২২ নভেম্বর ২০২৪, শুক্রবার, ০২:৫০:০৩ পূর্বাহ্ন
বৈদেশিক ঋণের কাঙ্ক্ষিত ব্যয় নেই, নেপথ্যে ৬৭ চ্যালেঞ্জ
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৩-০৩-২০২৪
বৈদেশিক ঋণের কাঙ্ক্ষিত ব্যয় নেই, নেপথ্যে ৬৭ চ্যালেঞ্জ

বৈদেশিক ঋণের অর্থ ব্যয়ে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি নেই। প্রতি বছর মূল এডিপি থেকে মোটা অঙ্কের টাকা কাটছাঁট করে তৈরি করা হয় সংশোধিত এডিপি। শেষ পর্যন্ত সেটিও শতভাগ খরচ হয় না। এর নেপথ্যে ডলার সংকটে এলসি খুলতে না পারা এবং উন্নয়ন সহযোগীদের অর্থ ছাড়ে ধীরগতিসহ ৬৭টি চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করেছে বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের সংশোধিত এডিপি পর্যালোচনা করে এসব চ্যালেঞ্জ খুঁজে বের করেছে সংস্থাটি। সম্প্রতি প্রকাশিত নতুন এক প্রতিবেদনে এসব বিষয় তুলে ধরা হয়েছে।


এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আইএমইডির সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, শুধু সুপারিশ বা কারণ চিহ্নিত করেই আমরা দায়িত্ব শেষ করছি না। আইএমইডির জনবল সংকট রয়েছে। এরপরও অনেক কাজ আমরা নিয়মিত করছি। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগ চিহ্নিত সমস্যাগুলো সমাধানে কি উদ্যোগ নেবে তা মনিটরিং করা হবে। এক্ষেত্রে শুধু আইএমইডির একার দায়িত্ব নয়। মন্ত্রণালয়গুলোরও নিজস্ব দায়িত্ব রয়েছে। আইএমইডির অর্গানোগ্রাম ঠিক না হওয়া পর্যন্ত জনবল সংকট কাটবে না। জনবল বাড়লে কার্যক্রম আরও জোরদার করা সম্ভব হবে।


আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২৭টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের প্রায় ২ শতাধিক বৈদেশিক সহায়তাপুষ্ট প্রকল্প রয়েছে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জ রয়েছে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের আটটিতে। এরপর মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ছয়টি, কৃষি মন্ত্রণালয়, পরিবেশ-বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের চারটি করে চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এছাড়া জননিরাপত্তা বিভাগের চারটি, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দুটি এবং নৌ পরিবহণ মন্ত্রণালয়ের চারটি। স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ, আইন ও বিচার বিভাগ এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের তিনটি করে চ্যালেঞ্জ রয়েছে।


প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, কৃষি মন্ত্রণালয়ের বৈদেশিক অর্থ খরচের হার ৮৯ দশমিক ৩২ শতাংশ। এটির প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটময় পরিস্থিতিতে এলসি খুলতে না পারায় এবং ডলার সংকটের কারণে বিদেশ থেকে কাঁচামাল আমদানি করা সম্ভব হয়নি। এছাড়া উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার কাছ থেকে সময়মতো নির্মাণ কাজের দরপত্রে সম্মতি পাওয়া যায়নি। কোভিড মহামারি পরিস্থিতিতে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে অর্থায়ন নিশ্চিত হওয়া যায়নি। পরিবেশ-বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অর্থ খরচ হয়েছে ৮৮ দশমিক ৫২ শতাংশ। এর উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ হলো-প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধিসহ সংশোধন কাজ চলায় যথেষ্ট পরিমাণ বৈদেশিক অর্থ ছাড় হয়নি। সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কিছু কোর্ডে ৫০ শতাংশ ব্যয় সংরক্ষণ করার কারণে কম খরচ হয়েছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের বৈদেশিক অর্থ খরচ হয়েছে ৮৫ দশমিক ১৭ শতাংশ। এটির কয়েকটি চ্যালেঞ্জ হলো, আমদানি এলসি খোলায় জটিলতার কারণে এমটিইউ ডিভাইস সরবরাহ করতে না পারায় অর্থ ব্যয় হয়নি। এছাড়া স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান থেকে পেট্রোল বোট সরবরাহ করতে না পারা।


প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বৈদেশিক অর্থ খরচ হয়েছে ৭৮ দশমিক ৫৮ শতাংশ। এর অন্যতম কারণ হলো-গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডের অর্থ ইউএনডিপি সরাসরি খরচ করে। এ ক্ষেত্রে সরকার বা প্রকল্প পরিচালককে অবহিত করা হয় না। এসব প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়া মেয়াদ বাড়ায় বৈদেশিক অর্থের ক্ষেত্রে কৃচ্ছ্র সাধন করা হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের বৈদেশিক অর্থ খরচ হয়েছে ৬৭ শতাংশ। এর কারণ হলো, এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) আর্থিক চুক্তির আওতায় অর্থছাড় কম করেছে। এছাড়া এআইআইবি’র আওতায় ব্যয় পরিশোধের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের ক্লাইন্ট কানেকশন সিস্টেমে জমাকৃত উইথড্রল এপ্লিকেশন প্রক্রিয়াকরণে অনেক বেশি সময় প্রয়োজন হচ্ছে। এছাড়া ৫টি নির্ধারিত মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (সিলেট, বরিশাল, রংপুর, রাজশাহী ও ফরিদপুর) বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট প্রকল্পে ধীরগতি আছে। এক্ষেত্রে ডিজাইন ও সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা হয়েছে। জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) গাইডলাইন অনুযায়ী পরামর্শক কাজ করতে পারেনি। কেননা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জায়গা সঠিক সময় ঠিকাদারকে বুঝে দেওয়া সম্ভব হয়নি। এছাড়া শহিদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল উন্নয়ন প্রকল্পের জায়গায় খেলার মাঠ পড়েছিল। ফলে ছাত্রদের বাধায় সেটি বুঝে পেতে অনেক সময় চলে যায়। শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উন্নয়নের জন্য যে জায়গা নির্ধারিত ছিল তার উপর দিয়ে ১১ হাজার ভোল্টের বৈদ্যুতিক লাইন থাকায় সেটি পরিবর্তন করতে হয়। পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রকল্পে আন্তর্জাতিক পরামর্শক চাহিদামতো আউটপুট দিতে পারেনি। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী সরবরাহ চেইন বিঘ্ন ঘটে। ফলে ঠিকাদার সঠিক সময় বিভিন্ন সামগ্রী সরবরাহ করতে পারেনি। স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বেশ কিছু প্রকল্পে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগে সমস্যা দেখা দেয়। এছাড়া ভূমি অধিগ্রহণের টাকা ডিপিপিতে (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) কম ধরা হয়েছিল।


এছাড়া বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের উল্লেখযোগ্য আরও কয়েকটি চ্যালেঞ্জ হলো-পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সময়মতো চুক্তি না হওয়া, কিছু প্রকল্প ‘সি’ ক্যাটাগরিভুক্ত হওয়া এবং বৈদেশিক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম বন্ধ থাকা। এছাড়া ভূমি অধিগ্রহণে জটিলতা, বিভিন্ন প্যাকেজের দরপত্র মূল্যায়ন অনুমোদন না হওয়া এবং দরপত্র সংক্রান্ত জটিলতার কারণে বৈদেশিক অর্থ খরচ করা যায়নি।


এ বিষয়ে পরিকল্পনা সচিব সত্যজিত কর্মকার এর আগে যুগান্তরকে বলেছিলেন, চলমান আর্থিক সংকটে ডলারের সরবরাহ বাড়ানোর উদ্যোগ হিসাবে বৈদেশিক সহায়তাপুষ্ট প্রকল্পের গতি বাড়ানো হচ্ছে। এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন। সে অনুযায়ী ইতোমধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের সভাপতিত্বে একটি বৈঠকও করা হয়েছে। সেখানে বৈদেশিক সহায়তাপুষ্ট প্রকল্প সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিবরা অংশ নেন। এরকম বৈঠক নিয়মিত করা হবে। বৈদেশিক অর্থ ব্যয় করতে না পারার চ্যালেঞ্জগুলো সমাধানে আমরা সব পক্ষ মিলেই সমন্বিতভাবে কাজ করছি।


শেয়ার করুন