২১ নভেম্বর ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ০৮:৪২:১৭ অপরাহ্ন
পাকিস্তানের মারাত্মক ভুল থেকে বাংলাদেশের শিক্ষণীয়
  • আপডেট করা হয়েছে : ২১-১০-২০২৩
পাকিস্তানের মারাত্মক ভুল থেকে বাংলাদেশের শিক্ষণীয়

পাকিস্তানের  মারাত্মক ভুল ইসলামি জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোকে লালন-পালন করা। আফগানিস্তানের তালেবান বাহিনীকেও গড়ে তুলেছে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। 


পাকিস্তানের অর্থনীতি দেউলিয়া হওয়ার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে। পাকিস্তানের দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত বন্ধু চীন এবং সৌদি আরবও এখন আর তাদের দুরারোগ্য ভিক্ষাবৃত্তির ভার নিতে নারাজ। পাকিস্তানের বিদ্যুৎব্যবস্থা ভয়ানক লোডশেডিংসহ প্রায়ই গ্রিড-ফেইলিউরের শিকার হচ্ছে। পাকিস্তানি রুপিতে ডলারের দাম নাটকীয়ভাবে বেড়ে ১ ডলার এখন ২৯০ রুপিতে বিক্রি হচ্ছে।


পাকিস্তানি অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি সমস্যা এমন ভয়াবহ অবস্থায় পৌঁছে গেছে যে এখন এক কেজি আটার দাম ১৬০ ও এক কেজি চিনির দাম ৩০০ রুপির বেশি। পাকিস্তান যে ক্রমেই একটা ভিক্ষুকের জাতিতে পরিণত হচ্ছে, সেটার প্রধান কারণ সাড়ে পাঁচ লাখ সেনাবাহিনীসহ সাত লাখের একটি সশস্ত্র বাহিনীর বোঝা বহন করা তাদের পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। যদিও তারা তাদের আজন্ম শত্রু ভারতের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য এত বড় সৈন্যবাহিনী গড়ে তুলেছে। সশস্ত্র বাহিনী ক্ষমতায় থাকার অতীতের খেসারত এখনো তাদের দিতে হচ্ছে। কারণ বাংলাদেশের জন্মের আগেই এ রাষ্ট্রটির প্রকৃত শাসনক্ষমতা ১৯৪৮-৫৮ সাল পর্বে পর্দার আড়াল থেকে ১৯৫৮-৭১ সাল পর্বে সরাসরি সামরিক এস্টাবলিশমেন্টের করতলগত হয়ে গিয়েছিল।


বাংলাদেশ তাদের থেকে স্বাধীন হওয়ার পরেও ১৯৭১-২০২৩ সাল পর্বেও কিছুদিন পরপর সামরিক একনায়কেরা পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করেছেন। আবার যখন কিছুদিনের জন্য সামরিক বাহিনী সিভিলিয়ান শাসকদের কাছে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে, তখনো শাসনক্ষমতার প্রকৃত লাগাম নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে দিয়েছে। বর্তমানে ইমরান খান নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হয়েছিলেন তাদের প্রিয়পাত্র হিসেবে এবং তাদের মদদে। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই সেনাপ্রধান কমর বাজওয়ার সঙ্গে ক্ষমতার দ্বন্দ্বের জেরে ২০২২ সালে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করে শাহবাজ শরিফকে ক্ষমতায় বসানোর পেছনেও যে তারা কলকাঠি নেড়েছে, তা বুঝতে কারও অসুবিধে হয়নি।


১৯৪৮ সাল থেকেই পাকিস্তান সরকারের বাজেটের প্রধান খাত হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রতিরক্ষা খাত, যেখান থেকে ৭৫ বছরেও ওই অবস্থানের কোনো রূপ পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু এই অসহনীয় বোঝা যে পাকিস্তানের অর্থনীতিকে ‘মেল্টডাউনের গিরিখাতে’ ধাবিত করছে, সেই সত্যটা বিশ্বের সামনে নগ্নভাবে উদ্ভাসিত হয়েছে। বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম জনসংখ্যা-অধ্যুষিত দেশ পাকিস্তানের জনসংখ্যা দ্রুতগতিতে বেড়ে এখন ২৩ কোটি অতিক্রম করেছে। যাদের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার জোগান দেওয়া এত বড় সশস্ত্র বাহিনীর খাই মেটানোর পর কোনোমতেই পাকিস্তানের কোনো শাসক দল বা জোটের জন্য সম্ভব হচ্ছে না।


দেশটির বার্ষিক রপ্তানি আয় এখনো ৩০ বিলিয়ন ডলারের নিচে রয়ে গেছে। অথচ আমদানি ব্যয় ৮০-৯০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যাচ্ছে প্রতিবছর। ফলে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ক্রমেই পিছিয়ে পড়ায় জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন সূচকের বিশ্ব র‍্যাঙ্কিংয়ে পাকিস্তানের অবস্থান প্রতিবছর নিচে নেমে যাচ্ছে। ২০২২ সালে বাংলাদেশ যেখানে এ ক্ষেত্রে ক্রমোন্নতির ধারায় ১২৯ নম্বর অবস্থানে উন্নীত হয়েছে, সেখানে পাকিস্তানের অবস্থান নেমে গেছে ১৪৭ নম্বরে। ১৯৪৭-৭১ সাল পর্বে তৎকালীন পূর্ব বাংলাকে অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ হিসেবে শোষণ, বঞ্চনা, সীমাহীন বৈষম্য ও লুণ্ঠনের অসহায় শিকারে পরিণত করেছিলেন পাকিস্তানের শাসকেরা, যার পরিণতিতে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু জিডিপি পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে ৭০ শতাংশ কম ছিল। অথচ ২০১৫ সালেই মাথাপিছু জিডিপির বিচারে বাংলাদেশ পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে। ২০২৩ সালে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের তুলনাটা দেখা যাক:


১.মাথাপিছু জিডিপিতে বাংলাদেশ পাকিস্তানের তুলনায় ৬৫ শতাংশ এগিয়ে গেছে।

২.বাংলাদেশের রপ্তানি আয় পাকিস্তানের দ্বিগুণের বেশি, ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা ৫৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে।

৩.বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০২৩ সালের অক্টোবরে আইএমএফের হিসাবপদ্ধতি মোতাবেক ২০ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ালেও, সেটা পাকিস্তানের ছয় গুণের বেশি।

৪.বাংলাদেশের জনগণের গড় আয়ু ৭৩ আর পাকিস্তানের ৬৬ বছর।

৫.বাংলাদেশের জনগণের সাক্ষরতার হার ৭৬ আর পাকিস্তানের ৫৯ শতাংশ।

৬.বাংলাদেশের মোট জিডিপি ৪৬৫ বিলিয়ন ডলার, আর পাকিস্তানের ৩৪৬। 

৭.বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ২, আর পাকিস্তানের ২ দশমিক ১ শতাংশ। ফলে পাকিস্তানের জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাড়ে ২৩ কোটিতে, আর বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ।

৮.বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ১১২ টাকায় ১ ডলার পাওয়া যায়, পাকিস্তানে ১ ডলার কিনতে ২৯০ রুপি লাগে। অথচ ২০০৭ সাল পর্যন্ত রুপির বৈদেশিক মান টাকার তুলনায় ৮ শতাংশ বেশি ছিল। 

৯.বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক ঋণ জিডিপির ২৮, অথচ পাকিস্তানে তা ৪৬ শতাংশ। 

১০.বাংলাদেশের নারীদের ৪১ শতাংশ বাড়ির আঙিনার বাইরে কর্মরত, পাকিস্তানে এই অনুপাত মাত্র ১৪ শতাংশ।

১১.বাংলাদেশের শিশুমৃত্যুর হার হাজারে ২১, আর পাকিস্তানের ৫৯।

১২.বাংলাদেশে শতভাগ জনগণ বিদ্যুৎ-সুবিধার আওতায় এসেছে, অথচ পাকিস্তানের ৭৩ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ পাচ্ছে।

ওপরের তথ্য-উপাত্তগুলো সাক্ষ্য দিচ্ছে, পাকিস্তান অর্থনৈতিক উন্নয়নের দৌড়ে আর কখনোই বাংলাদেশের নাগাল পাবে না। দুর্নীতি, পুঁজি লুণ্ঠন ও পুঁজি পাচারের মতো ক্ষতিকর কর্মকাণ্ডকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করলে বাংলাদেশের অর্থনীতি যে অতিদ্রুত উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হবে, সে-ব্যাপারে উন্নয়ন-চিন্তকেরা আশাবাদী। বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর আকার আড়াই লাখের মতো।


তবে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা অনেক রকম সুবিধা ভোগ করেন। ১৯৭৫ ও ১৯৮২ সালে সামরিক একনায়কেরা বাংলাদেশে ক্ষমতা জবরদখল করেছিলেন, ২০০৭-০৮ সালেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আড়ালে সামরিক বাহিনীই ক্ষমতাসীন ছিল। ওই সময় ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য নানা কারসাজিও চালিয়েছে সেনা এস্টাবলিশমেন্ট। সুযোগ পেলে আবারও হয়তো কোনো সামরিক একনায়ক রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করবেন; বিশেষত, ১৯৯১ সালের পর দুই বছর ছাড়া ৩০ বছর ধরে যে ভোটের রাজনীতি বাংলাদেশে চালু রয়েছে তা দুর্নীতি, পুঁজি লুণ্ঠন ও পুঁজি পাচারের মতো মূল সমস্যাগুলোকে সঠিকভাবে দমন করতে পারছে না। আর দুঃখজনকভাবে ২০১৮ সালে ভোটের গণতন্ত্রই লাইনচ্যুত হয়ে গেছে।


পাকিস্তানের আরেকটি মারাত্মক ভুল ইসলামি জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোকে লালনপালন করা। আফগানিস্তানের তালেবান বাহিনীকেও গড়ে তুলেছে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। বাংলাদেশের রাজনীতিতেও বিএনপি-জামায়াতের মদদগার হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে আইএসআই। ভারতের ‘সেভেন সিস্টার্স’ রাজ্যগুলোর বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে ট্রেনিং ও অস্ত্র সরবরাহ করে আইএসআই।


সেনাবাহিনী পুরো পাকিস্তান রাষ্ট্র এবং দেশটির অর্থনীতিকে অজগর সাপের মতো গিলে খাচ্ছে। ড. আয়েশা সিদ্দিকা তাঁর বিশ্বখ্যাত বই মিলিটারি ইনকে বলেছেন, ২০০৫ সালেই সামরিক অর্থনীতি পাকিস্তানের অর্থনীতির প্রধান শক্তিতে পরিণত হয়ে গেছে। খাসজমি বা হুকুমদখল করা গ্রামীণ বা শহুরে জমি ইজারা নেওয়ার ব্যাপারে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের নিরঙ্কুশ অগ্রাধিকারের কারণে পাকিস্তানের সর্বত্র এখন নব্য-ভূস্বামী শ্রেণি হিসেবে সামরিক অফিসাররা পাকিস্তানে অন্য সবাইকে টেক্কা দিচ্ছেন।


সারা পাকিস্তানে প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ একর জমি সামরিক বাহিনীর চাকরিরত কিংবা অবসরপ্রাপ্ত অফিসার ও কর্মচারীদের মালিকানায় চলে গেছে, যা বাংলাদেশের মোট কৃষিযোগ্য জমির অর্ধেকেরও বেশি। পাকিস্তানের যেকোনো বড় বা মাঝারি শহরে এখন সবচেয়ে বড় আবাসিক এলাকা হয়ে গেছে একাধিক ডিওএইচএস বা ‘ডিফেন্স অফিসার্স হাউজিং সোসাইটি’র আবাসিক এলাকা। ড. আয়েশা সিদ্দিকার অনুসিদ্ধান্ত, এই রাষ্ট্রটি অদূর ভবিষ্যতে সামরিক বাহিনীর দখলদারি এবং জঙ্গি-পৃষ্ঠপোষকতা থেকে মুক্তি পাবে না।


পাকিস্তানের এসব মারাত্মক ভুল থেকে বাংলাদেশের শিক্ষণীয় হলো, ভোটের রাজনীতিতে সংঘাত ও অচলাবস্থা সৃষ্টি করে যেন সেনাশাসনকে ডেকে আনা না হয়। ২০০৬-০৭ সালে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় ফিরে আসার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে যথেচ্ছ অপব্যবহার করেছেন। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজউদ্দিনকে ব্যবহার করে তিনি নিজের পছন্দমাফিক সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ নিয়োগের খবরটি আগেভাগে ফাঁস হয়ে যাওয়ায় জেনারেল মইন উ আহমেদ ক্ষমতা দখল করে পছন্দমতো তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করেছিলেন। ২০০৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচন সামরিক-বাহিনী-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আয়োজনে হয়েছিল। আর সেই নির্বাচনে ব্যাপকভাবে পরাজিত হয়েছিল বিএনপি।


২০১৮ সালে নির্বাচনের আগের রাতে প্রশাসন ও পুলিশের অংশগ্রহণে ব্যালট বাক্স ভরিয়ে ফেলে পুরো নির্বাচন-প্রক্রিয়াকেই লাইনচ্যুত করে ফেলেছে আওয়ামী লীগ।


২০২৪ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে আবারও হয়তো জালিয়াতি করার খায়েশ নিয়ে এগোতে চাইছে তারা। নির্বাচনের পূর্বাপর সংঘাতের ফলে আবার দেশে সামরিক শাসন ফিরে আসার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। তাই পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ কি শিক্ষা নেবে না? সিন্দবাদের দৈত্যকে ডেকে আনা হলে, ওটাকে ঘাড় থেকে নামানো যাবে কি?


শেয়ার করুন