দেশে এবার বোরোর বাম্পার ফলন হয়েছে। শেরপুর, নওগাঁ, ময়মনসিংহ, সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজারের হাওড়গুলোয় পুরোদমে চলছে ধান কাটা-মাড়াই ও শুকানোর কাজ। সোনার ধানে ঘর-আঙিনা ভরে উঠলেও কৃষকের মুখে নেই হাসি। কারণ, তারা পাচ্ছেন না ন্যায্য দাম। সরকার এবার ধানের দাম মণপ্রতি ১২৮০ টাকা নির্ধারণ করলেও কেনা শুরু করবে ৭ মে থেকে। কিন্তু অনেক কৃষকই ইতোমধ্যে ধান ঘরে তুলেছেন। তারা চাষাবাদের খরচের দেনা শোধ এবং ধান কাটা ও মাড়াইয়ের খরচ মেটাতে এখই বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। আর এ সুযোগ নিচ্ছেন কতিপয় ফড়িয়া ও আড়তদার।
কৃষক জানান, ফসলের মাঠ দেখে তাদের মন ভরে গেলেও বাজারে গিয়ে হতাশায় ডুবছেন। সার, কীটনাশক, ধান কাটার খরচসহ সব খাতে তাদের অতিরিক্ত ব্যয় হয়েছে। কিন্তু এখন মনপ্রতি মানভেদে ৭২০ থেকে ১০০০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। অথচ একজন ধানকাটা শ্রমিকের দৈনিক মজুরিই দিতে হচ্ছে ৮০০ থেকে ৮৫০ টাকা। এতে উৎপাদন খরচ উঠবে কি না, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় কৃষক। তবে আড়তদাররা বলছেন, বাজারে আমদানি বেশি, চাতাল মালিকরা এজন্য দাম কমিয়ে দিয়েছেন।
২১ এপ্রিল সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ সভাকক্ষে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার সাংবাদিকদের জানান, চলতি বছর কৃষকের কাছ থেকে ৩২ টাকা কেজি দরে ৫ লাখ টন ধান কিনবে সরকার। গতবার ৩০ টাকা দরে কেনা হয়েছিল। সে হিসাবে এবার প্রতি কেজিতে দুই টাকা বাড়ানো হয়েছে। ৭ মে থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ধান কেনা চলবে। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
সুনামগঞ্জ : শাল্লার আনন্দপুর গ্রামের কৃষক সমুজ আলী বলেন, সরকার প্রতি মন ধানের দাম ১২৮০ টাকা নির্ধারণ করলেও ক্রয়কেন্দ্রগুলোয় এখনো ধান কেনা শুরু হয়নি। অন্যদিকে বেশির ভাগ কৃষককে এখনই ধান বিক্রি করতে হবে। এ কারণে ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা মন ধরে বিক্রি করে দিচ্ছে। তিনি বলেন, আমাদের গ্রামে এমনও হয়েছে, ১০ দিন আগে ধান কাটা শুরু হওয়ার সময় ৭২০ টাকা হিসাবে দাম নির্ধারণ করে টাকা দিয়ে রেখেছে, এখন ওই দামে মেপে ধান নিচ্ছে ফড়িয়ারা।
জামালগঞ্জের হালির হাওড়ের কৃষক আয়না মিয়া বলেন, ভৈরব, মদন, কিশোরগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকার চাতালের ফড়িয়ারা বেহেলীর ঘাট, রাইঙ্গা ও হাওরি আলীপুরের ঘাটে নৌকা লাগিয়ে খলা থেকে ধান কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। বেশির ভাগ কৃষকই দেনা ও খরচ মেটানোর জন্য ৬৫ থেকে ৭০ ভাগ ধান বিক্রি করে ফেলছেন। মোটা ধান ৮৫০ থেকে ৯০০ এবং চিকন ধান ৯৫০ থেকে ১০০০ টাকা মণে বিক্রি হচ্ছে।
বাংলাদেশ কৃষক সমিতি সুনামগঞ্জ জেলা কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন তালুকদার বলেন, কৃষকের যখন টাকার প্রয়োজন, তখন সরকারিভাবে ধান কেনা হয় না। সরকার যখন ধান কেনা শুরু করে, এর আগেই কৃষকের ধান বিক্রি শেষ হয়ে যায়। তিনি বলেন, সরকার যে দাম নির্ধারণ করেছে, তাতেও কৃষক খুব একটা লাভবান হবেন না। কারণ, উৎপাদন খরচ এর চেয়েও বেশি।
তবে সরকারিভাবে ধান কিনতে বিলম্ব হচ্ছে না দাবি করে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ মইনুল ইসলাম ভুঞা যুগান্তরকে বলেন, ৫ মে ধান কাটা শেষ হবে, ৭ মে থেকে সরকারিভাবে ধান ক্রয় শুরু হবে।
শেরপুর ও নালিতাবাড়ী : শেরপুর সদর উপজেলার খুজিউরা গ্রামের কৃষক জাহিদুল হক বলেন, বীজ, সার, কীটনাশক, ধান রোপণ ও কাটা পর্যন্ত চাষের খরচ অনেক বেশি। সে তুলনায় বাজারে ধানের দাম পাওয়া যাচ্ছে না। বর্তমানে এক মন নতুন ধানের দাম ৯০০ থেকে ৯৫০ টাকা। ধানকাটা শ্রমিকের বর্তমান মজুরিই স্থানভেদে ৮০০ থেকে ৮৫০ টাকা। এছাড়া কৃষি শ্রমিকদের তিন বেলা খাবার দিতে হচ্ছে। এক মন ধান বিক্রি করে একজন কৃষি শ্রমিকের বেতনও হচ্ছে না।
একই উপজেলার গণইবরুয়াপাড়া গ্রামের কৃষক নজরুল ইসলাম বলেন, উৎপাদন খরচ বাড়লেও বাজারে ধানের দাম বাড়েনি। শক্তি-১, শক্তি-২ ও তেজগোল্ড জাতের প্রতি মন নতুন ধান বর্তমানে ৯০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ দামে ধান বিক্রি করে পোষাচ্ছে না। প্রতি মন কমপক্ষে ১৫ শ টাকা হলে ভালো হতো।
নালিতাবাড়ী উপজেলার কলসপাড় গ্রামের কৃষক হানিফ উদ্দিন বলেন, ধান আবাদ করে এখন লাভ হয় না। ধানের দাম দুইদিন আগে ছিল ৯৪০ টাকা, এখন প্রতি মন বিক্রি হচ্ছে ৮৬০ টাকায়। একই উপজেলার যোগানিয়া ইউনিয়নের কাপাশিয়া গ্রামের কৃষক জসিম উদ্দিন বলেন, দামের কারণে গত আমন মৌসুমে লোকসানে পড়েছি। আশা ছিল বোরো আবাদে ক্ষতি পুষিয়ে নেব। কিন্তু যত ধানের ভরা মৌসুম আসছে, ততই দ্রুত বাজারে ধানের দাম কমে যাচ্ছে। কীভাবে কী করব, কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না।
মৌলভীবাজার ও বড়লেখা : হাওড়পাড়ের বোরোচাষি শাহীন আহমদ, নিমার আলী, হযরত আলী, রমজান আলী ও হবি মিয়া জানান, অধিকাংশ কৃষক ধারদেনা করে বোরো চাষ করেছেন। ফসল বিক্রি করে তা পরিশোধ করবেন। ধান কাটার সঙ্গে সঙ্গেই পাওনাদারদের চাপ বেড়ে যায়। তখন লাভক্ষতির দিকে না চেয়ে তারা ধান বিক্রি শুরু করেন। খাদ্য বিভাগ ৩২ টাকা কেজি দরে ধান কিনবে আরও বেশ কয়েকদিন পর। কিন্তু কৃষক বাধ্য হয়ে ২২-২৫ টাকায় বিক্রি করে দিচ্ছেন। তারা আরও জানান, আগাম বন্যার আশঙ্কায় কৃষক এপ্রিলের শুরু থেকেই হাকালুকিতে আধাপাকা ধান কাটা শুরু করেন। ধান কাটা ও আনুষঙ্গিক ব্যয় মেটাতে তারা মাঠেই কম দামে ধান বিক্রি করছেন।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মনোয়ার হোসেন জানান, এবার হাকালুকি হাওড়ে বোরোর ফলন ভালো হয়েছে। ইতিমধ্যে হাওড়ের প্রায় ৮৫ ভাগ ধান কাটা সম্পন্ন হয়েছে। নানা সমস্যায় অনেক কৃষক মাঠেই ধান বিক্রি করছেন। তবে কম দামে বিক্রির বিষয়টি জানা নেই।
ফুলপুর (ময়মনসিংহ) : উপজেলার বাজারগুলোয় প্রতিমন ধান চিকন ৯০০ থেকে ৯৫০ টাকা এবং মোটা ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। প্রায় এক মন ধানের টাকা দিতে হচ্ছে একজন শ্রমিকের প্রতিদিনের মজুরি। ভালকি গ্রামের কৃষক বাবুল মিয়া জানান, ধানের দাম কম থাকায় আবাদ করে লাভ হচ্ছে না।
রাণীনগর (নওগাঁ) : উপজেলার কালীগ্রামের কৃষক মো. রাজ্জাক বলেন, ২০ বিঘা জমিতে চিকন জাতের ধানের আবাদ করেছি। দুইদিন আগে থেকে ধান কাটা-মাড়াই চলছে। কয়েক বিঘা জমির ধান কাটা-মাড়াই হয়েছে। এবার এক বিঘা জমিতে জিরা ধানের ২২ থেকে ২৩ মন ফলন পেয়েছি। তিনি বলেন, শুক্রবার বাজারে জিরাধান বিক্রি করেছি ১২৮০ টাকা মন। তার দাবি, বাজারে ধানের দাম কম। ১৪৫০ থেকে ১৫০০ টাকা মন দরে ধান বিক্রি হলে কৃষক লাভবান হতো। তারেক শেখ নামে এক কৃষক জানান, দুই বিঘা জমি বর্গা এবং তিন বিঘা জমি মৌসুমভিত্তিক টাকার বিনিময়ে নিয়ে চিকন ও মোটা জাতের ধান চাষ করেছি। ফলন ভালো হয়েছে। কিন্তু বাজারে ধানের দাম কম। ধান বিক্রি করলে প্রতি বিঘায় দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা লোকসানে পড়তে হবে।