তফশিল অনুযায়ী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ ৭ জানুযারি। তবে মাঠের বিরোধী দল বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলো এ তফশিল প্রত্যাখ্যান করেছে। একই সিদ্ধান্ত নিয়েছে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, বাম গণতান্ত্রিক জোটসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় দলগুলো। এ ইস্যুতে পৃথক কর্মসূচি পালনও করছে তারা। এ অবস্থায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনে নেওয়ার জোর চেষ্টা চালাচ্ছে। বিভিন্ন পর্যায়ে বৈঠক করছে। এদিকে নির্বাচনবিরোধীদের পাশে চায় বিএনপিও। ভোট থেকে বিরত রাখতে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়েছে দলটি।
নেতাদের আশা, নানা প্রলোভন ও চাপ উপেক্ষা করে গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার স্বার্থে বেশিরভাগ দলই নির্বাচনে যাবে না। পাশাপাশি দলটি গণতান্ত্রিক বিশ্বের ভূমিকার দিকেও দৃষ্টি রাখছে। নীতিনির্ধারকরা জানান, কোনো ধরনের সমঝোতা ছাড়াই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা করা হয়েছে। এর মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দল আরও একটি একতরফা নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে। এমন প্রেক্ষাপটে রাজপথে চলমান আন্দোলন আরও জোরদার করতে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো যারা দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না, তাদের অবস্থানে অনড় থাকার বিষয়ে বিএনপি নানাভাবে কাজ করছে। সরকারের লোভ-চাপের কাছে নতিস্বীকার করে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোর কোনো নেতা যেন নির্বাচনে অংশ না নেন, সেদিকেও সতর্ক দৃষ্টি রাখা হচ্ছে। এজন্য বিএনপির বিভিন্ন পর্যায় থেকে নিজ দল ও সমমনা দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো হয়েছে।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা সমমনা দলগুলোকে নিয়ে যুগপৎ আন্দোলন করে যাচ্ছি। এদেশের গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য সেই আন্দোলনে সবাই ঐক্যবদ্ধ আছি। যারা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে আছেন তাদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ আছি।’
দলটির কেন্দ্রীয় সহ দফতর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু বলেন, ‘সরকারের বিরুদ্ধে এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে বিএনপি সব দল, মত ও নানা শ্রেণি-পেশার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য সব প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। সবার সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে যোগাযোগ করার চেষ্টা চলছে। এর প্রতিফলনস্বরূপ যেদিন তফশিল ঘোষণা করা হয়, সেদিন সব দল ও মতের মানুষ যার যার অবস্থান থেকে এর প্রতিবাদ করতে নেমেছে। এতেই প্রমাণ হয় বাংলাদেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ আজ ঐক্যবদ্ধ। সরকারি দল আওয়ামী লীগ উৎসুক কিছু মানুষকে দিয়ে বিভিন্নভাবে দল গঠন করে এবং নির্বাচনে আনার চেষ্টা করছে। এই প্রক্রিয়ায় যারা পা দিচ্ছে তারা নির্বাচনে গেলে, আওয়ামী লীগ ও প্রশাসনের তাণ্ডব যখন দেখবে তখন বুঝবে কত ভুল তারা করেছে।’
বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা মনে করেন, তফশিল ঘোষণার পর তাদের মধ্যে বড় আশার জায়গা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো একযোগে প্রত্যাখ্যান করেছে ইসি ঘোষিত তফশিল। বিদ্যমান অবস্থায় দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট আরও প্রকট হচ্ছে। এরপর আছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের চাপ।
এখন বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পক্ষে শক্ত অবস্থান নেওয়া যুক্তরাষ্ট্রসহ গণতান্ত্রিক বিশ্ব কখন কী ভূমিকা রাখবে, এর ওপর বিশেষ নজর রাখছেন দলগুলোর নেতারা।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী যুগান্তরকে বলেন, ‘এত মামলা-হামলা, গ্রেফতার-নির্যাতনের পরও সব ভয়ভীতি উপেক্ষা করে নেতার্মীরা মাঠে থেকে কর্মসূচি সফল করছেন। আগামী দিনের আন্দোলন আরও তীব্র হবে। একতরফা নির্বাচনের তথাকথিত তফশিল জনগণ মানে না। অধিকাংশ বিরোধী রাজনৈতিক দল তফশিল ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করছে। বিএনপিসহ সমমনা দল ও জোট চূড়ান্ত কর্মসূচি দিয়ে মাঠে রয়েছে। অন্যান্য রাজনৈতিক দলও কঠোর কর্মসূচি পালন করছে। আমাদের সবার দাবি একই, সরকারের পদত্যাগ।’
বিএনপিসহ সমমনা দল ও জোট ছাড়াও বাম গণতান্ত্রিক জোট, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিশ, বিজেপি, এনডিএম, এবি পার্টিসহ আরও বেশ কয়েকটি দল তফশিল প্রত্যাখান করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এসব দল নানা কর্মসূচিও পালন করছে।
বিএনপির একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা জানান, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন বর্জন করায় ঘরে-বাইরে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল বিএনপি। ওই সমালোচনার জবাব দিতে খালেদা জিয়া কারাগারে থাকা অবস্থায় ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে অংশ নেয় দলটি। এ দুটি নির্বাচনের কোনোটিই দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। ফলে সদ্যঘোষিত তফশিল অনুযায়ী আগামী বছরের ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পক্ষে যৌক্তিক কোনো কারণ খুঁজে পায়নি বিএনপি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থায়ী কমিটির এক নেতা দাবি করেন, নির্বাচনে নেওয়ার ব্যাপারে এখন পর্যন্ত বিরোধী কোনো দলকেই সরকার রাজি করাতে পারেনি। সরকার এখন বিএনপি ভাঙার চেষ্টা করছে। যা কোনো দিনই সফল হবে না। এখন ‘তৃণমূল বিএনপি’, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম), স্বতন্ত্র গণতন্ত্র মঞ্চসহ কয়েকটি দলে নেওয়ার জন্য বিএনপির কয়েকজন নিষ্ক্রিয় নেতাকে ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। এ বিষয়ে দলের হাইকমান্ড অবগত আছেন। যাদের ন্যূনতম দেশপ্রেম রয়েছে, গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা চান তারা কখনও সরকারের এ ফাঁদে পা দেবে না বলে তাদের বিশ্বাস রয়েছে।
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল হালিম বলেন, সরকারবিরোধী মানুষের জন্য আশার কথা হচ্ছে, দেশের ডান-বাম নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত বহু রাজনৈতিক দল একতরফা তফশিল প্রত্যাখ্যান করেছে। পাশাপাশি রাজপথেও আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য তৈরি হয়েছে।
১২ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতা কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে অতীতেও দেখা গেছে পরিস্থিতি সাপেক্ষে অনেক দল তাদের সিদ্ধান্ত বদলায়। অন্যদের বিষয়ে কিছুই বলতে পারব না। আমরা যারা ১২ দলীয় দলীয় জোটে আছি তারা আন্দোলন নিয়ে ব্যস্ত প্রধান শরিক বিএনপির নেতৃত্বে। আশা করি বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশসমূহের শুভেচ্ছা ও আমাদের আন্দোলন উভয়ের সম্মিলিত চেষ্টায় আন্দোলন সফল হবে।
এবি পার্টির সদস্য সচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সব মহলের উদ্বেগ ও আপত্তি উপেক্ষা করে বিতর্কিত নির্বাচন কমিশন যে তফশিল ঘোষণা করেছে তা আওয়ামী লীগ ছাড়া সবাই প্রত্যাখ্যান করেছে। এটা যে আবারও একটা ভোটারবিহীন একদলীয় নির্বাচন হতে যাচ্ছে তাতে কারও কোনো সন্দেহ নেই। তফশিল বাতিল ও গ্রেফতারকৃত নেতাদের মুক্তি দিতে হবে। একটি কার্যকর অর্থবহ সংলাপের মাধ্যমে সবার অংশগ্রহণে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে। যদি তা না করা হয় তাহলে জাতির জন্য ঘোর অমানিশা নেমে আসবে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
গত শুক্র ও শনিবার দলের জাতীয় পরিষদ ও কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিও (সিপিবি) দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।