আন্তর্জাতিক পাচার চক্রের ষড়যন্ত্রে পাঁচ কোটি টাকার বিনিময়ে কলকাতার নিউটাউনে বন্ধু আখতারুজ্জামানের ভাড়া নেওয়া বহুতলের ফ্ল্যাটে খুন হয়েছেন বাংলাদেশের সংসদ-সদস্য আনোয়ারুল আজিম। আনার খুনের নেপথ্যে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে স্বর্ণ চোরাচালানের অর্থ ভাগবাঁটোয়ারা নিয়ে বিবাদই মূল বলে জানিয়েছেন তদন্তকারী গোয়েন্দারা। বৃহস্পতিবারই আজিম ‘খুন’র ঘটনায় কলকাতা থেকে এক সন্দেহভাজন যুবককে আটক করেছে পশ্চিমবঙ্গ সিআইডি। সীমান্ত এলাকার বাসিন্দা ওই যুবকের নাম জুবের। সূত্রের খবর, আজিম ‘খুন’র ঘটনায় ইতোমধ্যে বাংলাদেশ পুলিশ যে তিনজনকে গ্রেফতার করেছে, তাদের একজন এই জুবেরের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। এছাড়া, নিউটাউনের আবাসনের সিসিটিভি ফুটেজে ট্রলি ব্যাগ বার করতে দেখা গিয়েছে।
আজিমের ‘দেহ লোপাট’ করতে ট্রলি ব্যবহার করা হয়েছিল কিনা, তার সঙ্গে জুবেরের কোনো যোগ আছে কিনা, তদন্তকারীরা তা খতিয়ে দেখছেন। তাকে জেরা করা হচ্ছে। সিআইডির তদন্তে জানা গিয়েছে, বাংলাদেশ থেকে যে ভাড়াটে কিলাররা কলকাতায় এসেছিল তারা দমদম বিমানবন্দরের লাগোয়া ভিআইপি রোডের একটি হোটেলে উঠেছিল। এমপিকে খুনের পর ওই হোটেল পরিবর্তন করে একটু দূরের চিনার পার্কে নতুন অন্য হোটেলে ১৮ মে পর্যন্ত আত্মগোপন করেছিল খুনিরা। দুই হোটেলের সিসিটিভি ফুটেজ ইতোমধ্যে সংগ্রহ করেছে পশ্চিমবঙ্গ সিআইডি। তদন্তের স্বার্থে ওই ফুটেজ বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের পাঠানো হবে বলে কলকাতার গোয়েন্দা অফিসাররা জানিয়েছেন।
ঘটনার জেরে আনোয়ারুলের ৩০ বছরের বন্ধু কলকাতার বরানগরের স্বর্ণ ব্যবসায়ী গোপাল বিশ্বাসকেও জেরা করছেন পশ্চিমবঙ্গের গোয়েন্দারা।
কারণ, ভারতে এসে প্রথমে গোপালের বাড়িতে ওঠেন ১২ মে, পরদিন দুপুরে তার বাড়ি থেকেই বেরিয়ে যান। তদন্তে জানা গিয়েছে, এমপির বন্ধু আখতারুজ্জামানের বাংলাদেশি সুন্দরী বান্ধবীকে দিয়ে ওই ফ্ল্যাটে ১৩ মে ডেকে আনা হয় এমপি আনারকে। সঙ্গে আসেন আমানুল্লাহ নামে এক কুখ্যাত সুপারি কিলার ও তার সঙ্গী আরেক দুষ্কৃতি। ওইদিনই নিউটাউনের ওই ফ্ল্যাটে বাংলাদেশি সুপারি কিলাররা প্রথমে আনোয়ারুলকে শ্বাসরোধ করে খুন করে। পরে ১৬ থেকে ১৮ মে পর্যন্ত, বহুতলের ওই ৫৮ নম্বর ফ্ল্যাট থেকে দফায় দফায় দেহ টুকরো টুকরো করে পাচার করা হয়। তদন্তে নেমে সিসিটিভি ফুটেজ ও সন্দেহভাজনদের জেরা করে চাঞ্চল্যকর খুনের এমনই তথ্য বৃহস্পতিবার জানতে পেরেছেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সিআইডির গোয়েন্দারা।
এমপির দেহ বা দেহাংশ উদ্ধার না হলেও পরিকল্পিত খুনের তথ্য নিয়ে কীভাবে নিশ্চিত হচ্ছেন প্রশ্নের জবাবে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের সিআইডির আইজি অখিলেশ চতুর্বেদী বলেন, ‘আমাদের কাছে বিস্তারিত ইনপুট আছে। কিন্তু দুদেশেই তদন্ত চলছে, তাই এককভাবে সরকারিভাবে সব কিছু জানানো সম্ভব নয়।’ তবে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এদিন ঢাকায় সচিবালয়ে জানিয়েছেন, প্রায় সবকিছু চিহ্নিত হয়েছে। কারা হত্যা করেছে, তাদের চিহ্নিত করে প্রায় কাছাকাছি এসে গেছি। এখন শুধু ঘোষণার বাকি। দুই দেশের গোয়েন্দারা একমত হতে পারলে সেই ঘোষণাও দেওয়া হবে জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমরা এখনো তদন্ত করছি। তদন্তের প্রয়োজনে ভারতীয় গোয়েন্দাদের একটি টিম বাংলাদেশে আসবে। আবার বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের টিমও কলকাতায় যাবে।
এমপি আনার খুনের নেপথ্যে মোটিভ সম্পর্কে সরকারিভাবে না জানালেও তদন্তকারী গোয়েন্দারা এদিনও ঘটনাস্থলে এসে একান্ত আলাপচারিতায় জানান, ‘বেনাপোল-বনগাঁ সীমান্ত চোরাচালানোর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন নিহত এমপি। সম্প্রতি একটি বড় মাপের স্বর্ণ পাচার হয়। সেই পাচারের টাকার হিসাব নিয়ে বিবাদ চরমে পৌঁছাতেই আমেরিকা প্রবাসী বন্ধু আখতারুজ্জামান আসরে নামেন। কারণ, ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরের বাসিন্দা আখতারুজ্জামানও ওই পাচার চক্রের একজন বড় পান্ডা। মূলত তারই নির্দেশে পাঁচ কোটি টাকার সুপারি দিয়ে কুখ্যাত সুপারি কিলার আখতারুজ্জামানকে পাঠিয়ে খুন করা হয় আনোয়ারুল আজিমকে।’
পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের সিআইডির আইজি অখিলেশ চতুর্বেদী জানিয়েছেন, ‘বাংলাদেশের এমপি খুনের কিনারা করতে ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেট থেকে একটি বিশেষ তদন্ত দল গঠন করা হয়েছে। ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এই মামলাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখার জন্য নির্দেশ এসেছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারও মামলাটি গুরুত্ব দিয়ে দেখার নির্দেশ দিয়েছে।’