ঈদ বা কোনো উৎসবকে কেন্দ্র করে জাল নোট, অজ্ঞানচক্র, মলম পার্টি কিংবা ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মৌসুমি অভিযান দেখা যায়। দুই ঈদের পাশাপাশি কোনো উৎসবের এক-দুই সপ্তাহ আগে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে এমন অপরাধী চক্রের বহু সদস্যকে আটক করে র্যাব-পুলিশসহ অন্যান্য বাহিনী। জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে সংস্থাগুলো জানায়, ‘চক্রের সদস্যরা দীর্ঘদিন জাল নোট তৈরি ও বাজারজাত করছে কিংবা অজ্ঞান করে সর্বস্ব হাতিয়ে নিচ্ছে।’ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এমন বক্তব্যে অনেকের প্রশ্ন-বছরজুড়ে জাল নোট, অজ্ঞানচক্র কিংবা ছিনতাইচক্র তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করলেও ঈদ বা কোনো উৎসবের আগে কেন এ ধরনের অভিযান বেশি? চক্রের কার্যক্রম বছরজুড়ে চললে অভিযান কেন বছরজুড়ে নয়? তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধু ঈদ বা উৎসব ঘিরে নয়, সারা বছর এ ধরনের অভিযান চলমান থাকে। ঈদের আগে ফাঁকা ঢাকায় কিংবা বাড়ি ফেরার পথে মৌসুমি অপরাধীরা অনেক সক্রিয় হয়ে ওঠে। যে কারণে মানুষকে সতর্ক করতে এবং বিশেষ নজরদারি হিসাবে ঈদ বা উৎসবের আগে অভিযান ও গ্রেফতারের ঘটনা বেশি হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক সমাজ ও অপরাধ গবেষক ড. তৌহিদুল হক যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশে উৎসবকেন্দ্রিক অপরাধপ্রবণতা নানাভাবে বেড়ে যাচ্ছে। এ ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান অপরাধীদের দৌরাত্ম্য কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও অপরাধ নির্মূল করা সম্ভব হচ্ছে না। অভিযান বছরব্যাপী অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে পরিচালনা করা উচিত। একই সঙ্গে অপরাধীচক্রদের সঠিক ধারায় ফিরিয়ে আনতে রাষ্ট্রীয়ভাবে সংশোধন ও কর্মের ব্যবস্থা করা উচিত।
র্যাবের তথ্যে দেখা যায়, ঈদুল ফিতরের আগে ৭ মার্চ রাজধানীর রূপনগর থানাধীন ইস্টার্ন হাউজিং এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে একটি জাল নোট তৈরি চক্রের মূলহোতা পারভেজ হোসাইনসহ চারজনকে গ্রেফতার করা হয়। ২৭ মার্চ শরীয়তপুরের নড়িয়া থানাধীন চরমোহনপুর এলাকা থেকে জাল নোট চক্রের মূল হোতাসহ তিনজনকে গ্রেফতার করে র্যাব-৩।
এদিকে ঈদুল আজহার এখনো এক সপ্তাহ বাকি। এর মধ্যেই জাল নোটবিরোধী অভিযানে ৩০ মে ভাটারা থেকে এক যুবককে আটক করে র্যাব। মঙ্গলবার কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুরে ৩৩ হাজার টাকার জাল নোটসহ পিতা-পুত্রকে আটক করে পুলিশ। বৃহস্পতিবার রাজধানীর শ্যামপুর এলাকা থেকে জাল নোট প্রস্তুতকারী চক্রের মূলহোতা হৃদয় মাতব্বরকে গ্রেফতার করে র্যাব-৩। সবশেষ শুক্রবার রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানাধীন কদমতলীতে জাল নোটের কারখানার সন্ধান পেয়ে চক্রের হোতা জাকিরসহ চারজনকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
এ বিষয়ে লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. মশিউর রহমান শনিবার বলেন, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে চক্রের হোতা লিয়াকত হোসেন জাকির ওরফে মাজার জাকির ওরফে গুরু জাকির (৪০), তার দ্বিতীয় স্ত্রী মমতাজ বেগম (২৫), লিমা আক্তার রিনা (৪০) ও সাজেদা আক্তারকে (২৮) গ্রেফতার করা হয়। তাদের কাছ থেকে সোয়া কোটি টাকার জাল নোট এবং আরও প্রায় তিন কোটি টাকার নোট তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। জাকির ২৫ বছর ধরে জাল নোট তৈরিতে জড়িত। কারখানাটিতে ১০০-১০০০ টাকা মানের সব ধরনের নোট তৈরি হলেও ঈদ সামনে রেখে ৫০০-১০০০ টাকার জাল নোট তৈরি করছিল তারা।
মৌসুমি অভিযান প্রসঙ্গে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী দেলোয়ার জাহান যুগান্তরকে বলেন, অপরাধ দমন মূল উদ্দেশ্য হলে কোনো নির্দিষ্ট সময়ে নয়, বরং সারা বছর অভিযান পরিচালনা দরকার। এতে ঈদ বা কোনো উৎসব উপলক্ষ্যে নতুন করে কোনো অপরাধীচক্র মাথাচাড়া দেওয়ার সাহস করবে না।
র্যাব জানায়, সংস্থাটির প্রতিষ্ঠার পর ২০০৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত জাল নোটবিরোধী অভিযানে সারা দেশে ২ হাজার ২১৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। একই সময়ে দেশীয় জাল নোট উদ্ধার করা হয়েছে ২৩ কোটি ১৪ লাখ ৮১ হাজার ৫৭৪ টাকা এবং বিদেশি জাল নোট উদ্ধার হয়েছে ১ কোটি ১৬ লাখ ৩৬ হাজার ৯৮৭ টাকার।
অন্যদিকে চলতি বছরের শুরু থেকে মে মাসের শেষ পর্যন্ত জাল নোট চক্রের ২০ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ সময় ৯৫ লাখ ৫ হাজার ৪০০ টাকার দেশি জাল নোট আর ১৪ লাখ ৮২ হাজার ৮৬ টাকার বিদেশি জাল নোট উদ্ধার হয়। ২০২৩ সালে গ্রেফতার হয় ৫০ জন। এ বছর ৯৫ লাখ ৬০ হাজার ২৬০ টাকার দেশি জাল নোট আর ৭ লাখ ৯ হাজার ৫০০ টাকার বিদেশি জাল নোট উদ্ধার হয়।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার আরাফাত ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, শুধু ঈদ বা উৎসবকে কেন্দ্র করে নয়, সারা বছরই জাল নোট চক্র কিংবা অজ্ঞান পার্টির বিরুদ্ধে অভিযান চলে। তবে ঈদের আগে অনেক মানুষ গ্রামে ফেরায় রাজধানীসহ বড় শহরগুলো ফাঁকা হয়ে পড়লে দুষ্কৃতকারীরা সক্রিয় হয়ে ওঠে। এ কারণে মানুষকে সতর্ক করতে এবং ছুটির সময় বিশেষ নজরদারিতে এসব চক্রের বিরুদ্ধে অভিযান বাড়ে। এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) উপকমিশনার (মিডিয়া) মো. ফারুক হোসেন যুগান্তরকে বলেন, অজ্ঞান পার্টি, মলম পার্টিসহ এ ধরনের অন্যান্য চক্রের বিরুদ্ধে ডিএমপির ক্রমাগত অভিযানে বর্তমানে নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এক বছরের মধ্যে নগরীর কোনো থানায় এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। তারপরও ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে গ্রাম থেকে আসা গরু ব্যাপারীদের সফট টার্গেট মনে করে অপরাধীরা। ফলে অভিযান আরও গতিশীল করা হয়। এছাড়া নগর গোয়েন্দা পুলিশ সারা বছরই এ ধরনের চক্রের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে থাকে।