কার্যকর জবাবদিহিতা না থাকায় প্রয়োজনীয় বরাদ্দের পরও ১০৪ প্রকল্পে বাস্তব অগ্রগতি শূন্য। পেরিয়ে গেছে পুরো একটি অর্থবছর। এসব প্রকল্পের অনুকূলে বরাদ্দ ছিল প্রায় ১১৫৯ কোটি টাকা। কিন্তু দু-একটি বাদে বাকিগুলোতে এক টাকাও খরচ হয়নি।
এছাড়া ১৮ বছরের পুরোনো প্রকল্পও রয়েছে এই তালিকায়। এমন চিত্র উঠে এসেছে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি)। বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) অগ্রগতি পর্যালোচনা প্রতিবেদনে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
প্রতিবেদনটি মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) বৈঠকে উপস্থাপন করা হয়। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের সংশোধিত এডিপিতে মোট প্রকল্প ছিল ১৬৮৬টি। এগুলোর মধ্যে ১০৪টি প্রকল্পের কোনো বাস্তব অগ্রগতিই হয়নি।
এর কারণ হিসাবে জানা গেছে, অর্থছাড়ে বিলম্ব, কখনও অর্থছাড় না হওয়া, ভূমি অধিগ্রহণসংক্রান্ত সমস্যা, দরপত্র আহ্বানে বিলম্ব এবং দরপত্র রেসপন্সিভ না হওয়া।
এছাড়া প্রকল্পের ঋণ না পাওয়া, অপ্রতুল বরাদ্দ, মামলাজনিত সমস্যা, ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) সংশোধন, আরডিপিপি অনুমোদনে দেরি এবং উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে ঋণচুক্তিতে দেরিও কারণগুলোর অন্যতম।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আইএমইডির সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন শনিবার যুগান্তরকে বলেন, গত অর্থবছরের বাস্তব অগ্রগতি শূন্য প্রকল্পের সংখ্যা বেশি ছিল। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে কৃচ্ছ সাধনের ফলে বেশকিছু প্রকল্প ‘সি’ ক্যাটাগরিতে রাখা হয়। এগুলোর অনুকূলে বরাদ্দ থাকলেও অর্থছাড় করা হয়নি।
এছাড়া অন্যান্য কারণ তো আছেই। তবে এখন উন্নয়ন প্রকল্পের তদারকি ও বাস্তববয়ন গতি বৃদ্ধির বিষয়ে যেভাবে সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে শুরু করে সব পর্যায়ে আলোচনা হচ্ছে এতে মনে হয় চলতি অর্থবছর এমন প্রকল্পের সংখ্যা কমে আসবে।
তিনি আরও বলেন, পরিকল্পনা কমিশনের বৈঠক, একনেকে বৈঠক, এনইসি বৈঠক এমনকি ডিসি সম্মেলনেও প্রকল্প নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে এর একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। আইএমইডির স্বল্প জনবল নিয়ে প্রকল্প মনিটরিংয়ের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। কিন্তু অর্গানোগ্রাম ঠিক করা না গেলে খুব বেশি দূর যাওয়া যাবে না।
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আইএমইডির যেমন দায়িত্ব আছে তেমনি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর দায়িত্ব রয়েছে।
প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ‘কনস্ট্রাকশন অব বাংলাদেশ চ্যান্সারি কমপ্লেক্স ইসলামাবাদ, পাকিস্তান’ শীর্ষক প্রকল্পটি ২০০৭ সালে হাতে নেওয়া হয়। এটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৯৭ কোটি ৪২ লাখ টাকা। গত অর্থবছরের সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ ছিল ১২ কোটি ৯২ লাখ টাকা।
কিন্তু পুরো অর্থবছরে আর্থিক অগ্রগতি ১০ শতাংশ হলেও বাস্তব অগ্রগতি এখন শূন্যই রয়েছে। দীর্ঘ ১৮ বছর পার হলেও প্রকল্পটির কোনো অগ্রগতি নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ প্রকল্পটি ছিল তিন বছর মেয়াদের। কিন্তু সংশোধনী প্রস্তাবের মাধ্যমে বারবার সময় বাড়ানোর কারণে কেটে গেছে ১৮ বছর। তারপরও শেষ হয়নি পাকিস্তানের ইসলামাবাদে বাংলাদেশ চ্যান্সারি কমপ্লেক্স নির্মাণ কাজ। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এ প্রকল্পটির মেয়াদ ছিল ২০০৭ সালের জুলাই থেকে ২০১০ সালের জুন পর্যন্ত।
প্রথমে এক বছর মেয়াদ বাড়িয়ে ২০১১ সালের জুন দ্বিতীয়বার দুই বছর মেয়াদ বাড়িয়ে ২০১৩ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। এই সময়ের মধ্যেও কাজ শেষ না হওয়ায় প্রথম সংশোধনীর মাধ্যমে ৫ বছর মেয়াদ বাড়িয়ে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়।
দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে আরেকবার দুই বছর মেয়াদ বাড়ানো হয় ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত। এর মধ্যেও কাজ শেষ না হওয়ায় তৃতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে ফের দুই বছর বাড়িয়ে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়েছিল।
প্রকল্পের সর্বশেষ সংশোধনীর কারণ হিসাবে তখন বলা হয়েছিল, পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ায় একক উৎস পদ্ধতিতে একই প্রতিষ্ঠানকে পুনঃনিয়োগ করতে হয়। এছাড়া প্রকল্পের আওতায় নতুনভাবে সীমানা প্রাচীর এবং ল্যান্ডস্কেপিং অঙ্গ অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
পাশাপাশি কিছু সংখ্যক বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি নতুনভাবে অন্তর্ভুক্তি, বিদ্যমান অংশের ব্যয় বৃদ্ধি মিনি অডিটরিয়াম তৈরি এবং বাস্তবায়ন মেয়াদকাল বৃদ্ধি পায়।
একই অবস্থা বিরাজ করছে ‘ডেভেলপমেন্ট অব গুলশান-বনানী-বারিধারা লেক’ র্শীর্ষক প্রকল্পের ক্ষেত্রেও। এটির মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৪১০ কোটি ২৫ লাখ টাকা। কিন্তু গত অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল মাত্র ১ লাখ টাকা। কিন্তু অর্থবছর শেষে এক টাকাও খরচ হয়নি। এমনকি প্রকল্পটির বাস্তব অগ্রগতি শূন্য।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হাতিরঝিলের আদলেই উন্নয়ন করার কথা গুলশান-বনানী-বারিধারা লেকের। রাজউকের নেওয়া মূল উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) ২০১০ সালের জুলাই থেকে ২০১৩ সালের জুন মেয়াদে এটি বাস্তবায়নের কথা ছিল।
এ সময় প্রকল্পের ব্যয় ছিল ৪১০ কোটি ২৫ লাখ টাকা। এরপর ব্যয় বাড়ানো ছাড়া ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়। এতেও কিছু হয়নি।
শূন্য বাস্তব অগ্রগতির তালিকায় উল্লেখযোগ্য কয়েকটি প্রকল্প হলো-প্রমোটিং অডিও ভিজ্যুয়াল নিউজ এন্ড ক্যাপাসিটি বিল্ডিং অব বিবিএস জার্নালিস্টিক ফর ক্রিয়েটিং অডিও ভিজ্যুয়াল নিউজ প্রজেক্ট।
এছাড়া গাজীপুর সিটি করপোরেশনের অবকাঠামো উন্নয়ন, নারায়ণগঞ্জ নগর ভবনের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ, তরল বর্জ্য সংগ্রহ ব্যবস্থাপনা এবং জামালপুর শেখ হাসিনা নকশী পল্লী প্রকল্প।
আরও আছে, শেখ হাসিনা বিশেষায়িত পাটকল স্থাপন, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে ই-সেবা চালুকরণ, ঢাকা ইন্টিগ্রেটেড ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট প্রকল্প, বাংলাদেশ রেলওয়েতে ২১টি ইলেকট্রিক ডুয়েলগেজ ইঞ্জিন সংগ্রহ এবং মাদ্রাসা শিক্ষা ভবন নির্মাণ প্রকল্প।