ডলার সংকট, মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি, ব্যাংকিং খাতের দুরবস্থার মধ্যেই চলছে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট তৈরির কাজ। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী ৬ জুন জাতীয় সংসদে প্রথমবারের মতো বাজেট উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। আগামী অর্থবছরের বাজেটে অন্যতম অগ্রাধিকার পাচ্ছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। উচ্চমূল্যের বাজারে মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে বেঁধে রাখতে চান অর্থমন্ত্রী। যদিও এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা খুবই সন্দিহান।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, গত মার্চ মাসে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ। যার মধ্যে খাদ্যে মূল্যস্ফীতির হার ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ। যদিও সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ্রসাধন ও পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধিসহ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখায় মূল্যস্ফীতি পর্যায়ক্রমে কমে আসবে বলে মনে করছে অর্থ বিভাগ।
জানা গেছে, প্রতিবছর সাধারণত বাজেটের আকার ১২-১৫ শতাংশ বাড়ানো হয়; কিন্তু আর্থিক সংকটের কারণে চলতি বছরের তুলনায় আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটের আকার ৫-৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেতে পারে। এতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ছাড়াও বাজেট ঘাটতিকে নিয়ন্ত্রণযোগ্য পর্যায়ে রাখতে বিশেষ নজর থাকবে যেন সামষ্টিক অর্থনৈতিক ভারসাম্য নিশ্চিত করা যায়। এ ছাড়া সবার জন্য খাদ্য, সরবরাহ ব্যবস্থা উন্নয়ন, প্রবৃদ্ধি অর্জন, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বৃদ্ধি, প্রতিটি গ্রামের আধুনিকায়ন, ডিজিটাল স্বাস্থ্য ও শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ, ফাস্ট ট্র্যাক অবকাঠামো প্রকল্পে গুরুত্বারোপ, জলবায়ু অভিঘাত ও বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলায় পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়গুলোও প্রাধান্য পাবে।
জানা গেছে, সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ্রসাধন, খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি ও পণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে। এ ছাড়া পণ্যের বাজার মনিটরিং, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী বৃদ্ধি করা এবং জ্বালানি তেলের মূল্য বিশ্ববাজারের সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সমন্বয়করণের ব্যবস্থা বাস্তবায়ন হচ্ছে। এসব বিষয় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছে অর্থ বিভাগ।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, আগামীতে মূল্যস্ফীতির হার আরও ঊর্ধ্বমুখী হতে পারে। কারণ ডলারের ঊর্ধ্বগতির কারণে মূল্যস্ফীতিতে চাপ থেকেই যাচ্ছে। টাকার মান অবমূল্যায়ন করে মূল্যস্ফীতি কোনোভাবেই সাড়ে ৬ শতাংশের মধ্যে রাখা সম্ভব নয়। এটি করতে পারলে সরকারকে স্বাগত জানাবেন বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ। তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে সরকার। রিজার্ভ নিচের দিকে নামছে। এটি সরকারের ভুল নীতির কারণে হয়েছে। তার ধারণা, আগামীতে দেশের অর্থনীতিতে চলমান অস্থিরতা বজায় থাকবে।
অর্থ বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, আগামী অর্থবছরে বাজেটের আকার প্রাক্কলন করা হয়েছে ৭ লাখ ৯৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। আর রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ৫ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন উৎস থেকে ২ লাখ ৫৭ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে বাজেট ঘাটতি মেটানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে ১ লাখ কোটি টাকার বিদেশি ঋণ পাওয়া যাবে বলে আশা করছে সরকার। বাকি ১ লাখ ৫৭ হাজার কোটি টাকা দেশের ব্যাংকিং খাতসহ অন্যান্য উৎস থেকে ঋণ নেওয়া হবে।
অর্থ বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, উচ্চ সুদের কারণে আগামী অর্থবছরের বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ না নিয়ে এ খাতের পুরনো ঋণ পরিশোধ করবে সরকার। কিন্তু সঞ্চয়পত্রের চেয়েও বেশি সুদবাহী হওয়া সত্ত্বে¡ও সরকারি চাকরিজীবীদের বিনিয়োগের মাধ্যম জেনারেল প্রভিডেন্ট ফান্ড (জিপিএফ) থেকে ঋণের পরিমাণ বাড়াবে সরকার। একই সঙ্গে ব্যাংক খাত থেকে চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের তুলনায় অতিরিক্ত প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
আগামী অর্থবছর সঞ্চয়পত্রের পুরনো বিনিয়োগ ম্যাচিউরড হওয়ায় সরকার যে পরিমাণ ঋণ ফেরত দেবে, তার চেয়ে ৫০ কোটি টাকার কম সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিকল্পনা করছে সরকার। অর্থাৎ আগামী অর্থবছরের বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা মাইনাস ৫০ কোটি টাকা প্রাক্কলন করা হচ্ছে। এ লক্ষ্য অর্জনে দেশের সাধারণ সঞ্চয়কারী ও পেনশনভোগীদের জন্য ২০২৪-২৫ অর্থবছর সঞ্চয়পত্র কেনা আরও কঠিন করা হয়ে যেতে পারে। কিন্তু সঞ্চয়পত্রের সুদহারের চেয়েও অনেক বেশি সুদবাহী জিপিএফ থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের তুলনায় আগামী অর্থবছর আরও ৩০ কোটি টাকা বাড়ানো হচ্ছে। জিপিএফ থেকে নেওয়া সরকারের ঋণের সুদের পরিমাণ ১৩ শতাংশ। শুধু সরকারি চাকরিজীবীরাই উচ্চ সুদবাহী জিপিএফ ফান্ডে টাকা বিনিয়োগ করতে পারেন। অর্থাৎ ২২ লাখ সরকারি চাকরিজীবী এই উচ্চ সুদের সুবিধা ভোগ করছেন ও করবেন।
অন্যদিকে সঞ্চয় স্কিমগুলোর মধ্যে পেনশনার সঞ্চয়পত্রে পাঁচ বছরান্তে সর্বোচ্চ ১১.৭৬ শতাংশ, পরিবার সঞ্চয়পত্রে পাঁচ বছরান্তে সর্বোচ্চ ১১.৫২ শতাংশ, পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রে সর্বোচ্চ ১১.২৮ শতাংশ এবং তিন মাস পর পর মুনাফাভিত্তিক তিন বছর মেয়াদি সঞ্চয়পত্রের তিন বছরান্তে সর্বোচ্চ ১১.০৪ শতাংশ সুদ দিচ্ছে সরকার।
সঞ্চয়পত্র কেনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিধি-নিষেধ আরোপ করার কারণে সাধারণ মানুষ যেসব সঞ্চয়স্কিমে বিনিয়োগ করেন, সেগুলোতে বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে। তবে ব্যাপকভাবে বাড়ছে পেনশনার সঞ্চয়পত্র, যেখানে মূলত সরকারি চাকরি থেকে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিনিয়োগ করে থাকেন।
সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যেমন সর্বোচ্চ সীমা আছে, জিপিএফে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য আগে কোনো সীমারেখা ছিল না। ২০১৫ সালের নভেম্বরের আগ পর্যন্ত একজন চাকরিজীবী তার মূল বেতনের শতভাগ জিপিএফে রাখতে পারতেন। ওই বছরের নভেম্বর মাসে জিপিএফ তহবিলে বিনিয়োগ সীমা নির্ধারণ করে দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। সে অনুযায়ী বর্তমানে একজন সরকারি চাকরিজীবী তার মূল বেতনের সর্বনিম্ন ৫% এবং সর্বোচ্চ ২৫% জিপিএফ তহবিলে বিনিয়োগ করতে পারেন।