কারিগরি মূল্যায়নের সাত মাস পর অবশেষে উন্মুক্ত হলো বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) ফাইভ-জি রেডিনেস প্রকল্পের বাণিজ্যিক প্রস্তাব। এতে তিনটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রায় ৩২৬ কোটি টাকা প্রস্তাব করে সর্বনিম্ন দরদাতা হয়েছে চীনা প্রতিষ্ঠান হুয়াওয়ে। প্রাথমিকভাবে এ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৪৬৩ কোটি টাকা। ফলে হুয়াওয়ের প্রস্তাব গৃহীত হলে সরকারের অন্তত ১৩৭ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাণিজ্যিক প্রস্তাব পর্যালোচনায় দেখা যায়, কারিগরি কমিটির মূল্যায়নে যোগ্য বিবেচিত হওয়া তিন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে হুয়াওয়ে প্রায় ৩২৬ কোটি টাকা প্রস্তাব করেছে। এ ছাড়া জেডটিই ৪১৫ কোটি এবং নোকিয়া ৫৭৯ কোটি টাকা দর প্রস্তাব করেছে। হুয়াওয়ের তুলনায় জেডটিইর প্রস্তাব প্রায় ৮৯ কোটি এবং নোকিয়ার প্রস্তাব প্রায় ২৫৩ কোটি টাকা বেশি।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০২০ সালের ২০ সেপ্টেম্বর পরিকল্পনা কমিশনে অনুষ্ঠিত প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভার সিদ্ধান্ত ৪.৪ অনুযায়ী বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) কর্তৃক সম্ভাব্যতা সমীক্ষা সম্পাদন করা হয়। সরকারের প্রায় পৌনে ২৯ লাখ টাকা খরচ করা এই সমীক্ষা ২০২১ সালের এপ্রিলে জমা দেওয়া হয়। সমীক্ষা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে প্রকল্পের ডিপিপি প্রণয়ন করা হয়। পরিকল্পনা কমিশনের সুপারিশে ২০২২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি একনেক সভায় ডিপিপি প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়।
তবে পরে নানান জটিলতায় বিভিন্ন ধাপে এ প্রকল্প বাধাগ্রস্ত হয়। জানা যায়, বিটিসিএল কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন “৫জি’র উপযোগীকরণে বিটিসিএলের অপটিক্যাল ফাইবার কেবল ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক উন্নয়ন” শীর্ষক প্রকল্পের জিডি-১ প্যাকেজের কারিগরি মূল্যায়ন প্রতিবেদন দাখিল হয় গত ৬ এপ্রিল। তবে তৎকালীন ক্রয় কার্যালয়ের প্রধান হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা বিটিসিএলের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসাদুজ্জামান চৌধুরী এবং একটি বিশেষ মহল প্রকল্পটি আটকে রেখেছিল। একপর্যায়ে বিষয়টি আদালতেও গড়ায়।
এক রিট পিটিশনের শুনানিতে (রিট পিটিশন নং-১৩২৮৭/২০২৩) চেম্বার জজ আদালতের নির্দেশে বাণিজ্যিক প্রস্তাব উন্মোচন করা হয়। গত ৮ নভেম্বর প্রকল্পের বাণিজ্যিক প্রস্তাব উন্মোচিত হয়। এর এক দিন আগে অসৎ উদ্দেশে অবৈধভাবে প্রকল্পটি আটকে রাখার অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত হন আসাদুজ্জামান।
পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক বিটিসিএলের এক কর্মকর্তা বলেন, ডিপিপি অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ব্যান্ডউইথের চাহিদা হবে ২৯ হাজার ৮০০ জিবিপিএস, যা বুয়েটের সমীক্ষায়ও উল্লেখ করা হয়েছে। বর্ণিত দরপত্রে ১ লাখ ২৬ হাজার ২০০ জিবিপিএস ব্যান্ডউইথের সংস্থান রাখা হয়েছে, যা বুয়েটের সমীক্ষায় উল্লেখ করা সক্ষমতার চার গুণ বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন।
অন্যদিকে বিটিআরসির প্রক্ষেপণে ২০৩০ সাল নাগাদ সারা দেশের ব্যান্ডউইথের সম্ভাব্য চাহিদা হবে ৩৭ হাজার ৫০০ জিবিপিএস। যার ৩০ শতাংশ হিসেবে ১১ হাজার ২৫০ জিবিপিএস বিটিসিএল ধারণ করবে। সে তুলনায় আলোচ্য টেন্ডারে ১ লাখ ২৬ হাজার ২০০ জিবিপিএস ক্যাপাসিটির সংস্থান রাখা হয়েছে, যা বিটিআরসির প্রক্ষেপণের প্রায় ১২ গুণ বেশি। সুতরাং এই ক্যাপাসিটির ব্যান্ডউইথ দিয়ে ২০৩০ সালের চাহিদা মিটিয়ে ২০৪১ সালের স্মার্ট বাংলাদেশ হওয়ার নিমিত্ত কার্যকর ভূমিকা রাখতে সম্ভব হবে। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, প্রকল্পটি প্রণয়নে সম্ভাব্যতা যাচাই করতে প্রায় পৌনে ২৯ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। আলোচ্য টেন্ডারটি কারিগরি বিনির্দেশ প্রণয়ন থেকে শুরু করে অদ্যাবধি প্রায় ১৯ মাস সময় অতিবাহিত হয়েছে, যেখানে অনেক অর্থ ব্যয় হয়েছে। এ পর্যায়ে বিধি দরপত্র বাতিল করে নতুন করে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ চাহিদা নির্ণয়পূর্বক নতুন করে কারিগরি বিনির্দেশ প্রস্তুতসহ টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে কমপক্ষে আরও দুই বছর সময় প্রয়োজন হবে। এতে একদিকে সরকারি অর্থের অপচয় হবে এবং অন্যদিকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য এবং স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের উদ্দেশ্যে অর্জন বিলম্বিত হতো।
ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার কালবেলাকে বলেন, ‘এ প্রকল্পের দরকার আছে। কারণ (মোবাইল নেটওয়ার্ক) সম্প্রসারণ করতে হবে। সারা দেশে ফাইভ-জি নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে দিতে হবে। তবে যন্ত্রপাতিগুলো নতুন প্রযুক্তির কেনা যায় কি না, সে বিষয়ে লিখিতভাবে বলেছি। বিটিসিএলের চেয়ারম্যান ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগেরও সচিব। বিটিসিএলের বোর্ডই বিষয়টি দেখবে।’