০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, মঙ্গলবার, ১১:৫২:২৮ অপরাহ্ন
২০ কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়ে বিপাকে নেসকো কর্তৃপক্ষ, বাড়ছে ক্ষোভ
  • আপডেট করা হয়েছে : ১১-০৯-২০২৪
২০ কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়ে বিপাকে নেসকো কর্তৃপক্ষ, বাড়ছে ক্ষোভ

নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানী লিমিটেডে (নেসকো) ২০ জন কর্মকর্তা অবৈধভাবে চাকরি করে আসছেন। গত প্রায় ৬ বছর তারা অবৈধভাবে চাকরি করলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এমন কি ২০ জন কর্মকর্তা নিয়োগের ব্যাপারে তদন্ত কমিটি গঠন ও প্রতিবেদন জমা দেয়া হলেও নেসকো কর্তৃপক্ষ সেটি ধামাচাপা দিয়ে রেখেছিল।


সম্প্রতি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশ হয়ে যাওয়ার পর চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে নেসকো কর্তৃপক্ষের মধ্যে। তবে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পর এ নিয়োগে কেউ দায় নিতে চাচ্ছে না। নিয়োগ বোর্ডের কর্মকর্তারা একে অপরের ঘাড়ে দোষ চাপানোর চেষ্টা করছেন। মুলত নেসকোর এমডি জাকিউল ইসলাম স্বৈরাচার সরকার প্রধান শেখ হাসিনার বান্ধবির ছেলে। যার কারণে বড় ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়ম হলেও তিনি বিষয়টি আমলে নেননি বলে অভিযোগ রয়েছে।


জানা গেছে, নেসকোতে ২০ জন কর্মকর্তা নিয়োগের ক্ষেত্রে মানা হয়নি চাকরির বিধি। চাকরি বিধি না মানায় অযোগ্যরা নেসকোর বিভিন্ন উচ্চপদস্ত কর্মকর্তা হিসাবে নিয়োগ পেয়েছেন। নিয়োগ বোর্ডের সদস্যরা দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে এ নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছেন। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে এমনটাই বলা হয়েছে। ২০১৯ সালে জমা দেয়া তদন্ত প্রতিবেদনে অবৈধভাবে নেসকোর নিয়োগের বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হলেও গত ৫ বছরে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ। এই নিয়োগের পর থেকে নেসকোর কর্মকর্তা-কর্মচারিদের মধ্যে চলছে চাপা ক্ষোভ ও অসন্তোষ।


জানা গেছে, ২০১৮ সালে নেসকোতে বিভিন্ন পদে ২০ জন কর্মকর্তা পর্যায়ে লোক নিয়োগ দেয়া হয়। এই নিয়োগে অনিয়মের বিষয়টি দুর্নীতি দমন কমিশন কমিশন পর্যন্ত গড়ায়। পরে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী হযরত আলীকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন বিউবোর নিরাপত্তা ও অনুসন্ধান বিভাগের পরিচালক বেগ নাসির জাহান, উপ-পরিচালক মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন। এই তদন্ত কমিটি ২০১৯ সালের মে মাসের ১ ও ২ তারিখ সরজমিন নেসকোর প্রধান কার্যালয় রাজশাহীর হেতেমখাঁয় উপস্থিত হয়ে তদন্ত করেন।


তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, অনুমোদিত অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী নেসকোতে নির্বাহী প্রকৌশলীর পদ রয়েছে ৬২টি। তারমধ্যে ৫৫টি পদ শূন্য ছিল। নির্বাহী প্রকৌশলীদের শূন্য পদ পূরণের জন্য ২০১৮ সালের ৫ জুলাই একটি জাতীয় দৈনিক ও একটি ইংরেজি পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। পরে ২১ জুলাই ইউনিফাইড সারভিস রুলস অনুযায়ী নেসকোর ৬৮তম বোর্ড সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১০ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। নিয়োগ বোর্ড কমিটিতে ছিলেন, নেসকোর নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ গোলাম আমহমেদ, এ এইচ এম কামাল, উপ-ব্যবস্থাপক এবিএম ইমতিয়াজ উদ্দিন আহমেদ, ব্যবস্থাপক সুবির রঞ্জন পোদ্দার, সহকারী ব্যবস্থাপক আরিফুর রহমান, ইমদাদুল হক মিয়া, মাসুমা আক্তার, মোহাম্মাদ আব্দুর রহিম, ফায়সাল বিন ওমর, সজীব কুমার ঘোষ।


দেখা গেছে, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর ১৯৫১ টি আবেদন জমা পড়ে। এরমধ্যে ই-মেইল, ওয়েব সাইট ও হার্ডকপিতে প্রাপ্ত আবেদন ডুপ্লিকেট ক্রস মেচিং করে আবেদনের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৬৪৩টি। যাচাই-বাছাই করার পর বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখিত শর্ত পূরণ না হওয়ায় ১২৯৬টি আবেদন বাতিল করা হয়। এরমধ্যে ৩৪৭জন আবেদনকারীকে বোর্ড সভায় চুড়ান্ত করা হয়। প্রার্থীদের ২০১৮ সালের ২৩ অক্টোর শুক্রবার সকাল ১০ টা থেকে সাড়ে ১১ টা পর্যন্ত বুয়েটের ইসিই ভবনে লিখিত পরীক্ষা নেয়া হয়। চুড়ান্তভাবে নির্বাচিত ৩৪৭ আবেদনকারীর মধ্যে ২৮৪ জন প্রার্থী লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেয়। লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী ২৮৪ জনের মধ্যে মেধা তালিকা অনুযায়ী ৬৪ জনকে মৌখিক পরীক্ষার জন্য নির্বাচিত করা হয়। নেসকোর পরিচালনা পর্যদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী লিখিত পরীক্ষায় ৭০ নম্বর, মৌখিক পরীক্ষায় ২০ নম্বর ও শিক্ষাগত সনদের মান অনুযায়ী ১০ নম্বর হিসাবে প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে মেধা তালিকা করা হয়। তবে নিয়োগে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি করা হলেও নিয়োগের যাবতীয় কার্যাদি সুষ্ঠু ও স্বচ্ছতার সাথে সম্পাদন হয়েছে বলে গঠিত কমিটির সদস্যরা প্রতিবেদন দেয়।


এদিকে নেসকোতে চাকরির বিধি না থাকার কারণে নিয়োগের ক্ষেত্রে তারা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়, বিদ্যুৎ বিভাগ, কোম্পানী এ্যাফেয়ার্স স্মারক নং-২৭.০৮৭.০৩১.০০.০০.০২৭(১).২০১০.১৪৫ মোতাবেক ইউনিফাইড সার্ভিস গাইডলাইন অনুসরণ করা হয়। যদিও ইউনিফাইড সার্ভিস রুলস অনুসরণ করার কথা।


প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, লিখিত পরীক্ষার জন্য অনেক অযোগ্য প্রার্থী নির্বাচন করা হয়। যাদের বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে চাকরির নূন্যতম ৭ বছরের অভিজ্ঞতা নেই। এমন কি অনেকেই ভুয়া অভিজ্ঞতার সার্টিফিকেট দিয়ে আবেদন করলেও তাদের চুড়ান্ত করা হয়।


প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, অনেক সহকারী প্রকৌশলী যারা উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী হিসেবে পদোন্নতি পাননি বা পদোন্নতি পাওয়ার যোগ্য নয়, তারা লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। একজন সহকারী প্রকৌশলীকে সরাসরি নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া বাস্তবতা বিবর্জিত এবং সার্ভিস রুল বহির্ভূত। জাতীয় বেতন গ্রেড অনুযায়ী নির্বাহী প্রকৌশলী পঞ্চম গ্রেডের একটি পদ। এই পদে অযোগ্য লোকজন ভূয়া সার্টিফিকেটে নিয়োগ পেলে উত্তরবঙ্গের বিদ্যুৎ সেক্টর পুরোপুরি হুমকির মুখে পড়বে এমনটাও বলা হয়। একই সাথে দ্রুত এই নিয়োগ বাতিল করা এবং এ বিষয়ে বিভাগীয় তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া জন্য সুপারিশ করা হয়।


জানা গেছে, প্রথম পর্যায়ে ২০ জন প্রার্থীকে নিয়োগ প্রদান করা হয়। নিয়োগকৃত ২০ জনের মধ্যে ৫ জন যোগদান না করলে পরে আরও ৫ জনসহ মোট ২৫ জন প্রার্থীকে নির্বাহী প্রকৌশলী পদে নিয়োগ দেয়া হয়। নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ইয়াসির আরাফাতের সর্বসাকুল্যে অভিজ্ঞতা ৭ বছরের চেয়ে ১৪ নিন কম ছিল। মোস্তাফিজ্জুর রহমান, সাইফুল্লাহ রায়হান, কামাল আহমেদ, মোছানেক কবির, হাবিবুর রহমান, ফজলুর রহমান, মাহমুদুল হাসান, মাহমুদুর রহমান, আসাদুর রহমান খান, মোহাম্মদ নাফিদ হাসান গালিব, আব্দুল মতিন এবং মনির হোসেনের ৭ বছরের অভিজ্ঞতা নেই।


এছাড়াও ইউনিফাইড সার্ভিস গাইডলাইন অনুযায়ী নির্বাহী প্রকৌশলী পদে চাকরিতে প্রবেশের বয়স সর্ব্বোচ্চ ৪০ বৎসর উল্লেখ থাকলেও গোলাম মোস্তফার বয়স আবেদনের তারিখ ৪০ বছরের উর্ধ্বে ছিল। ইউনিফাইড সার্ভিস গাইডলাইন এ উল্লেখিত বিধি লংঘন করে নির্বাহী প্রকৌশলী পদে এই নিয়োগ দেয়ার বিষয়ে নিয়োগ কমিটি জানায়, ইউনিফাইড সার্ভিস রুলস এর ১ ‘খ’ বিধি অনুযায়ী কোম্পানীর বোর্ড সার্ভিস রুল সংশোধন করার ক্ষমতা রাখে। যদিও নিয়োগ কমিটি ইউনিফাইড সার্ভিস রুলস স্বপক্ষে কোন প্রমান উপস্থাপন করতে পারেন নি তদন্ত কমিটির কাছে।


এই অবস্থায় ২৫ জনের মধ্যে ১ জন প্রার্থীর সর্বসাকুল্যে অভিজ্ঞতা ৭ বছরের চেয়ে ১৪ দিন কম থাকা, ১২ জন প্রার্থীর রিলেভেন্ট ফেইল এ ৭ বছরের অভিজ্ঞতা না থাকা এবং ১ জন প্রার্থীর চাকরির নির্ধারিত বয়সসীমা ৪০ বছর পার হওয়ার পরও তাদের নির্বাহী প্রকৌশলী হিসাবে নিয়োগ দেয়া, নির্বাহী প্রকৌশলী (অপারেশন) পদে নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি অনুসারে প্রাপ্ত আবেদনপত্র সমূহ সংগ্রহ তালিকা প্রণয়ন, নিয়োগ পরীক্ষা গ্রহণ ও নিয়োগদানসহ যাবতীয় কার্যাদি সম্পন্ন করা কমিটিকে দায়ি করা হয়।


এব্যাপারে কথা বলা হয় নিয়োগ কমিটির সদস্য মাসুমা আক্তারের সাথে। তিনি নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে তেমন কিছু জানেন না উল্লেখ করে বলেন, প্রাথমিক যাচাই-বাছাইয়ের সময় আমি ছিলাম। তারপর কি হয়েছে জানি না। এব্যাপারে সহকারী ব্যবস্থাপক সজীব কুমার ঘোষ বলেন, আমি সেই সময় নতুন ছিলাম। কতটা আবেদন পত্র জমা পড়েছে, ব্যাংক ড্রাফট এ কতটাকা জমা হয়েছে এসব হিসাব নিকাশ আমার কাছে ছিল। এর বাইরে তিনি কিছু জানেন না বলে জানান। উপ-ব্যবস্থাপক (এজিএম) আবু মোত্তালেব বলেন, আমি এই দপ্তরে নতুন। নিয়োগের বিষয়ে আমি কিছু জানি না।


বিষয়টি নিয়ে কথা বলা নেসকোর এমডি জাকিউল ইসলামের সাথে। তিনি বলেন, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন ধামাচাপা দেয়া হয়নি। আমি গত সপ্তাহে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন হাতে পেয়েছি। দীর্ঘ ৫ বছর পর তদন্ত প্রতিবেদন পেলেন কেনো জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা আমি জানি না।


শেয়ার করুন