গবেষকরা বলছেন, সাধারণ পদ্ধতির চেয়ে এই পদ্ধতিতে কলা চাষে ৩০-৪০% বেশী লাভ পাওয়া যায়। ফলে টিস্যু কালচার পদ্ধতিতে উন্নতমানের রপ্তানীযোগ্য ইউনিফরম কলা উৎপাদন করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব বলেও মনে করছেন তারা।
গত মঙ্গলবার (১ নভেম্বর) দুপুরে নিজ চেম্বারে গবেষক অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেনের দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘২০১৭ সালে টিস্যু কালচারের মাধ্যমে কলার চারা উদ্ভাবনের জন্য একটি প্রকল্প হাতে নিই। গবেষণা কাজে ব্যয়ের জন্য বিশ^বিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ও রাবি প্রশাসন আমাদেরকে ৪ লাখ টাকা প্রদান করেন। আমরা কলার স্যুট টিপ বা ফুলের টিস্যু নিয়ে প্রথমে জীবাণুমুক্ত করি। পরে ল্যামিনার ফ্লো-র ভিতর নিয়ে টিস্যুকে কাচের পাত্রে নির্দিষ্ট তাপমাত্রা ও নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে উদ্ভিদের বিভিন্ন রকমের হরমোন ও প্রয়োজনীয় কৃত্রিম খাবার ব্যবহার করে ৫-৬ মাস ধরে মাইক্রোস্যুট তৈরী করা হয়। পরবর্তীতে এই মাইক্রোস্যুটগুলোতে হরমোন ব্যবহার করে শিকড় তৈরী করা হয়। এরপর ল্যাব থেকে বের করে পলি হাউজের ভিতর সিডলিং ট্রে-তে কোকোপিট ভরে তার উপর বসানো হয়। এর এক মাস পরে চারাগুলোকে মাটির পলিব্যাগে স্থানান্তর করা হয়। পলি হাউজের ভিতওে মাটির ব্যাগের চারাগুলোকে ২-৩ মাস ধরে বিশেষ পদ্ধতিতে বাইরের আবহাওয়ার সাথে খাপ খাওয়ানো হয়। এক পর্যায়ে মাঠে রোপনের উপযুক্ত হলে আমার সেগুলো চাষিদের নিকট হস্তান্তর করি। মোটকথা, ইন-ভিট্রো মাইক্রোপ্রোপাগেশন পদ্ধতিতে আমরা বিভিন্ন জাতের কলার টিস্যু কালচার চারা উৎপাদনে সাফল্য অর্জন করেছি।
তিনি বলেন, ‘গবেষণার ফল বিশ্লেষণ করে যেটি পেয়েছি- টিস্যু চারা লাগালে সনাতন পদ্ধতির চেয়ে কলার ফলন বেশী হওয়ায় ৩০-৪০% লাভ বেশী হয়। এছাড়া টিস্যু কালচার চারা লাগালে সনাতন পদ্ধতির চেয়ে ২-৩ মাস আগে কলা সংগ্রহ করা যায়। এতে করে টিস্যু, চারা লাগালে কলা চাষীরা কম সময়ে অধিক লাভবান হয়।’
টিস্যু কালচারের মাধ্যমে উদ্ভাবনী এই কলার চারা কীভাবে দেশের কৃষি উন্নয়নে অবদান রাখবেÑ এমন প্রশ্নের জবাবে এই গবেষক বলেন, ‘বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন গ্রীষ্ম ও উপ-গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশে কলার চাষ করা হয়। উৎপাদনের দিক থেকে খাদ্য শস্যের মধ্যে বিশ্বে কলার অবস্থান চতুর্থ। দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোসহ ভারত ও ফিলিপিন শীতপ্রধান দেশগুলোতে কলা রপ্তানী করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। আমাদের দেশের কলাতে বিভিন্ন ধরনের রোগ-ব্যাধির সমস্যা থাকায় বিদেশে রপ্তানীর জন্য শর্তসমূহ পূরণ করতে পারে না। এর মধ্যে রয়েছে- কলা ফেটে যাওয়া, কলার গায়ে কালো দাগ পড়া, কলার ইউনিফরমিটি না থাকা, কলা এক ব্যাসের না হওয়ায় একসাথে না পাকা, কলাতে মাত্রারিক্ত কীটনাশকের উপস্থিতি ইত্যাদি। বাংলাদেশের কৃষকেরা সনাতন পদ্ধতিতে কলার চাষ করায় বিদেশে রপ্তানীযোগ্য কলা উৎপাদন করতে পারে না। আমাদের উদ্ভাবিত টিস্যু কালচার কলার চারা আধুনিক পদ্ধতিতে উৎপাদিত হয়। এছাড়া এই চারা সাড়া বছরই পাওয়া যায়। ফলে বছরের যে কোন সময় কলার চারা রোপণ করা যায়। তবে সনাতন পদ্ধতিতে শুধু বছরে দুই বার কলার চারা রোপন করা হয়। এই কারণে বছরের সব মাসে ভালো মানের কলা পাওয়া যায় না। এই সমস্যা নিরসনে আমাদের এই গবেষণা।’ রাবির এই গবেষক আরও বলেন, ‘এই কলার চারা ল্যাবরেটরীতে তৈরী বলে টিস্যু কালচার কলার চারা ১০০% রোগ বা জীবাণু মুক্ত হয়। ফলে কীটনাশক কম ব্যবহার করতে হয়। এটি লাগালে সময় ও জাতভেদে ৫-৭ মাসের মধ্যেই কলার মোচা বের হয় এবং ৯-১১ মাসের মধ্যে কলা কলা সংগ্রহ করা যায়। সাধরণত তেউরের চেয়ে ৩ মাস আগে ফলন পাওয়া যায়।
রাবির এই অধ্যাপক বলেন, ‘আমাদের মূল লক্ষ্য হলো- অল্প খরচে দেশের ৬৪ জেলার ১৮ কোটি মানুষকে স্বল্প মূল্যে অধিক পুষ্টিগুণ সম্পন্ন নির্ভেজাল কলা খাওয়ানো। পাশাপাশি টিস্যু কালচারের মাধ্যমে উৎপাদিত চারা সারাদেশে ব্যাপকহারে চাষাবাদের জন্য চাষিদের উদ্বুদ্ধ করা। এজন্য গত ২ বছর পুরো দেশের কৃষকদের মাঝে পাঁচ জাতের চারা মূল্যে-বিনামূল্যে বিতরণ করেছি। এই সময়ের মধ্যে কৃষকদের কাছ থেকে অভাবনীয় সাড়া পেয়েছি। ৬৪ জেলার শত শত কৃষক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর পেয়ে এই চারা নিয়ে গিয়ে তারা চাষাবাদ করছে। তবে বেসরকারি উদ্যোগে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে টিস্যু কালচার ল্যাব স্থাপনের মাধ্যমে এই চারা উৎপাদন করা গেলে দেশের চাষিদের চাহিদা পূরণ সম্ভব। টিস্যু কালচার চারা তৈরীর পদ্ধতিসমূহ এখন পর্যন্তও প্যাটেন্ট করা হয়নি। তাই কোন কোম্পানি চাইলে টিস্যু চারা তৈরীর টেকনোলজি ট্রান্সফার করে দিবো। এতে উদ্ভাবিত টিস্যু কালচার চারা তৈরীর পদ্ধতিসমূহ জীবাণুমুক্ত টিস্যু চারা উৎপাদন তথা ভবিষ্যৎ কলার উন্নয়নে ব্যাপক সহায়তার পাশাপাশি কলার উৎপাদন অতি দ্রুত বাড়বে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের গবেষণার ফলাফলে যেটি পেয়েছি তা হলোÑ টিস্যু কালচারের মাধ্যমে উৎপাদিত কলার চারা দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। পাশাপাশি বর্তমান সরকার টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। সেই সাথে এই মাধ্যমে কলা চাষ করে উন্নতজাতের উৎপাদিত এই কলা বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।’
জানতে চাইলে প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. তানজিমা ইয়াসমিন বলেন, ‘নতুন উদ্ভাবিত এই কলার চারা রোপনের মাধ্যমে আমরা শুধু উন্নত জাতের কলাই পাচ্ছি না; সাধারণ কলার চেয়ে অনেক বেশি পুষ্টিগুণসম্পন্ন কলা পুরো দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে।’
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোজদার হোসেন বলেন, ‘টিস্যু কালচারের মাধ্যমে রাবির গবেষকদের উদ্ভাবিত উন্নতজাতের কলার চারা ইতোমধ্যেই সারাদেশে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে বলে জানতে পেরেছি। রাজশাহীতেও বিভিন্ন স্থানে রাবি থেকে চারা সংগ্রহ করে এসব কলার চাষ করা হচ্ছে। এই কলার প্রধান বৈশিষ্ট হলো- কলার মোচা থেকে এগুলো একসাথে বের হওয়ায় এটি উচ্চ ফলনশীল ও স্বাভাবিকের চেয়ে পরিপক্ব হতে সময় কম লাগে। উৎপাদনও সারাবছরই করা যায়। সারাদেশে টিস্যু কালচারের মাধ্যমে উৎপাদিত চারা সরবরাহ করা সম্ভব হলে কলাচাষে সারাদেশে বিপ্লব ঘটে যাবে। সেই সাথে চাষকৃত উন্নত জাতের এসব কলা বহির্বিশ্বে রপ্তানির মাধ্যমে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব।’