হাওরের ধান কাটা শেষ হয়েছে। কোন রকম দুর্যোগ ছাড়াই অনুকূল আবহাওয়ায় কৃষক তাদের সোনালী ধান গোলায় তুলতে পেরে খুবই খুশি। এবার হাওরে বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৫০ হাজার টন উৎপাদন বেশি হয়েছে।
এ বছর সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় শুধু হাওরে ৪ লাখ ৫৩ হাজার ৪০০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি। আর তাতে ৫০ হাজার টন অধিক উৎপাদনও হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর সারাদেশে ৫০ লাখ ৫৮ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ২০ হাজার হেক্টর বেশি। হাওরভুক্ত ৭টি জেলায় এবার ৪ হাজার ৪০০টির বেশি কম্বাইন হারভেস্টার দিয়ে ধান কাটা হয়েছে। এর মধ্যে এ বছরই নতুন ১০০টি কম্বাইন হারভেস্টার বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। দেশের অন্য এলাকা থেকেও হাওরের বোরো ধান কাটার জন্য কম্বাইন হারভেস্টার নিয়ে আসা হয়। এর ফলে দ্রুততার সাথে ধান কাটা সম্ভব হয়েছে।
সুনামগঞ্জ থেকে মো. হাসান চৌধুরী জানান, জেলার ১২ উপজেলায় ১৩৭টি হাওর আবাদ করা বোরো ধান কাটা-মাড়াই শেষ হয়েছে। এবার আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে এবং ধান ভালভাবে কাটা মাড়াই শেষ করে কৃষক ঘরে তুলতে পেরেছেন। বৈশাখ মাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কোনো ঝড়-বৃষ্টি বন্যা, না হওযায়, ধান কাটা-মাড়াই শেষে রোদে ধান শুকিয়ে গোলায় তুলতে পারে কৃষক-কৃষাণী আনন্দের সীমা নেই।
জেলা কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ১২টি উপজেলার ১৩৭টি ছোট-বড় হাওর ও বিলে বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। এবার ২ লাখ ২৩ হাজার ৪০৭ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। আবাদ করা জমি থেকে ১৩ লাখ ৭০ হাজার ২০০ মেট্রিক টন ধান উৎপাদিত হয়েছে। যার বাজার মূল্য মূল্য ৪ হাজার ১১০ কোটি টাকা।
গতকাল সকালে সরজমিনে কথা হয় সদর উপজেলার দেখার হাওর পাড়ের দরিয়াবাজ গ্রামের এক কৃষক দম্পতির সঙ্গে। তারা ইনকিলাবকে বলেন বৈশাখ মাস জুড়ে অজানা এক আতংকে দিন-রাত কাটেছে, কখন যেন, আবহাওয়া বিঘ্রে গিয়ে ঝড়-বৃষ্টি, শুরু হয়Ñ আর কষ্টের ফলানো সোনার ফসল বন্যার পানিতে তলিয়ে যায়। কিন্তু আল্লার রহমতে সেটা হয়নি। আমরা ভালভাবে ধান শুকিয়ে গোলায় তুলতে পেরেছি। এতে আল্লার কাছে লাখ কোটি শুকরিয়া।
কৃষক আলী আহমদ বলেন, শুনেছি বৈশাখ দ্বিতীয় সাপ্তাহে খুব বৃষ্টি হবে, বন্যা হবে। এতে খুব দুশ্চিন্তায় ছিলাম তাই তাড়াহুড়া করে ধান কাটা-মাড়াই শুকনো কাজ শেষ করেছি। কিন্তু আজ বৈশাখ মাস প্রায় শেষ এখন পর্যন্ত আল্লাহর রহমতে আবহাওয়ার পরিস্থিতি ভাল এমন আবহাওয়া থাকায় গতকাল স্থানীয় বাজারে ৫০ মন ধান বিক্রি করেছি। ধানের দর ভালো পেয়েছি।
নেত্রকোনা থেকে এ কে এম আব্দুল্লাহ জানান, এ জেলায় চলতি বোরো মৌসুমে ধানের বাম্পার ফলন হওয়ায় কৃষকের মুখে হাসি ফুটেছে। নেত্রকোনা মূলত ধান উদ্ধৃত জেলা। এ জেলায় উৎপাদিত ধান স্থানীয় কৃষকদের চাহিদা পূরণ করে অন্যান্য জেলায় সরবরাহ করা হয়ে থাকে। নেত্রকোনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি বোরো মৌসুমে জেলায় ১ লক্ষ ৮৫ হাজার ৩ শত ২০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ করা হয়। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবং কোন ধরনের রোগ বালাই না দেখা দেয়ায় হাওরাঞ্চলসহ উঁচু এলাকায় এবার বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। কৃষি বিভাগ আশা করছে, এবার জেলায় যে পরিমাণ ধান উৎপাদিত হবে তা থেকে ৮ লক্ষ ২ হাজার ৬ শত মেট্রিক টন চাউল উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি।
আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবং আগাম বন্যা, ঝড় শিলা বৃষ্টি না থাকায় প্রচণ্ড রোদে কোনো রকম ঝামেলা ছাড়াই ধান টাকা, মাড়াই ও শুকিয়ে কৃষকরা তাদের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের ফসল গোলায় তুলতে পারছেন। নেত্রকোনার হাওরাঞ্চল হিসেবে পরিচিত জেলার খালিয়াজুরী, মদন, মোহনগঞ্জ ও কলমাকান্দা উপজেলায় ইতোমধ্যে শত ভাগ বোরো ধান কাটা শেষ হয়েছে।
সরেজমিনে জেলার বিভিন্ন হাওরাঞ্চল ঘুরে কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, কৃষি কাজে যান্ত্রিকীকরণের কারণে হাওরাঞ্চলসহ উঁচু এলাকায় এবার শ্রমিক সংকট নেই। কৃষকরা হারভেস্টার মেশিন দিয়ে তাদের জমির ধান দ্রুত কেটে ঘরে তুলতে পেরেছেন। এতে তারা খুবই খুশি। প্রান্তিক চাষীরা বছরের খোরাকির জন্য কিছু ধান সিদ্ধ করে ভাল ভাবে শুকিয়ে ঘরে সংরক্ষণ করছেন। বাকী ধান জমি থেকেই বিক্রি করে দিচ্ছেন। ফারিয়া দালালরা জমি থেকেই ধান কিনে নিচ্ছেন।
মোহনগঞ্জ উপজেলার নলজুরী গ্রামের কৃষক সাত্তার মিয়া বলেন, এ বছর ধানের ফলন ভালো হয়েছে। প্রথম দিকে হাওরে ৯ শত টাকা থেকে সাড়ে ৯ শত টাকা মন দরে ধান বিক্রি করেছি। আমার ৬০ কাঠা খেতে ৪০০ মন ধান হয়েছে।
কিশোরগঞ্জ থেকে মো. জাহাঙ্গীর শাহ্ বাদশাহ জানান, এ জেলার হাওরের বোরো ধান কাটা শেষ হয়েছে। নিরাপদে ধান কাটা শেষে কৃষক এখন ব্যস্ত ধান ও খড় শুকানোর কাজে। ঘামে ভেজা শরীরে নেই কোন ক্লান্তি চাপ। বোরোর ভালো ফলন ভুলিয়ে দিয়েছে তাদের বিগত সময়ের ধার-দেনা, দাদন আর কৃষি উপকরণ সংকটের কষ্ট-যন্ত্রণা। কৃষকের মুখে ফুটে উঠেছে হাসি।
ইটনা উপজেলার বেতেগা গ্রামের সড়কে ধান শুকাচ্ছিলেন সুলতানা বেগম। তিনি বলেন, আমার নিজের উঠান আছে, সেটা ছোট আর রোদ কম পাওয়া যায়। এই হানে যে ধান ২-৩ দিনে শুকাইবে সেই ধান আমার উঠানে শুকাইতে ৯-১০ দিন লেগে যাবে, আল্লাহর রহমতে এখনও রোদ আছে কখন যে বৃষ্টি চলে আসে তখনতো আরও বিপদ বাড়বে। সেই জন্য নিজেই রাস্তায় আসছি ধান শুকানোর কাজে সময়ও কম লাগলো টাকাও বাঁচলো।
দেশের অন্যতম প্রধান বোরো উৎপাদনকারী জেলা কিশোরগঞ্জ। কৃষি বিভাগ জানায়, চলতি মৌসুমে বোরো ধান কাটা ও মাড়াইকাজ শেষ হয়েছে। এ বছর জেলায় ১ লাখ ৬৭ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে বোরো চাষ হয়েছে। এর মধ্যে হাওরেই আবাদ হয় ১ লাখ ৩ হাজার ৬২০ হেক্টর জমি। মিঠামইন, ইটনা, অষ্টগ্রাম, নিকলী, বাজিতপুর, তাড়াইল, করিমগঞ্জ ও কটিয়াদী উপজেলার হাওরসহ উজান এলাকার অন্যান্য উপজেলায়ও বোরোর বাম্পার ফলন হয়েছে। এছাড়া কৃষক ধানের দামও মোটামুটি ভালো পাচ্ছেন। ফলে এবার বোরোর বাম্পার ফলনে ও ভালো দামে হাসি ফুটেছে কৃষক-কৃষাণীর মুখে।
সিরাজগঞ্জ থেকে সৈয়দ শামীম শিরাজী জানান, এ জেলার উল্লাপাড়া, তাড়াশ ও কামারখন্দ উপজেলায় আগাম জাতের বোরো ধান কাটা ব্যাপক হারে শুরু হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূল থাকায় উৎপাদন বেড়েছে। এছাড়া টানা রোদ থাকায় ধান ঘরে তোলার সুফল পাচ্ছে কৃষক। এজন্য কমবাইন্ড হারভেস্টার মেশিনের পাশাপাশি স্থানীয় শ্রমিক দিয়ে ধান কাটা হচ্ছে। ইতিমধ্যে ৪০ ভাগ ধান কাটা হয়েছে। তাড়াশ উপজেলার কুসুম্বি গ্রামের কৃষক আব্দুস ছালাম জানান, এবছর চলন বিলে ধানের আবাদ ভালো হয়েছে। আমরা ধান কাটা শুরু করেছি। প্রতি বিঘা জমিতে প্রায় ৩০-৩২ মন ধানের উৎপাদন হচ্ছে।
ময়মনসিংহের গফরগাঁও থেকে মুহাম্মদ আতিকুল্লাহ জানান, এ উপজেলার ১৫টি ইউনিয়নে চলতি মৌসুমে বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। ফলে এবারে কৃষকের মুখে হাসি ফুটেছে। তবে ধানের প্রতিমণ উৎপাদন খরচ বিগত সময়ের চেয়ে কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। গফরগাঁও উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ রকিব আল-রানা জানান বোরো আবাদ হয়েছে ২৩ হাজার ৬ শত হেক্টর। লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ২৯ হাজার মেট্রিক টন। তবে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি উৎপাদন হবে বলে তিনি জানান। সরকারি হিসেব মতে, প্রতিমণ ধানের দাম নিধারণ করা হয়েছে ১২ শত ৮০ টাকা। এ দরে কৃষকরা সরকারি গুদামে ধান বিক্রি করতে পারবে। জনপ্রতি কৃষক ১ টন থেকে সর্বোচ্চ ৩ টন পর্যন্ত সরকারি গুদামে বিক্রি করতে পারবে। কিন্তু বাস্তবে কৃষক তা পারছেন না। গফরগাঁও উপজেলার ৩নং চরআলগী ইউনিয়নের চরমছলন্দ গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মোড়ের সফল কৃষক মো. জনাব আলীর ছেলে মো. আসাদুল ইসলাম জানান, ভাইরে বহুদিন পরে আমরা সুন্দর পরিবেশে আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ফলে ভাল ভাবে বোরো ধান কেটে ঘরে আনতে পারছি। এরলাইজ্ঞা আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করছি। তবে পল্লী বিদ্যুতের সর্বনাশা লোডশেডিংয়ের ফলে বোরো ক্ষেতে কিছুটা পানি দিতে বিঘ্ন ঘটছে। গফরগাঁও উপজেলা সদরসহ বিভিন্ন ছোট-বড় হাটবাজারে পুরোদমে নতুন ধান বিক্রির ধুম পড়েছে। অনেক ব্যবসায়ীরা কৃষকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ধান কিনতে পারছে। চিকন ধান প্রতিমণ ১ হাজার ১ শত টাকা ও মোটা ধান প্রতিমণ ৯ শত টাকা থেকে ১হাজার টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।