২৮ এপ্রিল ২০২৪, রবিবার, ০২:০৫:৩১ পূর্বাহ্ন
জমি-ফ্ল্যাট নিবন্ধন: ছাড়ের কথা বলে শুভংকরের ফাঁকি
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৭-১০-২০২৩
জমি-ফ্ল্যাট নিবন্ধন: ছাড়ের কথা বলে শুভংকরের ফাঁকি

পুনর্নির্ধারিত আয়কর আইনে ঢাকাসহ সারা দেশে জমির নিবন্ধন আরও কমেছে। এলাকাভিত্তিক করের বদলে মৌজাভিত্তিক কর ধার্য ও জমিকে পাঁচ শ্রেণিতে বিভক্ত করার সিদ্ধান্তও নিবন্ধন বাড়াতে পারছে না। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নতুন সিদ্ধান্তে কর কমেছে মনে হলেও বাস্তবে অধিকাংশ জমির নিবন্ধন কর বেড়েছে।


জমি-ফ্ল্যাটের নিবন্ধন কমে যাওয়ায় এ খাত থেকে সরকারের রাজস্ব আয়ও কমেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা আজকের পত্রিকাকে বলেন, জমি-ফ্ল্যাটের নিবন্ধন কমার কারণ খতিয়ে দেখতে হবে। উচ্চ মূল্যস্ফীতিও নিবন্ধন কমার একটি কারণ হতে পারে।


জাতীয় সংসদে গত ২০ জুন নতুন আয়কর আইন পাসের পর জমি ও ফ্ল্যাটের উৎসে কর দ্বিগুণ হয়ে যায়। ধস নামে জমি-ফ্ল্যাট নিবন্ধনে। এ খাতে রাজস্ব আয়ে ভাটা এবং সমালোচনা ও বিতর্কের মুখে ৩ অক্টোবর নিবন্ধন কর পুনর্নির্ধারণ করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। আগে সব ধরনের জমি নিবন্ধনে একই করহার ছিল। পুনর্নির্ধারিত হারে মৌজার অবস্থান অনুযায়ী জমিকে পাঁচ শ্রেণিতে বিভক্ত করে কর ধার্য করা হয়েছে। এনবিআরের দাবি, এতে স্থানভেদে কাঠাপ্রতি সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত কর কমেছে। তবে জমি বেচাকেনায় সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা বলছেন, এটি সূক্ষ্ম শুভংকরের ফাঁকি। এক-দুটি শ্রেণিতে কর কমলেও বাকিগুলোতে উল্টো বেড়েছে। উপজেলা পর্যায়ে নিবন্ধন খরচ বেশি বেড়েছে।


মতিঝিল, বাড্ডা, উত্তরা, ধানমন্ডিসহ রাজধানী ঢাকার ১০টি থানা এলাকার জমি-ফ্ল্যাটের দলিল নিবন্ধন হয় তেজগাঁওয়ের জেলা রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে। এই কার্যালয়ের তথ্য বলছে, জুনে নিবন্ধনে রাজস্ব আয় হয়েছিল ৭৭২ কোটি ৮৭ লাখ ১৮ হাজার ৮৭৫ টাকা। জুলাইয়ে তা কমে হয় ১৬৪ কোটি ৩৭ লাখ ১৮ হাজার ৩০৯ টাকা। অর্থাৎ আয় নেমে যায় প্রায় এক-পঞ্চমাংশে।


গত রোববার ওই কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, ক্রেতা-বিক্রেতাদের তেমন ভিড় নেই। বেশির ভাগ দলিল লেখক অলস সময় কাটাচ্ছেন।কয়েকজন দলিল লেখক বলেন, নতুন আয়কর আইন কার্যকরের পর নিবন্ধন অনেক কমে গেছে। আশা ছিল, এনবিআরের কর পুনর্নির্ধারণের কারণে দলিল করা বাড়বে। কিন্তু হলো উল্টো। পুনর্নির্ধারিত করহারে নিবন্ধন খরচ আরও বেড়েছে।


জমি নিবন্ধন খরচের খোঁজ নিতে ওই কার্যালয়ে আসা এক ব্যক্তি বলেন, তিনি উত্তরার বাউনিয়ায় একটি জমি কিনতে চান। সেপ্টেম্বরে দলিল লেখক জানিয়েছিলেন ওই জমি নিবন্ধনে ৪ লাখ ৬০ হাজার টাকা লাগবে। এখন বলছেন সাড়ে ৭ লাখ টাকা লাগবে। দলিল লেখক আব্দুর রশীদ বলেন, জমির নিবন্ধন কমে যাওয়ায় দলিল লেখকেরা অলস সময় পার করছেন।


এনবিআরের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, গুলশান, বনানী, মতিঝিল ও তেজগাঁও থানার ক শ্রেণির করহার দলিলে উল্লিখিত জমির মূল্যের ৮ শতাংশ বা কাঠাপ্রতি ১৫ লাখ টাকার মধ্যে যেটি বেশি সেটি প্রযোজ্য হবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব এলাকার ভূমির যে দাম তাতে ৮ শতাংশে ২২ থেকে ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত কর হবে। কাঠাপ্রতি ১৫ লাখ টাকার করহার এখানে প্রযোজ্য হবে না। ফলে পুনর্নির্ধারিত করহারে নিবন্ধন খরচ না কমে বরং বেড়েছে।


ফ্ল্যাট নিবন্ধনেও একই চিত্র। ফ্ল্যাট নিবন্ধনে বর্গফুটপ্রতি কর বাড়ার পাশাপাশি দলিলে উল্লিখিত ভূমি মূল্যের ওপর ৫ শতাংশ কর যোগ হয়েছে।


ঢাকার সাভার, আশুলিয়া ও ধামরাইয়ে সাবকবলা দলিলে উৎসে কর পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে জমির মোট মূল্যের ৬ শতাংশ বা কাঠাপ্রতি ৫০ হাজার টাকার মধ্যে যেটি বেশি। কেরানীগঞ্জ, নবাবগঞ্জ ও দোহারেও একই করহার। ৩ অক্টোবর পুনর্নির্ধারিত কর ধার্য করার পর সাভার সাবরেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে সাবকবলা দলিল হয়েছে মাত্র একটি। আগে এসব এলাকায় কাঠাপ্রতি কর ছিল না। গত জুলাইয়ে উৎসে কর জমির মূল্যের ৪ শতাংশ থেকে ৮ শতাংশ করা হয়। কাঠাপ্রতি ৫০ হাজার টাকা ধার্য করায় নিবন্ধন কর বেড়েছে প্রায় চার গুণ।


নারায়ণগঞ্জের জেলা রেজিস্ট্রি কার্যালয়ে রোববার তেমন ভিড় ছিল না। সাত দিন কর্মবিরতি শেষে দলিল লেখকেরা কাজ শুরু করলেও গ্রাহক নেই। হাতে গোনা যে কজন আসছেন, নিবন্ধন খরচ শুনে তাঁরাও দলিল না করে চলে যাচ্ছেন। দলিল লেখকেরা বলছেন, শতাংশের পাশাপাশি কাঠাপ্রতি কর নির্ধারণের কারণে নিবন্ধন খরচ বেড়েছে। জেলা দলিল লেখক সমিতির সভাপতি কলিম উল্লাহ আজকের পত্রিকাকে বলেন, সদর থানার আলীরটেকসহ কয়েকটি ইউনিয়নে এক কাঠা জমির দাম ১ লাখ টাকা। ৮ শতাংশ হিসাবে উৎসে কর আসত ৮ হাজার টাকা। কিন্তু কাঠাপ্রতি কর ধার্য করা হয়েছে ৮০ হাজার টাকা। অর্থাৎ এক কাঠা নিবন্ধনেই কর বেড়েছে ৭২ হাজার টাকা। নতুন প্রজ্ঞাপনের কারণে মানুষ জমি নিবন্ধন করছেন না।


কাঠাপ্রতি কর ধার্য করায় কর বৃদ্ধি পেয়েছে বলে মন্তব্য করেন নারায়ণগঞ্জের জেলা রেজিস্ট্রার খন্দকার জামীলুর রহমান। যশোরে চলতি মাসের প্রথম ১৫ দিনে দলিল নিবন্ধন হয়েছে মাত্র ৩৫০টি। যশোর সদর উপজেলা রেজিস্ট্রারের কার্যালয় সূত্র জানায়, আগস্টে সদর উপজেলায় ১ হাজার ৯৪০টি দলিল হয়েছে। সেপ্টেম্বরে হয়েছে ১ হাজার ৬০০টি।


কক্সবাজার সদর উপজেলা সাবরেজিস্ট্রার মো. রিয়াজুল ইসলাম বলেন, আয়কর আইন ও নতুন ভূমি আইনের কারণে জমি নিবন্ধন খরচ বেড়েছে। উপজেলা পর্যায়ে এর প্রভাব পড়েছে বেশি। খুলনা, চাঁদপুর, ঝিনাইদহ, ঠাকুরগাঁও, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ ও সাতক্ষীরায়ও কমেছে জমি নিবন্ধন। 


রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘সরকার সম্প্রতি নিবন্ধনের খরচ বাড়ানোর পর তা আবার কমানোর কথা বলছে। নিবন্ধনে করহার কত কমেছে, সেটা আমরা যাচাই করছি।’ তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের আগে মানুষের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাজ করছে, তাই হয়তো নিবন্ধন কম। আশা করি নির্বাচনের পর জমি ও ফ্ল্যাট নিবন্ধন বাড়বে।’ 


শেয়ার করুন