২১ নভেম্বর ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ০৬:০১:০৬ অপরাহ্ন
কেন দাঁড়াতে পারছে না বাংলাদেশ
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৬-১০-২০২৩
কেন দাঁড়াতে পারছে না বাংলাদেশ

এই রেকর্ডটা বাংলাদেশ বাজিয়েছিল বিশ্বকাপ শুরুর আগে থেকে মুম্বাইয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচের আগপর্যন্ত—লক্ষ্য তাদের সেমিফাইনাল। ইংল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ডের কাছে হারের পর বলা হয়েছিল, বাকি ছয়টা ম্যাচের ছয়টাই তারা জিততে পারে। ভারতের কাছে হারের পর নিজেদের বাকি পাঁচটা ম্যাচই জেতার কথা শোনা গিয়েছিল। 


গত পরশু ওয়াংখেড়েতে প্রোটিয়াদের কাছেও বিধ্বস্ত হওয়ার পর সুর বদলেছে বাংলাদেশের। টানা চার হারের পর আগের মতো আর বলা যাচ্ছে না, ‘লক্ষ্য আমাদের সেমিফাইনাল’। গত পরশু অধিনায়ক সাকিব আল হাসান সুর বদলে বলেছেন, ‘যদি সেমিফাইনালে না উঠতে পারি, অন্তত পাঁচ-ছয়ে থেকে যেন শেষ করতে পারি। আশা করি ভালোভাবে ঘুরে দাঁড়াব আমরা।’ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ঐতিহাসিকভাবে তিনের চক্রে আটকা। ২০০৭ বিশ্বকাপ থেকে বাংলাদেশ নিয়মিত গড়ে তিনটি করে ম্যাচ জিতেছে। এই বিশ্বকাপের আগে বাংলাদেশের প্রধানতম লক্ষ্য ছিল সেই তিনের চক্র থেকে বেরিয়ে এসে সেমিফাইনালের স্বপ্ন উজ্জ্বল করা। 


ধারাবাহিক হতশ্রী পারফরম্যান্সের পর বাংলাদেশের সামনে সেমিফাইনালের স্বপ্ন ফিকে হয়ে যাওয়ায় তাদের নতুন লক্ষ্য, অন্তত টেবিলের মাঝামাঝি জায়গায় থেকে বিশ্বকাপটা শেষ করা। হাতে থাকা বাকি চারটা ম্যাচের তিনটি জিতলে বাংলাদেশের এই লক্ষ্যটা অন্তত পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা থাকছে। কিন্তু সেই তিন ম্যাচ বাংলাদেশ যে জিতবে, সেই স্বপ্ন দেখা কঠিন। দলের ভারী ‘থিংকট্যাংক’ সাকিব-মুশফিক-মাহমুদউল্লাহর মতো অভিজ্ঞ ক্রিকেটার আছেন, ভারতের মতো চেনা কন্ডিশনে তবু প্রত্যাশিত ফল পাচ্ছে না বাংলাদেশ। 


বাংলাদেশ দলের বাজে পারফরম্যান্সের বিশ্লেষণ করতে গিয়ে গতকাল সাবেক ভারতীয় ক্রিকেটার, বর্তমানে ধারাভাষ্যকার দীপ দাশগুপ্ত আজকের পত্রিকাকে বলছিলেন, ‘২০০৭ বিশ্বকাপ দিয়ে একঝাঁক প্রতিভাবান নতুন ক্রিকেটার পেয়েছিল বাংলাদেশ। সাকিব, মুশফিকুর, তামিম ইকবাল। মাহমুদউল্লাহও প্রায় একই সময়ের। এটা অনেকটা আত্মবিশ্বাসের ব্যাপার। নেদারল্যান্ডসের মতো দল, যারা নিয়মিত ক্রিকেট ম্যাচ খেলে না, বিশ্বকাপে তাদের শরীরী ভাষা আর বাংলাদেশের শরীরী ভাষা দেখুন। কোয়ালিটি নিয়ে দুটি দলের পার্থক্য করছি না। কিন্তু বিশ্বকাপের মতো মঞ্চে শরীরী ভাষা, চিন্তাধারা, নিজেদের প্রস্তুতি—একটা লেভেল তো অনেক দিন চলল। ২০০৭ সালে যা ছিল, সেখান থেকে ওপরে যায়নি বাংলাদেশ। ওই একটা জায়গায় আটকে আছে তারা।’ 


দীপ এখানে অল্পেই তুষ্ট হওয়ার রোগটি সামনে আনলেন, ‘আবেগ নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে আর অল্পে তুষ্ট হয়ে গেলে বাংলাদেশের আরেকটা লেভেলে যাওয়া কঠিন। দেশের মাঠে ওই অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের মতো দলকে ডেকে হারিয়ে খুশিতে ডগমগ হলে শান্তদের আরেকটি লেভেলে যাওয়া কঠিন। বিরাট কোহলিকে দেখুন, আরও নিখুঁত হতে বছরের পর বছর একই ক্ষুধা নিয়ে সে খেলে যাচ্ছে। এই ক্ষুধাটা বাংলাদেশ দলে বড় মিসিং।’ 


বিশ্বকাপে নিজেদের পারফরম্যান্সকে আরেকটি লেভেলে নিতে প্রথমেই দরকার ছিল একটা দল হয়ে খেলা। বিশ্বকাপের আগেই বাংলাদেশ দল আক্রান্ত হলো নানা ঘটনার ঘনঘটায়। টুর্নামেন্টের আগমুহূর্তে তামিম ইকবালের দলের বাইরে চলে যাওয়া। সেই ঘটনাকে ঘিরে তামিমের ভিডিও, সাকিবের বিস্ফোরক এক সাক্ষাৎকার—টুর্নামেন্টের আগেই বড় মাত্রায় ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠা দলকে একটা স্থিতিশীল পরিবেশ দিতে পারত ধারাবাহিক সাফল্য। ধর্মশালায় আফগানিস্তানের বিপক্ষে জয় দিয়ে শুরুর পরও ছন্দ ধরে রাখা যায়নি। 


বিশ্বকাপের আগে থেকেই বাংলাদেশকে ভোগাচ্ছে তাদের টপ অর্ডার। একটা দলের সেরা ব্যাটার, যাঁরা নিয়মিত লম্বা ইনিংস খেলার সামর্থ্য রাখেন—তাঁরাই যদি নিষ্প্রভ থাকেন, দলের বড় স্কোর পাওয়া কঠিন। বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের একবার ওপেনিং জুটি ফিফটি ছাড়িয়েছে, পুনেতে ভারতের বিপক্ষে লিটন দাসের সঙ্গে জুনিয়র তামিমের ৯৩ রান। লিটন দুই ম্যাচে ফিফটি পেয়েছেন, বাকি তিন ম্যাচে ব্যর্থ। জুনিয়র তামিম এক ম্যাচে ফিফটি করেছেন, বাকি চার ম্যাচে ব্যর্থ। আর এই টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় হতাশা নাজমুল হোসেন শান্ত আর তাওহীদ হৃদয়কে নিয়ে। দুজনই ধারাবাহিক ব্যর্থ হয়েছেন। যখন একটা দলের টপ অর্ডার নিয়মিত ব্যর্থ হয়, তাদের বড় স্কোর পাওয়া অবশ্যই কঠিন। ব্যাটিং অর্ডারেও স্বস্তি নেই। লিটন আর জুনিয়র তামিম বাদে কারও জন্য নির্দিষ্ট ব্যাটিং পজিশন নেই। মাহমুদউল্লাহকে আটে খেলতে হচ্ছে। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে একটু ওপরে অর্থাৎ ছয়ে নেমেই যিনি খেলেছেন ১১১ রানের দারুণ এক ইনিংস। 


ব্যাটিং-ব্যর্থতা এতটাই নিয়মিত, এই বিশ্বকাপে সবচেয়ে কম দলীয় সংগ্রহ বাংলাদেশের। শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তানের কথা বাদই দেওয়া গেল, নেদারল্যান্ডস পর্যন্ত ২৬০-এর ওপর রান করেছে এই বিশ্বকাপে। ব্যাটিং নিয়ে দুশ্চিন্তা আগেই ছিল, যে পেস বোলিংয়ের ওপর ভরসা করে এই বিশ্বকাপে আসা, তারাও হতাশ করেছে। প্রতিপক্ষ আগে ব্যাটিং পেলেই তাদের পিটিয়ে রান তুলছে ৩৫০-এর ওপরে। পেস বোলিং বিভাগের নেতা তাসকিন আহমেদ এখনো নিজের সেরাটা দিতে পারেননি, উল্টো চোটে পড়ে হাতছাড়া করেছেন দুটি ম্যাচ। 


অধিনায়ক সাকিব এখন পর্যন্ত সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ। চোটে পড়ে ভারত ম্যাচে খেলেননি। ছন্দে ফিরতে কাল সাকিব ঢাকায় ছুটে গেছেন তাঁর শৈশবের কোচ নাজমুল আবেদীন ফাহিমের কাছে। 


ফাহিম বাংলাদেশ দলের পারফরম্যান্স দেখছেন এভাবে—‘ব্যাটিং, বোলিং—কোনোটাই ভালো হচ্ছে না। তবে বাকি চার ম্যাচ থেকেও অনেক কিছু নেওয়ার আছে। যে ম্যাচে হারছি, হারারই কথা। সামনের এই চারটা ম্যাচ থেকে তিনটা জিততে পারলে আমাদের একটা ভালো বিশ্বকাপ হয়ে যাবে।’ 


সেই লক্ষ্যপূরণে গতকাল বিকেলে কলকাতায় এসেছে বাংলাদেশ। টুর্নামেন্টের মাঝপথে বাংলাদেশ দলের পারফরম্যান্স বিশ্লেষণ করতে কিংবা পারফরম্যান্স নিয়ে হতাশ না হওয়ার অনুরোধ ছিল সাকিবের। গত পাঁচ ম্যাচে করা ভুলগুলোর পুনরাবৃত্তি যেভাবে হচ্ছে, খুব বেশি আশাবাদী হওয়ারও তো কিছু থাকছে না এই বাংলাদেশ দল নিয়ে।


শেয়ার করুন