বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোর ডাকা হরতাল কিংবা অবরোধের মধ্যেই ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে রেল কর্তৃপক্ষ। ইতোমধ্যে হরতাল-অবরোধের সময় যাত্রীবাহী ট্রেন, রেলপথ, রেলসেতুতে অগ্নিসংযোগও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটানো হয়েছে। শিডিউল বিপর্যয় ঘটছে। আজ থেকে আবারও হরতাল, এমন অবস্থায় এক প্রকার চ্যালেঞ্জ নিয়েই ট্রেন চালাচ্ছে সংশ্লিষ্টরা। অপরদিকে রেলপথে নাশকতা বেড়ে যাওয়ায় যাত্রীদের জন্য ‘ভয়ংকর’ হয়ে উঠেছে ট্রেনযাত্রা। এমন কর্মসূচিতে হামলার আতঙ্ক নিয়েই ট্রেনে চলাচল করছে সাধারণ যাত্রীরা। নাশকতা প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় থাকলেও বিচ্ছিন্নভাবে নাশকতার ঘটনা ঘটছে।
বুধবার মধ্যরাতে টাঙ্গাইল রেলওয়ে স্টেশনে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যেই টাঙ্গাইল কমিউটার ট্রেনের ৩টি বগি জ্বালিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। ১৬ নভেম্বর দিনাজপুরের বিরামপুর রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় রেলপথে আগুন ধরিয়ে দেয় নাশকতাকারীরা। এর আগে গাজীপুরের মাটিকাটা রেলসেতুতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। গত ৬ নভেম্বর ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথে টায়ার জ্বালিয়ে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা বিক্ষোভ করে। দুষ্কৃতকারীরা জয়দেবপুর-টঙ্গী স্টেশনের মাঝামাঝি ধীরাশ্রম এলাকায় অগ্নিসংযোগ করে। ১ নভেম্বর ইশ্বরদীর লোকোশেড এলাকায় মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেনে হামলা চালায় দুষ্কৃতকারীরা। ওই দিন দুপুরের দিকে ট্রেনটিতে পেট্রোলসহ পাথর ও ইট ছুড়ে মারা হয়। এতে ট্রেনের গ্লাস ভাঙাসহ বেশ কয়েকটি কোচের ক্ষয়ক্ষতি হয়। শুক্রবার কমলাপুর স্টেশনে যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড় ছিল। পঞ্চগড় এক্সপ্রেস ট্রেনের যাত্রী অলিউল্লাহ ব্যাপারি জানান, রোববার থেকে আবারও হরতাল। এখন রেলপথেও আতঙ্ক। ট্রেনে নিরাপদ ভেবে টিকিট কেটেছিলাম, এখন দেখি এ পথেও বিপদ। ট্রেনের কোচ পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। সিল্কসিটি এক্সপ্রেস ট্রেনের যাত্রী ফাহমিদা অনামিকা জানান, রাতে ট্রেনটি ছেড়ে যাবে। পুরো রাত ট্রেনটি চলবে। মা ও তিন সন্তান নিয়ে ট্রেনে থাকবেন। কখন কী হয়-ভয়-আতঙ্কে আছেন।
ঢাকা রেলওয়ে বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তা শাহ আলম কিরণ শিশির যুগান্তরকে জানান, রেল সাধারণ মানুষের পরিবহণ। আমরা সাধারণ যাত্রীদের সেবা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ট্রেন চালাচ্ছি। কিন্তু হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচিতে রেলে অগ্নিসংযোগ-ভাঙচুরের ঘটনা ঘটছে। যাত্রীবাহী কোচ জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। রেলসেতুতে অগ্নিসংযোগ করা হচ্ছে। আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় রয়েছে। কিছু ট্রেন বিলম্বে চলছে-তবে যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে আমরা সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নিচ্ছি। ট্রেন পরিচালনার ক্ষেত্রে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যাত্রীসেবা নিশ্চিত করতে ঝুঁকির মধ্যেই ট্রেন পরিচালনা করছেন। হরতালে চলমান ট্রেনের ভেতর এবং ইঞ্জিন ও গার্ডরুমে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য অবস্থান করবেন। একাধিক ট্রেনচালক ও গার্ড জানান, বিগত দুটি জাতীয় নির্বাচনে রেলপথ ও বিভিন্ন স্টেশনে ব্যাপক অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুরসহ নাশকতা চালানো হয়। ওই সময় মাইলের পর মাইল রেলপথও উপড়ে ফেলা হয়েছিল। ওই সময় নির্বাচন প্রতিহতের নামে সারা দেশে চরম নৈরাজ্য সৃষ্টি করা হয়। জ্বালাও-পোড়াও, পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ, যাত্রীবাহী ট্রেনে অগ্নিসংযোগ করে মানুষ হত্যা, ট্রেনের লাইন কেটে ফেলা, ট্রেনে হামলা, ইঞ্জিন পুড়িয়ে দেওয়াসহ নানারকম সস্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালানো হয়। ওই সময় নাশকতাকারীরা ট্রেন-স্টেশনের অগ্নিসংযোগ ছাড়াও রেল-সংকেত পাঠানোর তার কেটে ও ট্রেনে ককটেল হামলা চালিয়েছিল।
রেলওয়ে অপারেশন দপ্তর সূত্রে জানা যায়, কিছু দিনের মধ্যে ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে পশ্চিম-উত্তরাঞ্চলে আরও দুটি নতুন ট্রেন চালানোর কথা রয়েছে। একই সঙ্গে ১ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে সরাসরি কক্সবাজার পর্যন্ত একটি বিরতিহীন ট্রেন পরিচালনা করার কথা। কিন্তু, হরতাল-অবরোধকে কেন্দ্র করে সাধারণ ট্রেন যাত্রীর সঙ্গে রেল সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও আতঙ্কে রয়েছেন। ট্রাফিক দপ্তর বলছে, হরতাল-অবরোধের সময় নাশকতা রোধে প্রয়োজনে একেকটি আন্তঃনগর ট্রেনের সামনে একটি টহল রেল ইঞ্জিন দিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে।
ভুক্তভোগী যাত্রীরা জানান, ট্রেনের জন্য দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হচ্ছে তাদের। বাসে নিরাপদ মনে না করায় ট্রেনকেই বেছে নিচ্ছেন তারা, কিন্তু এখানেও শিডিউল বিপর্যয়ের কবলে পড়তে হচ্ছে। শনিবার কমলাপুর স্টেশনে অধিকাংশ ট্রেন ৩০ মিনিট থেকে সাড়ে ৪ ঘণ্টা পর্যন্ত বিলম্বে ছেড়ে গেছে। বাংলাদেশ পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি ও রেলওয়ে পুলিশের প্রধান দিদার আহম্মদ যুগান্তরকে বলেন, হরতাল কিংবা অবরোধে-ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক রাখতে আমরা সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় রয়েছি। স্টেশন, ট্রেন, রেলপথসহ রেলওয়ে স্থাপনা রক্ষায় রেলওয়ে পুলিশের সঙ্গে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও কাজ করছেন। সাধারণ মানুষকে সচেতন করা হচ্ছে। রেল জনমানুষের বাহন, সরকারি সম্পদ, এ সম্পদ রক্ষা করা সবার দায়িত্ব। নাশকতাকারীদের ছাড় দেওয়া হবে না জানিয়ে তিনি বলেন, নাশকতাকারীদের কাউকেই ক্ষমা করা হবে না। সবাইকে চিহ্নিত করা হচ্ছে। এদের সর্বোচ্চ শাস্তি পেতে হবে।