২৩ নভেম্বর ২০২৪, শনিবার, ০৬:০৫:১৭ অপরাহ্ন
বেঁচে গেলেন শতাধিক যাত্রী
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৭-০৪-২০২৪
বেঁচে গেলেন শতাধিক যাত্রী

ঈদের দিন ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পাইলটের দক্ষতায় প্রাণে বেঁচে গেছেন শতাধিক যাত্রী। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের কাঠমান্ডুগামী একটি ফ্লাইট (বিজি-৩৭১) উড্ডয়নের সময় চাকা ফেটে যায়। রানওয়ের মধ্যে থাকা একটি লাইটবক্স ভেঙে বেরিয়ে আসার কারণে বিমানের দ্রুতগামী চাকায় আঘাত লেগে এ ঘটনা ঘটে। টেকঅফের ঠিক আগ মুহূর্তে হওয়ায় পাইলটের নিয়ন্ত্রণে ছিল না বিমানটি। এ কারণে চাকার টায়ার ফেটে যাওয়ার পরও ফ্লাইটটি আকাশে উঠে যায়। পরবর্তী সময়ে পাইলট দক্ষতার সঙ্গে ফের বিমানবন্দরে জরুরি অবতরণ করতে সক্ষম হলে হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।


আরও জানা যায়, ঘটনাটি জানাজানি হওয়ার পর পুরো ফ্লাইটে যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। চাকা ফেটে নাইট্রোজেন গ্যাস ছড়িয়ে পড়ায় ফ্লাইটের মধ্যে অক্সিজেন সরবরাহ কমে যায়। এ সময় আকাশে থাকা ফ্লাইটটির ভেতরে যাত্রীদের মাথার ওপরে থাকা অক্সিজেন মাস্কগুলো একটার পর একটা বেরিয়ে আসতে থাকে। এতে যাত্রীরা আরও আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। কেবিন ক্রুরা দিশেহারা হয়ে এদিক-ওদিক ছুটতে থাকেন। যাত্রীরা কান্নাকাটি শুরু করেন। কেউ কেউ আল্লাহু আকবর বলে আজান দেন। আবার অনেকে উচ্চৈঃস্বরে দোয়া-দরুদ পড়তে থাকেন।


বিমান সূত্রে জানা যায়, বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় এয়ারক্রাফটটি আকাশে উঠে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই দুই পাইলট সিদ্ধান্ত নেন ফ্লাইটটি জরুরি অবতরণের। তারা বিষয়টি শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের টাওয়ারে জানান। ‘মেডে মেডে’ সংকেত দিয়ে ফ্লাইটটি জরুরি অবতরণের অনুমতি চান। একপর্যায়ে টাওয়ার থেকে অবতরণের অনুমতি দেওয়া হয়। এ সময় শাহজালালে আকাশে অবতরণ ও উড্ডয়নের জন্য অপেক্ষায় থাকা দেশি-বিদেশি অন্য ফ্লাইটগুলোকে হোল্ডে (অপেক্ষায়) থাকতে বলা হয়। দুর্ঘটনাকবলিত বিমানের দুই পাইলট এরপর বোয়িং কোম্পানির ৭৩৭ এয়ারক্রাফটটি নিয়ে দীর্ঘ সময় আকাশে চক্কর দিতে থাকেন। কারণ, তখন বিমানের দুই ট্যাংক জ্বালানি তেলে পূর্ণ ছিল। এ সময় জরুরি ল্যান্ডিং করলে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটাসহ বিমানে আগুন ধরে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। যে কারণে এয়ারক্রাফটে থাকা পুরো জ্বালানি তেল ফেলে দেওয়া হয়। যখন বিমানের তেল বহনকারী ট্যাংক জ্বালানিশূন্য হয়ে যায়, তখনই দুই পাইলট জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিমানটিকে শাহজালালের রানওয়েতে জরুরি অবতরণ করান। এর আগে শাহজালাল বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ রানওয়েজুড়ে ফায়ার সার্ভিস, অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসসহ চিকিৎসক প্রস্তুত রাখেন। যাতে বিমানে আগুন ধরে গেলেও সঙ্গে সঙ্গে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেন। এছাড়া কোনো যাত্রী অসুস্থ হয়ে পড়লে যাতে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া যায়।


জানতে চাইলে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শফিউল আজিম যুগান্তরকে বলেন, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) গাফিলতির কারণে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এ দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু বিমানের পাইলটরা খুবই দক্ষতার সঙ্গে পুরো ব্যবস্থা সামাল দেওয়ায় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেনি। কোনো যাত্রীও হতাহত হননি। তবে এ ঘটনায় এক ঘণ্টা ফ্লাইট চলাচল বন্ধ ছিল শাহজালালে। বিকল্প ব্যবস্থায় ফ্লাইটটি জরুরি অবতরণ করা হলেও চাকা ফেটে যাওয়ায় দীর্ঘ সময় রানওয়েতে পড়ে ছিল বিমানটি। পরে টো ট্রাক্টর ব্যবহার করে রানওয়ে থেকে বিমানটি সরিয়ে নেওয়া হয়।


বিমান এমডি আরও বলেন, এ দুর্ঘটনার কারণে বিমানকে মোটা অঙ্কের ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে। এ ঘটনার জন্য বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের কাছে ক্ষতিপূরণ চাওয়া হবে। ইতোমধ্যে বেবিচককে পুরো ঘটনা জানিয়ে একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে। তার মতে, রানওয়েতে একটি নুরি পাথরও বিমান চলাচলের জন্য ঝুঁকি তৈরি করে থাকে। সেখানে একটি লাইট বক্স ভেঙে রানওয়ে থেকে বেরিয়ে আসার পরও কীভাবে সেটি সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মীদের চোখে পড়ল না, তা রহস্যজনক। তিনি জানান, এ দুর্ঘটনায় বিমানের একটি মেইন হুইল বড় ধরনের ডেমেজ হয়। এছাড়া একটি নোজ গিয়ার ও ল্যান্ডিং গিয়ারও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।


বিমানের ফ্লাইট অপারেশন শাখা সূত্রে জানা যায়, ওই ফ্লাইটের পাইলট ছিলেন ক্যাপ্টেন তাপস আহমেদ ও ক্যাপ্টেন মাইনুল হোসেন। তবে এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ কোনো তদন্ত কমিটি গঠন করেনি। রানওয়ের মতো এত স্পর্শকাতর এলাকায় কীভাবে একটি লাইট ভেঙে পড়েছিল এবং এর সঙ্গে কারা সংশ্লিষ্ট্র, তাদেরও খুঁজে বের করাও সম্ভব হয়নি।


নিয়ম অনুযায়ী যে কোনো ফ্লাইট উড্ডয়নের আগে সংশ্লিষ্ট ফ্লাইটের পাইলট ও প্রকৌশলীরা বিমানটিকে ৩ ধাপে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে থাকেন। বিশ্বের প্রতিটি এয়ারলাইন্সে এ ইনস্পেকশন খুবই গুরুত্বের সঙ্গে করা হয়ে থাকে। একইভাবে যে কোনো ফ্লাইট অবতরণ ও উড্ডয়নের পর রানওয়েও ভালোভাবে ইনস্পেকশন করা হয়ে থাকে। অত্যাধুনিক সুইপার মেশিনের মাধ্যমে পুরো রানওয়ে পরিষ্কার করার কথা। কিন্তু বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ ও বিমানের সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা এসব ইনস্পেকশন করাতে কম গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। যে কারণে এ ধরনের একাধিক দুর্ঘটনা ও বিমানের চাকা ফেটে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে।


বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এভিয়েশন ব্যবসায় এয়ারক্রাফটের ল্যান্ডিং গিয়ার ও সংযুক্ত পার্ট চাকাকে বিমানের একটি ক্রিটিক্যাল পার্ট হিসাবে ধরা হয়। এ কারণে এর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য রুটিন ইনস্পেকশনের পাশাপাশি আইএনটি, এসভিসি, এসি ও সি চেক করা জন্য বলা হয়েছে। কিন্তু তারপরও নানা কারণে বিমানের চাকা ফেটে যাওয়া, ল্যান্ডিং গিয়ার বের না হওয়াসহ প্রতিনিয়ত নান দুর্ঘটনার অভিযোগ আছে।


সাধারণত কোনো বিমান রানওয়েতে অবতরণ বা উড্ডয়নের সময় তার গতিবেগ ২৫০ কিলোমিটারের কাছাকাছি থাকে। বিপুল পরিমাণ ওজনসহ এ গতিবেগ নিয়ে বিমান যখন রানওয়ের মাটি স্পর্শ করে, তখন চাকার সঙ্গে রানওয়ের ঘর্ষণ তৈরি হয়। আর এ ঘর্ষণের ফলে সৃষ্টি হয় অগ্নিস্ফুলিঙ্গের। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিমানের একজন পাইলট যুগান্তরকে বলেন, এ অগ্নিস্ফুলিঙ্গ থেকে যাতে আগুন ধরে না যায়, সেজন্য চাকার ভেতর নাইট্রোজেন গ্যাস ভরা থাকে। যাতে আগুন ধরে গেলেও মুহুর্তে তা নিভে যায়। তবে এসব দুর্ঘটনায় যদি কেবিনের মধ্যে নাইট্রোজেন গ্যাস ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে কেবিনের অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। তখন বিকল্প ব্যবস্থায় যাত্রীদের অক্সিজেন দেওয়া হয়। ওই পাইলট আরও বলেন, ১১ এপ্রিলের ঘটনায়ও চাকা ফেটে নাইট্রোজেন গ্যাস ছড়িয়ে পড়ায় কেবিনের মধ্যে অক্সিজেনের স্বল্পতা দেখা দিয়েছিল। যদি ওইদিন ফ্লাইটটি অবতরণ করাতে আরও দেরি হতো, তাহলে অক্সিজেনের অভাবে অনেক যাত্রী গুরুতর অসুস্থ হতে পারতেন-এমন শঙ্কাও ছিল।


শেয়ার করুন