রূপকথার গল্পের মতো স্বর্ণ এখন ‘সোনার হরিণ’। হাতে ধরার সাধ্য কার। দাম বাড়ছে লাফিয়ে। দুইদিনের ব্যবধানে দাম বেড়েছে ভরিপ্রতি ১ হাজার ৭৫০ টাকা। এ মুহূর্তে ২২ ক্যারেটের (ভালো মানের) প্রতি ভরি সোনা কিনতে ১ লাখ ১৭ হাজার ৫৭৩ টাকা লাগে। দাম বাড়ছে বিশ্ববাজারেও। নজিরবিহীন দাম বাড়ায় পণ্যটি দেশের নিম্ন ও মধ্যবিত্তের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। ফলে ঈদের এই ভরা মৌসুমেও ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ই হতাশ। জুয়েলারি দোকানগুলোয় স্বর্ণের বিক্রি একেবারে নেই বললেই চলে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সাধারণত অর্থনীতিতে মন্দার আশঙ্কা থাকলে সোনার দাম বাড়ে। জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, মন্দার কারণে মানুষ ডলারের বিকল্প হিসাবে সোনায় বিনিয়োগ করছে।
এছাড়াও বিশ্বের শেয়ারবাজারে অস্থিরতা, বন্ডের সুদের হার কমেছে, ব্যাংকগুলোও আমানতের সুদের হার কমিয়েছে। তিনি বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বাণিজ্য যুদ্ধ এবং ফিলিস্তিন-ইসরাইল যুদ্ধ কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্যে সংকট চলছে। সবকিছু মিলে বিনিয়োগকারীরা সোনায় বিনিয়োগকে নিরাপদ মনে করছেন। তিনি বলেন, দেশের বাজারে দুই কারণে বাড়ছে গুরুত্বপূর্ণ এ পণ্যটির দাম। প্রথমত, বিশ্ববাজারের প্রভাব এবং দ্বিতীয়ত, ব্যাগেজ রুলে বিদেশ থেকে স্বর্ণ আসায় কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে।
রমজান ঈদ স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের অন্যতম মৌসুম। আর স্বর্ণের সবচেয়ে বড় মার্কেট বায়তুল মোকাররম। এ মার্কেটের দোকানগুলোয় সোমবার এক ধরনের হাহাকার দেখা গেছে। বড় দোকানগুলোয় ক্রেতা দু-একজন থাকলেও ছোট বিপণি প্রতিষ্ঠানগুলোয় একেবারেই শূন্যের কোঠায়। জানতে চাইলে আমিন জুয়েলার্সের বিক্রয় প্রতিনিধি সুব্রত কর্মকার যুগান্তরকে বলেন, ঈদে বেচাকেনা একেবারেই খারাপ। ক্রেতা নেই। এর অন্যতম কারণ সোনার দাম বেড়েছে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কম।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) সহসভাপতি অলংকার নিকেতনের মালিক এমএ হান্নান আজাদ যুগান্তরকে বলেন, বিশ্ববাজারের কারণে সোনার দাম বেড়েছে। তিনি বলেন, বিশ্ব অর্থনীতির মন্দা অবস্থা। প্রথমত, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং এরপর মধ্যপ্রাচ্যের সংকট। এ অবস্থায় ডলারের চাহিদা কমেছে। ফলে বিনিয়োগকারীরা সোনা কিনে মজুত করছে। তবে ব্যবহারের জন্য মানুষ সোনা কিনছে না। তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপী একই অবস্থা। তবে বাংলাদেশের অবস্থা ভয়াবহ। কারণ, এমনিতেই সোনার দাম বেশি। এরপর অন্যান্য পণ্যের দাম বাড়ছে। অন্যদিকে মানুষের হাতে টাকা নেই। ফলে স্বর্ণের বেচাকেনা একেবারে কম। বাজুসে ৪০ হাজারের বেশি সদস্য ছিল। ইতোমধ্যে অনেকে ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন। তার মতে, সাধারণত ২০ রোজার পর থেকে স্বর্ণ ব্যবসা ভালো হয়। এ সময়ে মানুষ কেনাকাটা করে। কিন্তু এ বছরের অবস্থা খুবই খারাপ। বেচাকেনা একেবারে নেই। অনেক প্রতিষ্ঠান কর্মচারীদের বেতন দিতে পারবে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামী দিনে অনেককে ব্যবসা ছেড়ে দিতে হবে। আর সোনার দাম বৃদ্ধি কোথায় গিয়ে থামবে, কেউ জানে না। ফলে খাতটি পুরো অনিশ্চয়তার দিকে।
মানভেদে দেশে ৪ ধরনের সোনা বিক্রি হয়। এর মধ্যে ২২ ক্যারেটে ৯১ দশমিক ৬ শতাংশ বিশুদ্ধ শোনা থাকে। ২১ ক্যারেটে ৮৭ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ১৮ ক্যারেটে ৭৫ শতাংশ বিশুদ্ধ সোনা থাকে। আর পুরোনো স্বর্ণালংকার গলিয়ে তৈরি করা হয় সনাতন পদ্ধতির সোনা। এক্ষেত্রে বিশুদ্ধ সোনার পরিমাণ নির্দিষ্ট করা নেই। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, এতে ৬০ শতাংশের মতো পাওয়া যায় বিশুদ্ধ সোনা। এদিকে সোমবার সোনার দাম নির্ধারণ করে বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাজুস)। আজ থেকে তা কার্যকর হবে। নতুন দাম অনুসারে ২২ ক্যারেটের (ভালো মানের) প্রতি ভরি সোনা ১ লাখ ১৭ হাজার ৫৭৩ টাকায় বিক্রি হবে। ২১ ক্যারেটের প্রতি ভরি ১ লাখ ১২ হাজার ২০৭ টাকা। ১১ ক্যারেট ৯৬ হাজার ২২৮ টাকা এবং সনাতন পদ্ধতি প্রতি ভরি সোনা ৮০ হাজার ১৯০ টাকায় বিক্রি হবে। সংশ্লিষ্টরা জানান, দাম বৃদ্ধির কারণে পণ্যটির ক্রেতা একেবারে কমে গেছে। উলটো যাদের হাতে মজুত আছে, তাদের অনেকে সোনা বিক্রি করছেন। অন্যদিকে বর্তমানে দুবাইয়ের বাজারে ২২ ক্যারেটের প্রতি গ্রাম সোনার দাম ৭১ ডলার। প্রতি ডলার ১১০ টাকা হিসাবে স্থানীয় মুদ্রায় যা ৭ হাজার ৮১০ টাকা। আর প্রতি ভরির দাম পড়ে ৯১ হাজার ৯৫ টাকা। তবে সরকারি হিসাবে ডলারের দাম ১১০ টাকা দেখানো হলেও এই দামে কোথাও ডলার পাওয়া যায় না।
সাধারণত, অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা থাকলে বিনিয়োগকারীরা স্বর্ণে বিনিয়োগ করেন। করোনার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে মন্দা অবস্থা। প্রভাবশালী মুদ্রাগুলোর বিপরীতে ডলারের দাম কমেছে। ফলে সোনার দামে এর প্রভাব পড়েছে। ২০২০ সালের শুরুতে বিশ্ববাজারে প্রতি গ্রাম সোনার দাম ছিল ৪১ ডলার। সোমবার পর্যন্ত তা বেড়ে ৭১ ডলারে উন্নীত হয়েছে। এ হিসাবে তিন বছরে দাম বেড়েছে ৭৩ শতাংশ। পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর যুগান্তরকে বলেন, বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দাম বৃদ্ধি প্রধান কারণ একটি আর তা হলো, কয়েক বছরে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি খারাপ অবস্থায় ছিল। এতে ডলারের প্রতি মানুষের আস্থা কমেছে। বিনিয়োগকারীরা আর ডলারে বিনিয়োগ করতে চাইছে না। তাই বিকল্প হিসাবে তারা স্বর্ণে বিনিয়োগ করছেন। তিনি বলেন, স্বর্ণের প্রতি ভোক্তাদের চাহিদা বাড়েনি। কারণ, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই স্বর্ণের মতো বিলাসী পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধির কথা নয়। কিন্তু স্বর্ণে বিনিয়োগ বেড়েছে। এদিকে গত ৪ বছরে দেশে সোনার দাম কমপক্ষে ৪০ বার ওঠানামা করেছে। ২০২০ সালের শুরুতে ২২ ক্যারেট সোনার প্রতি ভরি ছিল ৫৯ হাজার ১৯৪ টাকা। বর্তমানে তা ১ লাখ ১৭ হাজার ৫৭৩ টাকায় উন্নীত হয়েছে। এ হিসাবে দেশের বাজারে ভরিতে ৫৮ হাজার ৩৭৯ টাকা বেড়েছে সোনার দাম। অর্থাৎ ৪ বছরে সোনার দাম দ্বিগুণ। এ সময়ে সোনায় বিনিয়োগ সবচেয়ে লাভজনক ছিল। কারণ তফশিলি ব্যাংকগুলো আমাদের সুদের হার এতদিন ৬ শতাংশের মধ্যে থাকায় বিনিয়োগ দ্বিগুণ হতে কমপক্ষে ৮ বছর সময় লেগেছে।
দেশের বাজারে প্রতিবছর স্বর্ণের চাহিদা প্রায় ২১ টন। অর্থাৎ কমবেশি এই পরিমাণের স্বর্ণ বা অলংকার কেনাবেচা হয়। কিন্তু স্বর্ণের নীতিমালা হওয়ার পর দেড় বছরে ৫০ কেজির মতো স্বর্ণ আমদানি করেছে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। কাস্টমস কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, এর আগে ২০ বছরে দেশে এক তোলাও স্বর্ণ আমদানি হয়নি। বৈধ আমদানি না থাকায় এ খাত থেকে কোনো শুল্কও আদায় হয়নি। ব্যবসায়ীরাও বিষয়টি স্বীকার করছেন, বৈধভাবে আমদানি হয় না। এতে একদিকে শত শত কোটি টাকা পাচার হচ্ছে হুন্ডির মাধ্যমে। অপরদিকে সরকার হারাচ্ছে শত শত কোটি টাকার রাজস্ব।
সূত্র জানায়, দেশে স্বর্ণের চাহিদার বেশির ভাগই চোরাচালান থেকে আসে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের বিমানে করে স্বর্ণের বার, স্বর্ণালংকার পাচার হয়ে আসছে। এসব দেশে বাংলাদেশের একটি চক্রের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক রয়েছে। এছাড়া বৈধভাবে ১০০ গ্রাম পর্যন্ত সোনা আনা যায়। তবে তা দেশের মোট চাহিদার ১০ শতাংশেরও কম।
জুয়েলারি সমিতি বলছে, অব্যাহত লোকসানের মুখে কয়েক বছরে ৩০ হাজার ব্যবসায়ী তাদের ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন। এছাড়া নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় মানুষ মৌলিক চাহিদা মিটিয়ে সোনার মতো বিলাসী পণ্য কিনতে পারছেন না। বাড়তি দামের কারণে ক্রেতারা সিটি গোল্ডের দিকে ঝুঁকছেন। এছাড়া গোল্ড প্লেটেড নামে একধরনের পণ্য রয়েছে। রুপার ওপর স্কর্ণের লিপ দিয়ে বিক্রি হচ্ছে। ফলে মধ্যবিত্তরা স্বর্ণের প্লেটেড এবং সিটি গোল্ড কিনছেন।
জানা যায়, বিশ্বের সব দেশই কেন্দ্রীয় রিজার্ভে স্বর্ণ রাখছে। স্বর্ণ রিজার্ভে বিশ্বে প্রথম স্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বতর্মানে দেশটির রিজার্ভে ৮ হাজার ১৩৩ টন স্বর্ণ রয়েছে, যা ওই দেশের মোট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ৭৫ দশমিক ১ শতাংশ। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা জার্মানির রিজার্ভ ৩ হাজার ৩৯৫ দশমিক ৫ টন, যা দেশটি মোট রিজার্ভের ৭১ দশমিক ৯ শতাংশ। ইতালির ২ হাজার ৪৫১ দশমিক ৮ টন, যা মোট রিজার্ভের ৭১ দশমিক ৩ শতাংশ। এছাড়া ফ্রান্স ২ হাজার ৪৩৫ দশমিক ৪ টন, যা মোট রিজার্ভের ৭১ দশমিক ৬ শতাংশ। চীনের ১ হাজার ৫৪ দশমিক ১ টন, যা মোট রিজার্ভের ১ দশমিক ১৬ শতাংশ। সুইজারল্যান্ডের ১ হাজার ৪০ টন, যা মোট রিজার্ভের ১৪ দশমিক ২ শতাংশ। রাশিয়া ৯১৮ টন, যা মোট রিজার্ভের ৯ দশমিক ২ শতাংশ। জাপান ৭৬৫ দশমিক ২ টন, যা মোট রিজার্ভের ৩ দশমিক ১ শতাংশ। নেদারল্যান্ডস ৬১২ দশমিক ৫ টন, যা মোট রিজার্ভের ৬০ দশমিক ২ শতাংশ এবং ভারতের ৫৫৭ দশমিক ৭ টন, যা মোট রিজার্ভের ৯ দশমিক ৮ শতাংশ। বাংলাদেশের রিজার্ভ ১৫ টন, যা মোট রিজার্ভের ৬ শতাংশ।