২৭ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ১০:৩১:৫৭ অপরাহ্ন
মন্দা শেয়ারবাজারে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে পচা শেয়ার
  • আপডেট করা হয়েছে : ০১-১১-২০২৩
মন্দা শেয়ারবাজারে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে পচা শেয়ার

মন্দা শেয়ারবাজারে দুর্বল কোম্পানির আধিপত্য চলছে। এসব কোম্পানির শেয়ারের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। ব্যবস্থা তো দূরের কথা, এসব কোম্পানির দাম বৃদ্ধিতে সহায়তা করছে বাজারের নীতিনির্ধারকরা। নতুন করে আবার দুর্বল কোম্পানি অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন এসব পচা শেয়ার দুর্গন্ধ ছড়িয়ে বাজারের স্বাভাবিক পরিবেশ নষ্ট করছে। ফলে ভালো বিনিয়োগকারীরা এখানে আসছে না। তাদের মতে, একটি চক্র পরিকল্পিতভাবে এসব কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়াচ্ছে। এর ফাঁদে পা দিচ্ছে এক শ্রেণির বিনিয়োগকারী। ফলে ওই চক্রটি বাজার থেকে বের হয়ে গেলে বিনিয়োগকারীরা পথে বসবে। অর্থনীতিবিদদের মতে, বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে এসব কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। কারা এসব কোম্পানির শেয়ার কিনছে, তা খতিয়ে দেখতে হবে। আর নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) বলছে তারা বিষয়টি খতিয়ে দেখছে।


জানতে চাইলে শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, দেশের শেয়ারবাজার এখন সুস্থ নেই। অস্বাভাবিক অবস্থায় চলছে। ফ্লোর প্রাইস দিয়ে স্বাভাবিক বাজার আটকে রাখা হয়েছে। এখন জুয়াড়িরা যেটার দাম বাড়ায় সেটিই বাড়ে। এক্ষেত্রে এসব কোম্পানি মার্জিন দেওয়া হয়। আরও অনেক বিষয় রয়েছে। কিন্তু বাজার স্বাভাবিক থাকলে ভালো বিনিয়োগকারীরা আসত।


বাজারে অন্যতম দুর্বল কোম্পানি এমারেল্ড অয়েল। ২ এপ্রিল কোম্পানির শেয়ারের দাম ছিল ৩০ টাকা। ১২ জুলাই তা ১৭৮ টাকায় উন্নীত হয়। এখনো উচ্চ লেনদেন হচ্ছে। কিছু মূল্যসংবেদনশীল তথ্য ছড়িয়ে বাড়ানো হয় দাম। কিন্তু কোম্পানির ওয়েবসাইটে যেসব মূল্যসংবেদনশীল তথ্য ছড়ানো হয়েছে এর অধিকাংশ বাস্তবায়ন হয়নি। প্রতিষ্ঠানটি বেসিক ব্যাংকসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে ১শ কোটি টাকার উপরে ঋণখেলাপি। কিন্তু এরপরও বাড়ছে। সামগ্রিকভাবে যা পুরো বাজারের শৃঙ্খলা নষ্ট করছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার সহায়তায় কিছু গ্রুপ মিলে বাড়াচ্ছে দাম। বাজারে আরেক দুর্বল কোম্পানি ফুয়াং ফুড। ১১০ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধনের এ কোম্পানিতে উদ্যোক্তাদের শেয়ার মাত্র ৭ শতাংশ। কোম্পানির রিজার্ভ ৭৫ কোটি টাকা ঘাটতি। কিন্তু ব্যাপকভাবে উঠানামা করছে কোম্পানির শেয়ার। লেনদেনেও উঠে আসছে শীর্ষ তালিকায়। আরেক দুর্বল কোম্পানি বিচ হ্যাচারি। ৪১ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধনের বি ক্যাটাগরির কোম্পানিটির রিজার্ভ নেতিবাচক। বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দিতে পারে না। কিন্তু কোম্পানিটি ছোট মূলধনের হওয়ায় বাড়ছে শেয়ারের দাম। এক মাসে কোম্পানির শেয়ারের দাম ৪০ থেকে ৪৮ টাকায় উন্নীত হয়েছে। জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে কিছু দুর্বল মৌলভিত্তির কোম্পানির শেয়ারের দাম বেড়েছে। তিনি বলেন, কোম্পানির শেয়ারের দাম, তাদের মৌলভিত্তির সঙ্গে সঙ্গতি পূর্ণ না হলে বুঝতে হবে, এখানে কোনো কারসাজি আছে। মির্জ্জা আজিজ বলেন, শেয়ারের দাম বৃদ্ধির বিষয়টি তদন্ত করে বিএসইসিকে ব্যবস্থা নিতে হবে।


অন্যতম পচা কোম্পানি সিএনএ টেক্সটাইল। কোম্পানিতে রিজার্ভ ৩২৫ কোটি টাকা ঘাটতি। বিভিন্ন ব্যাংকের ঋণ রয়েছে ২২৫ কোটি টাকা। এর অধিকাংশই খেলাপি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বলপ্রয়োগ করে কোম্পানিকে জেড ক্যাটাগরি থেকে বি ক্যাটাগরিতে আনতে বাধ্য করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটি অংশ এই কোম্পানির শেয়ার কিনেছে। এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে বিএসইসি কয়েকজন কর্মকর্তা। এছাড়াও যে সব ছোট মূলধনী এবং দুর্বল মৌলভিত্তির বেশ কিছু কোম্পানির শেয়ারের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে এরমধ্যে রয়েছে-সোনালী আঁশ, জেমিনি সি ফুড, দেশবন্ধু পলিমার, রহিমা ফুড, আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজ, খান ব্রাদার পিপি ওভেন, সোনালী পেপার, সীপার্ল রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা, আরডি ফুড, লিগ্যাসি ফুটওয়্যার এবং ইয়াকিন পলিমার অন্যতম। এরমধ্যে কোনো কোনো কোম্পানির এক বছরে ১৫ গুণ পর্যন্ত বেড়েছে। যা একেবারেই অস্বাভাবিক। এসব কোম্পানির অধিকাংশই লোকসানি। দীর্ঘদিন পর্যন্ত এরা বিনিয়োগকারীদের কোনো লভ্যাংশ দিতে পারছে না। এরপরও বাড়ছে এসব কোম্পানির শেয়ারের দাম। বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন এসব কোম্পানির কারণে ক্রমেই ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে শেয়ারবাজার। অর্থাৎ পচা শেয়ার দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। সূত্র বলছে, বড় কয়েকটি ব্রোকারেজ হাউজ, কোম্পানির উদ্যোক্তা, কয়েকজন বড় বিনিয়োগকারী এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থা মিলে এসব কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়াচ্ছে। এরা কোনো কিছুর তোয়াক্কা করছে না।


জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিম মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন-বর্তমানে বাজারে কিছুটা আস্থা সংকট রয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক এবং বড় বিনিয়োগকারীরা ওইভাবে বাজারে বিনিয়োগ করছে না। তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। এতে বাজারে কিছুটা তারল্য সংকট রয়েছে। এই সুযোগে ছোট মূলধনের কিছু কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়ছে। তিনি বলেন, কমিশন এগুলো খতিয়ে দেখছে। ইতোমধ্যে কিছু অনুসন্ধান চলমান। আরও কিছু প্রক্রিয়াধীন। এসব কোম্পানিতে কোনো অনিয়ম পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সামগ্রিকভাবে আমরা আশা করছি নির্বাচনের পর বাজার ঘুঁরে দাড়াবে।


মঙ্গলবারের বাজারচিত্র : একক দিন হিসাবে ডিএসইতে মঙ্গলবার ৩১৯টি কোম্পানির ১২ কোটি ৭৯ লাখ শেয়ার লেনদেন হয়েছে। যার মোট মূল্য ৫২২ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। এরমধ্যে দাম বেড়েছে ৮৩টি কোম্পানির শেয়ারের, কমেছে ৬২টি এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ১৭৪টি কোম্পানির শেয়ারের দাম। ডিএসইর ব্রড সূচক আগের দিনের চেয়ে ১ পয়েন্ট বেড়ে ৬ হাজার ২৭৮ পয়েন্টে উন্নীত হয়েছে। ডিএসই-৩০ মূল্যসূচক দশমিক ৯২ পয়েন্ট কমে ২ হাজার ১৩৩ পয়েন্টে নেমে এসেছে। ডিএসই শরীয়াহ সূচক দশমিক ৫৫ পয়েন্ট কমে ১ হাজার ৩৬২ পয়েন্টে নেমে এসেছে। ডিএসইর বাজারমূলধন আগের দিনের চেয়ে কিছুটা বেড়ে ৭ লাখ ৮৪ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে।


শীর্ষ দশ কোম্পানি : মঙ্গলবার ডিএসইতে যেসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ার বেশি লেনদেন হয়েছে সেগুলো হলো-ওরিয়ন ইনফিউশন, ফু-ওয়াং ফুড, সী পার্ল বিচ, শমরিতা হাসপাতাল, ইস্টার্ন হাউজিং, খান ব্রাদার্স পিপি, লাফার্জ হোলসিম বাংলাদেশ, এমারেল্ড অয়েল, জেমিনী সি ফুড এবং সেনা কল্যাণ ইন্স্যুরেন্স। অন্যদিকে যে সব প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম বেশি বেড়েছে সেগুলো হলো-মেঘনা সিমেন্ট, লিগ্যাসী ফুটওয়্যার, ক্যাপিটেক গ্রামীণ ব্যাংক গ্রোথ ফান্ড, সিএপিএম আইবিবিএল মিউচুয়াল ফান্ড, সেনা কল্যাণ ইন্স্যুরেন্স, রিলায়েন্স ইন্স্যুরেন্স, খান ব্রাদার্স পিপি, প্রাইম ফাইন্যান্স ফাস্ট মিউচুয়াল ফান্ড, ইস্টার্ন লুব্রিকেন্টস এবং প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্স। অন্যদিকে যে সব প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম বেশি কমেছে সেগুলো হলো-রূপালী ব্যাংক, ইউনাইটেড ইন্স্যুরেন্স, সোনালী আঁশ ইন্ডাস্ট্রিজ, অ্যাম্বী ফার্মা, সেন্ট্রাল ফার্মা, শ্যামপুর সুগার, ইস্টার্ন হাউজিং, ইস্টার্ন ইন্স্যুরেন্স, ইস্টল্যান্ড ইন্স্যুরেন্স ও ইয়াকিন পলিমার।


শেয়ার করুন