ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ থেকে নামে-বেনামে প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকার ঋণ বের করে নিয়েছে রাজশাহীর বিতর্কিত নাবিল গ্রুপ। কোনো নিয়মনীতি পরিপালন ছাড়াই ব্যাংকের চারটি শাখা থেকে এই ঋণ তুলে নিয়েছে গ্রুপটি। এর মধ্যে গ্রুপের সাতটি প্রতিষ্ঠানের নামে সরাসরি ঋণ নেওয়া হয় ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। বাকি ৮ হাজার ৯০০ কোটি টাকা পরোক্ষ ঋণ, যা আটটি বেনামি ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে নেওয়া হয়।
শুধু তাই নয়, আলোচ্য গ্রাহককে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে একক গ্রাহকের সর্বোচ্চ সীমা লঙ্ঘন করেছে ব্যাংকটি। আবার এই ঋণের বিপরীতে তেমন কোনো সহায়ক জামানত নেই। ফলে পরোক্ষ ঋণের টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণ ও ইসলামী ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নথি পর্যালোচনায় এ তথ্য পাওয়া গেছে।
নাবিল গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের এমডি হিসেবে আছেন কৃষিবিদ মো: আমিনুল ইসলাম। তার বাবা জাহান বকস মণ্ডল গ্রুপের চেয়ারম্যান। মা আনুয়ারা বেগম এবং স্ত্রী ইসরাত জাহান পরিচালক হিসেবে আছেন। এজাজ আবরার এবং আফরাত ইবনাথ শেয়ারধারী হিসেবে রয়েছেন। বেনামি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সিংহভাগ শেয়ারধারীও নাবিল গ্রুপের কর্তাব্যক্তিরা। অন্যগুলো নামসর্বস্ব কাগুজে প্রতিষ্ঠান।
তবে সূত্র বলছে, নাবিল গ্রুপের বেনামি ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে বের করা এসব ঋণের বড় সুবিধাভোগী চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপ। উত্তরাঞ্চলে চাল, ডাল, গম, চিনি ও ভোজ্যতেলের আমদানিকারক ও সরবরাহকারী হিসেবে চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপের সঙ্গে ব্যবসা রয়েছে গ্রুপটির। এই সুবাদে গ্রæপটির সঙ্গে আতাঁত করে তাদের প্রতিষ্ঠানের নামে-বেনামে ঋণ বের করে নেয় এস আলম গ্রুপ।
কোনো ব্যাংকের পরোক্ষ ঋণ বলতে ঋণপত্র বা এলসি, ব্যাংক গ্যারান্টি, চেক বন্ধক, রপ্তানি ও অভ্যন্তরীণ বিল ক্রয় ইত্যাদি বোঝায়। সংশ্লিষ্টরা জানান, ইসলামী ব্যাংকের ওই শাখাগুলো নাবিল গ্রুপভুক্ত প্রতিষ্ঠানের পক্ষে এসব পরোক্ষ উপাদানের বিপরীতে ঋণ দিয়েছে। সেই ঋণ দীর্ঘদিন ধরে সমন্বয় না করায় তা ফোর্সড ঋণে পরিণত হয়েছে। এ বিষয়ে বক্তব্যের জন্য ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মুনিরুল মওলার মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দেওয়া হলে তিনি রিসিভ করেননি।
নাবিল গ্রুপের এমডি আমিনুল ইসলাম বলেন, এত ঋণ নেওয়ার তথ্য সঠিক না। আমাদের সব ঋণ ২ হাজার ৯০০ কোটি টাকার মতো হবে। তা হলে পরোক্ষ ঋণগুলো আপনাদের গ্রুপের নামে দেখাচ্ছে কেন- এ প্রশ্নে তিনি বলেন, আমার গ্রুপের নামে যদি এই ঋণ থাকে, তাহলে সেটার ডকুমেন্টস আমাদের কাছেও থাকার কথা। কিন্তু সেটা তো নেই। ব্যাংকও এ বিষয়ে কোনো ডকুমেন্টস দেয়নি।
নাবিল গ্রুপের সরাসরি ঋণ: ইসলামী ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদন বলছে, নাবিল গ্রুপের সাতটি প্রতিষ্ঠানের নামে সরাসরি ঋণ রয়েছে ৩ হাজার ৮৮৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংকটির গুলশান শাখায় নাবিল গ্রেইন ক্রপসের নামে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৭৩ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে। একই শাখায় নাবা এগ্রো ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের নামে ঋণ রয়েছে ৭৫৪ কোটি টাকা। বাকি ৫ প্রতিষ্ঠানের ঋণ রয়েছে ব্যাংকটির রাজশাহী শাখায়। এর মধ্যে নাবিল ফিড মিলসের নামে ৪১০ কোটি, নাবিল অটো রাইসের নামে ৩৮ কোটি, নাবিল অটো ফ্লাওয়ার মিলসের নামে ৭৪ কোটি, নাবিল নাবা ফুডসের নামে ৭২৪ কোটি ও শিমুল এন্টারপ্রাইজের নামে ৮০৯ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে। এই আটটির মধ্যে নাবিল এগ্রো ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল এবং নাবিল গ্রেইন ক্রপসের সঙ্গে নাবিল গ্রুপের কোনো সম্পর্ক নেই বলে দাবি করা হয়। ফলে এ দুটি প্রতিষ্ঠানের ১ হাজার ৮২৭ কোটি টাকার ঋণ ও বেনামি।
গ্রুপটির নামে বেনামি তথা পরোক্ষ ঋণ: ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদন মতে, নাবিল গ্রæপের নামে ব্যাংকটির ৮ হাজার ৯৭৫ কোটি টাকার পরোক্ষ ঋণ রয়েছে। আটটি প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করে এই ঋণ বের করা হয়েছে। এর মধ্যে জামান সিন্ডিকেট নামে একটা কাগজে ও নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের নামে ইসলামী ব্যাংকের পাবনা শাখায় ঋণ রয়েছে ১ হাজার ১২৭ কোটি টাকা। রাজধানীর ফার্মগেট শাখায় মার্কেট মাস্টার অ্যানালাইজারের নামে আরেক নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের ঋণ রয়েছে ১ হাজার ৯০ কোটি টাকা। রাজশাহীর নিউমার্কেট শাখায় সুলতান অ্যাসোসিয়েটসের নামে আরেক কাগজে প্রতিষ্ঠানের ঋণ রয়েছে ১ হাজার ১২৩ কোটি টাকা। এ ছাড়া ব্যাংকটির রাজশাহী শাখায় নাবা ফার্মের নামে ৫৪৫ কোটি, মেসার্স এজে ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের নামে ১ হাজার ৫৩১ কোটি টাকা, আনোয়ার ফিড মিলসের নামে ১ হাজার ৩১৯ কোটি টাকা, আনোয়ার ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের নামে ১ হাজার ১১৮ কোটি টাকা ও ইন্টারন্যাশনাল প্রডাক্টস প্যালেসের নামে ১ হাজার ১১২ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে। এর সঙ্গে নাবিল এগ্রো ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল এবং নাবিল গ্রেইন ক্রপসের নামে থাকা ১ হাজার ৮২৭ কোটি টাকার ঋণ যোগ করলে পরোক্ষ বা বেনামি ঋণ দাঁড়ায় প্রায় ১০ হাজার ৮০২ কোটি টাকা।