এমনিতেই সময় মেনে চলে না ট্রেন। উনিশ থেকে কুড়ি হলেই ট্রেন দুর্ঘটনা-লাইনচ্যুতির মতো ঘটনা ঘটছে। ফলে ট্রেনের সিডিউল বিপর্যয় পদে পদেই লেগে আছে। আবার কোনো দাবি আদায় কিংবা প্রতিবাদের হাতিয়ারও হয়ে উঠছে ‘ট্রেন আটক’। চলন্ত ট্রেন দাঁড় করিয়ে পাথর নিক্ষেপসহ নানা উদ্বেগজনক ঘটনা বাড়ছেই। ‘আন্দোলনকারী’দের হামলায় কখনও ট্রেনের সারি সারি জানালা ভাঙা হচ্ছে। এতে সাধারণ যাত্রীরা গুরুতর আহত হচ্ছেন।
এমন অবস্থায় নিরুপায় হয়ে পড়ছেন রেলওয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নানা কৌশলে আন্দোলনকারীদের বুঝিয়ে, প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছেন।
এদিকে ট্রেন আটকের ঘটনায় প্রায়ই সাধারণ যাত্রীরা রক্তাক্ত জখম হচ্ছেন। ফলে যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হচ্ছে।
অভিযোগ, রেলওয়ে শ্রমিক সংগঠন, বিভিন্ন দপ্তরের লোকজন ও বেসরকারি খাতের শ্রমিকরা একের পর এক রেলপথ অবরোধ, ট্রেন আটক ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটাচ্ছেন। বকেয়া বেতন আদায়ের লক্ষ্যে মঙ্গলবার দুপুরেও রাজধানীর কারওয়ানবাজারে ট্রেন আটকে অবরোধ করেন শ্রমিকরা।
এ প্রসঙ্গে রেলওয়ে পুলিশ প্রধান ও বাংলাদেশ পুলিশের অতিরিক্ত আইজি সরদার তমিজ উদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, রেলপথে যাত্রী সেবা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রেলপুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা দিন-রাত দায়িত্ব পালন করছেন। একই সঙ্গে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন- ট্রেন আটক করে, ঢিল নিক্ষেপ করে দাবি আদায় কিংবা প্রতিবাদ জানানো কোনো পন্থা হতে পারে না। চলন্ত ট্রেন দাঁড় করিয়ে, ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের মতো ঘটনা ঘটেছে। আমরা তা প্রতিরোধে ব্যবস্থা গ্রহণ করছি। তবে যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমরা কঠোর অবস্থানে যাচ্ছি।
একই সঙ্গে আন্দোলনকারীদের পক্ষ হয়ে রেলপথ মন্ত্রণালয় ও রেল বিভাগের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথাও বলছি। রেলওয়ে শ্রমিক সংগঠনগুলোর প্রতি আহ্বান জানানো হচ্ছে- রেলপথ অবরোধ ও ট্রেন আটক করে পাথর নিক্ষেপ, ভাঙচুরের মতো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকার। অপরাধীদের শনাক্ত করা হচ্ছে বলেও জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা।
রেলওয়ের শ্রমিক সংগঠন, বিভিন্ন দপ্তর ও ব্যক্তি পর্যায়ে ব্যানার নিয়ে কখনও বকেয়া বেতন, মাইলেজ, চাকরি স্থায়ীকরণ, ট্রেন বিরতি, শূন্যপদের বিপরীতে নিয়োগসহ কর্মবিরতির মতো আন্দোলন হয়েছে। গত ৬ মাসে এসব দাবিতে ঢাকাসহ সারা দেশে ১৯ বার রেলপথ অবরোধ, ট্রেন আটক, ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।
এতে রেলপথ ও ট্রেন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি যাত্রীরা আহত হয়েছেন। মঙ্গলবার সকালে কারওয়ানবাজারে রেলপথ অবরোধ করে শ্রমিকরা। এতে সকাল ১০টা থেকে ঢাকার সঙ্গে সারা দেশের ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ হয়ে পড়ে। দুপুর দেড়টার পর ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হলেও সিডিউল বিপর্যয় চরমে উঠে। কমলাপুর, বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনসহ বিভিন্ন স্টেশনে ট্রেন আটকা পড়ে। যাত্রীদের মধ্যে চরম অসন্তোষ বিরাজ করে।
এ প্রসঙ্গে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার আনোয়ার হোসেন যুগান্তরকে বলেন, সঠিক সময়ে ট্রেন চালানোর শত চেষ্টা থাকলেও কয়েকদিন পর পর রেলপথ অবরোধ, ট্রেন আটকে দেওয়াসহ ভাঙচুরের ঘটনায় সিডিউল ঠিক রাখা সম্ভব হয় না। আমরা শত চেষ্টা করলেও সিডিউল বিপর্যয়ের মতো ঘটনা ঘটছে। একটি ট্রেনের সিডিউল বিপর্যয় ঘটলে বাকি ট্রেনগুলোর সিডিউল বিপর্যয় ঘটে। চরম দুর্ভোগে পড়েন যাত্রীরা। আন্দোলনকারীরা চলন্ত ট্রেন ও যাত্রীদের জিম্মি করে দাবি আদায়ের যে কৌশল অবলম্বন করছে তা ঠিক নয়।
রেলওয়ের অস্থায়ী (টিএলআর) শ্রমিকদের ভাষ্য, তারা প্রাত্যহিক কাজের ভিত্তিতে মজুরি পান। তারা রেলের কর্মচারী নন। রেলওয়ের বিভিন্ন দফতরের পোর্টার, গেটকিপার (ট্রাফিক/ইঞ্জিনিয়ারিং), খালাসি, ওয়েম্যান, অফিস সহকারী, ওয়েটিং রুম কেয়ারটেকারসহ বিভিন্ন পদে দীর্ঘদিন ধরে কর্মরত রয়েছেন। তাদের দাবি ৫ মাসের বকেয়া বেতন দেওয়া হচ্ছে না। নানা সময় প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। দ্রুত সময়ের মধ্যে দাবি বাস্তবায়িত না হলে আগামীতে আরও বড় ধরনের রেলপথ অবরোধ ও ট্রেন আটকের হুমকি দেন তারা।
এদিকে ট্রেন পরিচালনায় চালক, গার্ডসহ সংশ্লিষ্টরা যথাযথ মাইলেজ প্রদানের দাবি জানিয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। এ নিয়ে গত ৬ মাসে অন্তত ১১ বার রেলপথ অবরোধ, ট্রেন আটকসহ কর্মবিরতির মতো কর্মসূচি পালন করেছেন। অস্থায়ী গেটকিপারদের স্থায়ীকরণেও আন্দোলন চলছে। দাবি আদায়ে শ্রমিকরা শুধু রেলপথ অবরোধ, ট্রেন আটকের ঘটনাই ঘটাচ্ছে না, বিভিন্ন স্টেশন, রেলপথ মন্ত্রণালয়ও ঘেরাও করছে।
এ প্রসঙ্গে রেলওয়ে শ্রমিক দলের (কেন্দ্রীয় কমিটি) সাধারণ সম্পাদক এমআর মনজুর যুগান্তরকে বলেন, রেলে দিনের পর দিন এমন অন্দোলন হয়ে আসছে। প্রকৃতপক্ষে এমন আন্দোলন নিশ্চয় অপরাধের সামিল। আমরা আন্দোলনের পক্ষে থেকে দাবি আদায়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে যাচ্ছি। কিন্তু, দাবি আদায়ে চলন্ত ট্রেন দাঁড় করিয়ে ভাঙচুর, রেলপথ অবরোধ কিংবা রেলওয়ে স্টেশন, রেলপথ মন্ত্রণালয় ঘেরাওয়ের পক্ষে নই। আমরা মনে করি ট্রেন পরিচালনা, যাত্রী সেবা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিতে শ্রমিকরা যথাযথ দায়িত্ব পালন করবে। ট্রেন যাত্রী, চলন্ত ট্রেন জিম্মি করে এমন আন্দোলনের পক্ষে আমরা নই। আমরা তাদের আহ্বান জানাই-যে কোনো দাবি আদায়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়াই সঠিক পন্থা।
রেলওয়ে পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, এসব ঘটনায় শুধু রেলওয়ে শ্রমিক নয়, বাইরের শ্রমিকরাও লিপ্ত। রিকশা কিংবা ভ্যানচালক শ্রমিকরা যত্রতত্র রেলপথ অবরোধ, ট্রেন আটক ও ভাঙচুরের মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে।
রেলওয়ে রোলিংস্টক দপ্তর সূত্র বলছে, ট্রেন আটকের ঘটনায় যাত্রীবাহী ট্রেনের ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। গত ৬ মাসে যেসব ট্রেন আটক করে ভাঙচুর করা হয়েছে- তাতে প্রায় দুই শতাধিক জানালার কাচ ভেঙে ফেলা হয়েছে। এসব কাচ দেশে পাওয়া যায় না। অনেক কোচ এখনও মেরামত করা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বেশ কয়েকটি ট্রেন কম কোচ নিয়ে চলাচল করছে। এসব গ্লাস বিদেশ থেকে আনতে হয়-সময়ও বেশ লাগে। তাছাড়া ট্রেনের সাধারণ যাত্রীদের সঙ্গে ট্রেনচালক, গার্ডসহ সংশ্লিষ্টরাও আতঙ্কে থাকেন।
রেলওয়ে মহাপরিচালক মো. আফজাল হোসেন যুগান্তরকে বলেন, দাবি আদায়ের হাতিয়ার এমন হতে পারে না। আমরা শ্রমিকদের দাবি আদায়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। এক এক করে তাদের দাবিগুলো আদায় করা হচ্ছে। রেলওয়ে শ্রমিক ছাড়া বাইরের শ্রমিকরাও এমনটা করছে। কোনো সুস্থ মানুষ ট্রেন লক্ষ্য করে পাথর ছুড়তে পারে না। ট্রেন যাত্রী তথা সাধারণ মানুষকে এর প্রতিবাদ জানাতে হবে।
শ্রমিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, এমন বিক্ষোভ, প্রতিরোধে দাবি আদায়ের বিষয়টি ক্ষীণ হয় বরং আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান দ্রুত হয়।