২৮ এপ্রিল ২০২৪, রবিবার, ০৪:২৭:৪১ পূর্বাহ্ন
হামাসের অতর্কিত হামলায় উলট-পালট মধ্যপ্রাচ্যের কূটনীতি
  • আপডেট করা হয়েছে : ১২-১০-২০২৩
হামাসের অতর্কিত হামলায় উলট-পালট মধ্যপ্রাচ্যের কূটনীতি

মধ্যপ্রাচ্য তুলনামূলক শান্ত বলে গত সপ্তাহের শেষ পর্যন্ত স্বস্তিতেই ছিল জো বাইডেনের প্রশাসন। এই অঞ্চলকে ঘিরে নিজের দ্বিমুখী কৌশল নীরবে বাস্তবায়ন করে যাচ্ছিল যুক্তরাষ্ট্র। এই কৌশল হলো একদিকে ইসরায়েল ও সৌদি আরবের সম্পর্ক স্বাভাবিক করায় মধ্যস্থতা করা, অন্যদিকে ইরানের পারমাণবিক উচ্চাভিলাষকে আটকে রাখা।


গত শনিবার ইসরায়েলের ভেতরে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশ্রস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের অতর্কিত ও নজিরবিহীন হামলা যুক্তরাষ্ট্রের সেই আশাকে ধূলিসাৎ করে দিয়েছে। রকেট হামলার পাশাপাশি হামাস যোদ্ধারা গেরিলা কায়দায় চারদিক থেকে ইসরায়েলের শহরগুলোতে ঢুকে তাণ্ডব চালিয়েছে। তাদের হামলায় শত শত মানুষ নিহত হয়েছে এবং অনেককে অপহরণ করা হয়।


প্রতিশোধ হিসেবে ইসরায়েল গাজার উপকূলীয় ছিটমহল গুঁড়িয়ে দিচ্ছে; শত শত ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। পুরো গাজাকে অবরুদ্ধ করে পানি, বিদ্যুৎ, খাবারসহ জরুরি পরিষেবা বন্ধ করে দিয়েছে। সেখানে মুহুর্মুহু বিমান হামলা চালাচ্ছে ইসরাইলি বাহিনী। এখন নতুন করে স্থলপথে হামলার পরিকল্পনা করছে।


ইসরায়েলি-ফিলিস্তিনিদের কঠিন সংঘাতকে কিছুটা দূরেই সরিয়ে রেখেছিলেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন। কিন্তু এখন হঠাৎ করেই এমন এক সংকটের মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করলেন, যেটা তার মধ্যপ্রাচ্য নীতি নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে। পাশাপাশি কট্টর ডানপন্থী ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে অস্বস্তিকর জোট গঠনের পথে ঠেলে দিচ্ছে।


গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত ফিলিস্তিনির সংখ্যা ছাড়াল ১২০০ গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত ফিলিস্তিনির সংখ্যা ছাড়াল ১২০০ 

এর ফলে ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে এক ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতির মুখে পড়লেন বাইডেন। কারণ, এই সংঘাতে একদিকে যেমন তেলের বাজার অস্থিতিশীল হতে পারে। আবার রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকেন্দ্রিক পররাষ্ট্রনীতিতে আটকে থাকা যুক্তরাষ্ট্রকে এখন সম্পদ ও মনোযোগ অন্যদিকে সরাতে হবে।


হামাসের অতর্কিত হামলা বাইডেনের মধ্যস্থতায় ইসরায়েল ও সৌদি আরবের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের যুগান্তকারী চুক্তির প্রচেষ্টাকে বড় ধাক্কা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে ‘সন্ত্রাসী গোষ্ঠী’ হিসেবে তালিকাভুক্ত হলেও হামাসের দীর্ঘকালের হিতৈষী ইরান। আর তাই ইরানের প্রতি ওয়াশিংটনের দৃষ্টিভঙ্গি আরও বৈরী হয়ে উঠছে।


যদিও মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, দীর্ঘদিনের শত্রু ইসরায়েল ও সৌদি আরবের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনে তাদের প্রচেষ্টা সংকট কাটিয়ে উঠবে বলে তারা আশা করছেন। তবে অনেক বিশেষজ্ঞই সে ক্ষেত্রে হতাশা ছাড়া আর কিছু দেখছেন না।


ওয়াশিংটনভিত্তিক সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের মধ্যপ্রাচ্য-বিষয়ক প্রোগ্রামের প্রধান জন অল্টারম্যানের কথায় হতাশার সেই সুর স্পষ্ট। যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি ভাষ্যের বিপরীতে তিনি গিয়ে তিনি বলেন, ‘স্বাভাবিকীকরণের সমস্ত প্রচেষ্টা যে অদূর ভবিষ্যতের জন্য আটকে গেল, তা খুব সহজেই বলা যায়।’


এই অঞ্চলে ওয়াশিংটনের সবচেয়ে শক্তিশালী দুই মিত্র দেশের মধ্যে সম্পর্ক গড়ার বাইডেনের এই প্রচেষ্টাকে তেহরানের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ার পাশাপাশি তেলসমৃদ্ধ উপসাগরে চীনের প্রবেশ মোকাবিলার কৌশল হিসেবে দেখছিল মার্কিন প্রশাসন।


গাজা যেন মৃত্যুপুরী, অন্ধকারের আতঙ্কে লাখ লাখ মানুষগাজা যেন মৃত্যুপুরী, অন্ধকারের আতঙ্কে লাখ লাখ মানুষ

হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র জন কিরবি সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেন, সম্পর্ক স্বাভাবিক করার আলোচনা স্থগিত করা হয়েছে বা পিছিয়ে গেছে— এমন কড়া কথা তিনি বলতে চান না। তবে আপাতত ইসরায়েলকে ‘আত্মরক্ষায়’ সহায়তা দিতে পুরো মনোযোগ নিবদ্ধ রাখবে ওয়াশিংটন।


মধ্যপ্রাচ্যে সাবেক মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তা জোনাথন প্যানিকফ বলছেন, নতুন এই যুদ্ধের পরে আরবের পথ স্বাভাবিকীকরণের গন্তব্যে যাবে না। কারণ, এরই মধ্যে ইসরায়েলি হামলা গাজার বেশি রভাগ অঞ্চল মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে।’


সৌদি আরব সংশ্লিষ্ট এক সূত্র একই সূরে গলা মিলিয়ে বলছে, আরেকটি আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের কথা বলা বোধ হয় কঠিন হবে।


তবে ইসরায়েল-সৌদি আরব নিয়ে বাইডেন প্রশাসনের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ব্যাপক সমালোচনা কুড়িয়েছে। অনেকেই এই প্রচেষ্টাকে ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিকে চাপিয়ে রাখা হিসেবে দেখছেন। ‘ফিলিস্তিনিদের উপেক্ষা করে’ যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক স্বাভাবিককরণের প্রচেষ্টায় নেতৃত্ব দিচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন ফিলিস্তিনের সাবেক উপদেষ্টা খালেদ এলজিন্দি।


মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটে কর্মরত এই কূটনীতিক বলেন, ‘এখন আমরা যা যা দেখছি, তা কেন দেখছি বুঝতে হলে এই যে অবহেলা তাকে বিবেচনায় না নেওয়ার বিকল্প নেই।’


ফিলিস্তিনি কর্মকর্তা ও আঞ্চলিক সূত্রগুলোর মতে, ফিলিস্তিনিদের উপেক্ষা করে ইসরাইলকে নিরাপত্তা দেওয়া মেনে নিচ্ছে না হামাস। কারণ, তাহলে সৌদি আরবের সঙ্গে ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক যত দূর এগিয়েছে, তা বাধাগ্রস্ত হবে।


শেয়ার করুন