২৩ নভেম্বর ২০২৪, শনিবার, ০৭:৪২:১৭ অপরাহ্ন
উন্নয়নের মাইলফলক স্পর্শ করার বছর
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৮-১২-২০২৩
উন্নয়নের মাইলফলক স্পর্শ করার বছর

ঘটনাবহুল চলতি বছরকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর অপেক্ষায় পুরো বিশ্ব। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে শেষ হতে চলা ২০২৩ সাল ছিল বাংলাদেশের জন্য উন্নয়নের মাইলফলক স্পর্শ করার বছর। চলতি বছরের শেষভাগে এসে একে একে খুলতে থাকে বাঙালির স্বপ্নের দুয়ার। অক্টোবর-নভেম্বর মাসে খুলে দেওয়া হয়েছে বর্তমান সরকারের বড় বড় প্রকল্পগুলো। এর মধ্যে রয়েছে- হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল, পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ (ঢাকা-ভাঙ্গা), আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদু্যৎকেন্দ্রের একাংশ, আখাউড়া-আগরতলা ডুয়েল গেজ রেললাইন এবং ঢাকা-কক্সবাজার রেলপথ। এছাড়া উদ্বোধন হয়েছে পূর্বাচল এক্সপ্রেসওয়ে। উদ্বোধনের অপেক্ষায় আছে বিআরটির আরও কিছু প্রকল্প। এগুলো বাস্তবায়িত হলে দেশের যোগাযোগব্যবস্থা আরও উন্নত হবে। বাড়বে কর্মসংস্থান। একই সঙ্গে খুলবে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার।


পর্যবেক্ষকদের মতে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বৈতরণী পার হতেই এসব মেগা প্রকল্পকে 'ট্রাম কার্ড' হিসেবে ব্যবহার করেছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। দলটি টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করলে আরও মেগা প্রকল্প নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এর মধ্যে পাটুরিয়া থেকে গোয়ালন্দ ঘাটে দ্বিতীয় পদ্মা সেতু নির্মাণ পরিকল্পনা অন্যতম।


৫ অক্টোবর পাবনার রূপপুর স্থাপিত পারমাণবিক বিদু্যৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিটের জন্য রাশিয়া থেকে 'ফ্রেশ নিউক্লিয়ার ফুয়েল' বা ইউরেনিয়াম আসে। আনুষ্ঠানিকভাবে এই জ্বালানি হন্তান্তর অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যোগ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভস্নাদিমির পুতিন। এর মাধ্যমে বিশ্বের ৩৩তম পারমাণবিক ক্লাবে প্রবেশ করে বাংলাদেশ। এটি বাণিজ্যিক উৎপাদনের পর জিডিপিতে দুই


শতাংশ অবদান রাখবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।


তথ্য অনুযায়ী, রূপপুর পারমাণবিক বিদু্যৎকেন্দ্রে শুরু থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ভৌত অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৬১ দশমিক ৬২ শতাংশ। প্রকল্পের আওতায় এখন পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৬৭ হাজার ১১ কোটি টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় হচ্ছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৯২ কোটি ৯১ লাখ টাকা। ২০১৬ সালের জুলাই থেকে ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে এটি বাস্তবায়নের লক্ষ্য রয়েছে। ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ প্রকল্পটি উৎপাদনে আসতে পারে।


৭ অক্টোবর রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনালের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। টার্মিনালটি পুরোপুরি চালুর পর উন্নয়নশীল বাংলাদেশের বার্তা বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে যাবে।


প্রকল্প সূত্র জানায়, তৃতীয় টার্মিনাল তিন তলাবিশিষ্ট। টার্মিনালের আয়তন ২ লাখ ৩০ হাজার বর্গ মিটার। যাত্রী ধারণ সক্ষমতা বছরে ১৬ মিলিয়ন। তৃতীয় টার্মিনালের কার পার্কিংয়ে ১ হাজার ২৩০টি গাড়ি রাখা যাবে। উড়োজাহাজ পার্কিং বে থাকবে ৩৭টি। আগমনী যাত্রীদের জন্য লাগেজ বেল্ট ১৬টি। বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের জন্য ১ হাজার ৩০০ বর্গ মিটার আয়তনের একটি কাস্টম হল থাকবে। সেখানে ছয়টি চ্যানেল থাকবে। চেক ইন কাউন্টার থাকবে ১১৫টি, এর মধ্যে স্বয়ংক্রিয় ১৫টি। ইমিগ্রেশন কাউন্টার ১২৮টি।


১০ অক্টোবর বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো পদ্মা সেতুতে রেল চলাচল উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এটি চালুর মাধ্যমে নতুন দিগন্তের উন্মোচন হয়েছে। এর আগে, পদ্মা সেতুতে পাথরহীন রেললাইনের কাজ শেষ হওয়ার পর ৪ এপ্রিল ভাঙ্গা থেকে পদ্মা সেতুর মাওয়া প্রান্ত পর্যন্ত ট্রায়াল ট্রেন চালায় বাংলাদেশ রেলওয়ে। গত বছরের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী পদ্মা সেতু রেল সংযোগ নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় ঢাকা ও যশোরের মধ্যে রেল সংযোগ নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন। এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এতে চীনের এক্সিম ব্যাংকের ২১ হাজার ৩৬ কোটি ৭০ লাখ টাকা ঋণ রয়েছে।


চলতি বছরের ২৮ অক্টোবর দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম টানেল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। ২০১৫ সালের নভেম্বরে অনুমোদন পায় প্রকল্পটি। ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যৌথভাবে প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। শুরুতে এর ব্যয় ধরা হয়েছিল ৮ হাজার ৪৪৬.৬৪ কোটি টাকা। পরে বৃদ্ধি পেয়ে ১০ হাজার ৩৭৪.৪২ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। এর মধ্যে চীনের এক্সিম ব্যাংক ২% সুদে ৫ হাজার ৯১৩.১৯ কোটি টাকা দিচ্ছে। বাকি টাকা দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার।


কর্ণফুলী নদীর নিচ দিয়ে তৈরি বঙ্গবন্ধু টানেল দেশের উন্নয়নে নতুন পালক। এ টানেল চট্টগ্রাম শহরের সঙ্গে আনোয়ারা উপজেলাকে যুক্ত করেছে। টানেলটি হয়ে উঠছে 'দুই শহরের এক নগরী' এবং কর্ণফুলী নদীর তলদেশে তৈরি হওয়া প্যাসেজওয়ে।


১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যৌথভাবে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে আখাউড়া-আগরতলা আন্তঃসীমান্ত ডুয়েলগেজ রেলপথ উদ্বোধন করেন। একইসঙ্গে দুই প্রধানমন্ত্রী খুলনা-মোংলা বন্দর রেললাইন এবং মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার পস্ন্যান্টের ইউনিট-২ প্রকল্পও উদ্বোধন করেন। আখাউড়া-আগরতলা রেল সংযোগ প্রকল্পটি ভারত সরকারের অনুদান সহায়তায় ভারতীয় ৩৯২ দশমিক ৫২ কোটি রুপি ব্যয়ে সম্পন্ন হয়েছে। এই রেলপথের দৈর্ঘ্য বাংলাদেশে ৬ দশমিক ৭৮ কিলোমিটার ডুয়েল গেজ ও ত্রিপুরায় ৫ দশমিক ৪৬ কিলোমিটার। এছাড়া খুলনা-মোংলা বন্দর রেললাইন প্রকল্পটি ভারত সরকারের কনসেশনাল লাইন অব ক্রেডিটের অধীনে ৩৮৮ দশমিক ৯২ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে সম্পন্ন হচ্ছে। আখাউড়া-আগরতলা ও খুলনা-মোংলা রেললাইন উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে দেশের পরিবহণ ব্যবস্থায় নতুন দ্বার খুলেছে।


৪ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মেট্রোরেলের আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশ উদ্বোধন করেন। একইসঙ্গে এমআরটি লাইন-৫ (উত্তর রুট) নির্মাণকাজেরও উদ্বোধন করেন তিনি। মেট্রোরেল লাইনটি সাভারের হেমায়েতপুর থেকে ভাটারা হয়ে গাবতলী, মিরপুর-১০, গুলশান পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার হবে। এর আগে গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেলের প্রথম ধাপের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী।


তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবর পর্যন্ত প্রকল্পটির আওতায় ব্যয় হয়েছে ২৩ হাজার ৯৮ কোটি ৭২ লাখ টাকা। আর্থিক অগ্রগতি ৬৯ শতাংশ। এছাড়া ভৌত অগ্রগতি ৮৩ শতাংশ। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সংশোধিত ব্যয়সহ মোট ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৩৩ হাজার ৪৭১ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। ২০১২ সালের জুলাই থেকে ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে এ প্রকল্পের বাস্তবায়ন শেষ হবে।


এছাড়া ১১ নভেম্বর ১৮ হাজার কোটি টাকায় নির্মিত দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্প উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু থেকে মিয়ানমারের কাছে ঘুমধুম পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের জন্য ২০১০ সালের ৬ জুলাই প্রকল্পটি অনুমোদন পায়। একইসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ৫৩ হাজার কোটি টাকার আরও ১৬টি প্রকল্প উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। কক্সবাজার রেলস্টেশনকে দেশের প্রথম আইকনিক স্টেশন করে গড়ে তোলা হয়েছে। ঝিনুকের আদলে তৈরি দৃষ্টিনন্দন এ স্টেশন ভবনটির আয়তন এক লাখ ৮২ হাজার বর্গফুট। এতে পর্যটকসহ সাধারণ যাত্রীদের যাতায়াত ব্যবস্থা আরেক ধাপ এগিয়ে গেছে।


সংশ্লিষ্টরা জানান, পদ্মা সেতুর পর মেট্রোরেল ও বঙ্গবন্ধু টানেল চালুর মাধ্যমে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ২ শতাংশের বেশি বাড়বে।


অন্যদিকে যমুনা নদীর ওপর নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধু রেল সেতুর কাজও প্রায় শেষ পর্যায়ে। মেট্রোরেল লাইন-৫ নর্দান রুটের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের পাশাপাশি উদ্বোধন হয়েছে পূর্বাচল এক্সপ্রেসওয়ে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম দৃষ্টিনন্দন ও আকর্ষণীয় এ এক্সপ্রেসওয়ে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে রাজধানীর সঙ্গে যুক্ত। অত্যাধুনিক এ এক্সপ্রেসওয়েতে নেই কোনো স্টপওভার পয়েন্ট, সিগন্যালিং সাইন কিংবা অন্য কোনো প্রতিবন্ধকতা। একটি গাড়ি বাধাহীনভাবে মাত্র ৬-৭ মিনিটে পাড়ি দেবে ১২ কিলোমিটার পথ।


এছাড়া সরকারের বড় উন্নয়ন প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে, ৫১ হাজার ৮৫৪ কোটি ৮৮ লাখ টাকা ব্যয়ে মহেশখালী-মাতারবাড়ী সমন্বিত অবকাঠামো উন্নয়ন। ১৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে রামপাল বিদু্যৎ প্রকল্প। অক্টোবর পর্যন্ত যার ব্যয় হয়েছে ১৪ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা। পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পটি ৪ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়িত হচ্ছে। অক্টোবর পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার ৭৬১ কোটি ৩৩ লাখ টাকা।


শেয়ার করুন