বিনোদনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম সিনেমা। আর সিনেমা প্রদর্শনের প্রধান মাধ্যম সিনেমা হল। এক সময় শুধু উৎসব নয়, সারা বছর সপরিবারে সিনেমা হলে যেতেন দর্শক। পারিবারিক সামাজিক সিনেমাগুলো পরিবারের সবাই মিলে আনন্দঘন পরিবেশে উপভোগ করতেন। তখন দর্শকের চাপে টিকিট সংকট দেখা যেত, সিনেমা হলের সামনে ঝুলত ‘হাউজফুল’ লেখা সাইনবোর্ড। এসব এখন শুধুই অতীত। বর্তমানে সিনেমার করুণ দশা। ভালো সিনেমার অভাবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সিনেমা হল। মূলত শূন্য দশকের প্রথম দিক থেকেই সিনেমা ব্যবসায় ধস নামে। এরপর থেকেই একের পর এক বন্ধ হতে থাকে সিনেমা হল।
১৯৫৬ সালে এদেশে প্রথম সবাক সিনেমা ‘মুখ ও মুখোশ’ মুক্তি পেলে সিনেমা হলের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। সিনেমায় এক নতুন জোয়ার আসে। কিন্তু শূন্য দশকের শুরুর দিকে সিনেমায় অশ্লীলতা জেঁকে বসলে তা দর্শককে হলবিমুখ করে তোলে। সেই জায়গা থেকে আজও সিনেমাশিল্প ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। বর্তমানে অশ্লীলতা দূর হলেও মানসম্মত ও পর্যাপ্ত সিনেমার অভাবে ক্রমান্বয়ে সিনেমা হল বন্ধ ঠেকানো যাচ্ছে না। ১৪৭০টি সিনেমা হল থেকে কমে এখন ৬০টিতে এসে ঠেকেছে। ঈদ উৎসবে এর সংখ্যা বেড়ে ১০০ থেকে ১৫০টি হয়। সাময়িকভাবে কিছু সিনেমা হল তখন খোলা হয়। ঈদপরবর্তী সেগুলো আবারও বন্ধ হয়ে যায়।
রাজধানীতে গত কয়েক বছরে বন্ধ হয়েছে অনেক সিনেমা হল। সর্বশেষ ২০১৯ সালে ১২ অক্টোবর বন্ধ হয়ে যায় কাকরাইলের ‘রাজমণি’। এদিকে মানসম্মত সিনেমার অভাবে রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী ‘মধুমিতা’ সিনেমা হলটিও দীর্ঘদিন ধরেই বন্ধ রয়েছে। এর আগেও বেশ কয়েকবার সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছিল। হলটির কর্ণধার ও চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সাবেক সভাপতি ও প্রযোজক ইফতেখার নওশাদ বলেন, ‘নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকেই বন্ধ রেখেছি। এ মুহূর্তে খোলার আর কোনো ইচ্ছাও নেই। সিনেমার ব্যবসা একেবারেই এখন নেই। এ ছাড়া ভালো সিনেমাও নেই যে, আমরা আশা নিয়ে থাকব। দিনের পর দিন লোকসান গুনতে হচ্ছে। নভেম্বরের পর যে কটি সিনেমা মুক্তি পেয়েছে, সেগুলো সিনেপ্লেক্সেই ব্যবসা করতে পারেনি। আমার সিনেমা হলে চালালে, এসব দিয়ে বিদ্যুৎ বিলও উঠবে না। এ কারণেই আমার হলটি বন্ধ রাখাটাই ঠিক বলে মনে করেছি।’ তিনি আরও বলেন, “দেশের ভালো সিনেমা নেই। তাই ‘পুষ্পা-২’ (ভারতীয় সিনেমা) নিয়ে আশাবাদী ছিলাম যে, এটি আমার এখানে চালাব। একসঙ্গে মুক্তি দিতে পারলে সিনেমাটি ভালো চলত। কিন্তু আমাদের দেশে মুক্তি আটকে দেওয়াতে সেটিও আর হলো না। এখন ঈদের আগে আর ব্যবসা করার সম্ভাবনা নেই। তিনি জানান, ২৪ জানুয়ারি একটি সিনেমা মুক্তি পাবে। এর পরিচালক হল ভাড়া নেওয়ার জন্য তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। চূড়ান্ত হলে কয়েক দিন মধুমিতা সিনেমা হলটি খোলা থাকবে। না হলে মধুমিতা হল বন্ধই থাকবে।”
এদিকে ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত রাজধানীর হাজার আসনের সিনেমা হল ‘অভিসার’ও বন্ধ হয়ে গেছে। এদিকে বন্ধ হওয়ার পথে ১৯২৬ সালে প্রতিষ্ঠিত রাজধানীর পুরোনো ও স্বনামধন্য সিনেমা হল আজাদ। ঢাকার বাইরেও এমন অনেক বড় সিনেমা হলও বন্ধ হয়ে গেছে। যেখানে বছরজুড়েই থাকত সিনেমাপ্রেমী দর্শকদের ঢল।
চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মিয়া আলাউদ্দিনের দেওয়া তথ্য থেকে জানা গেছে, দেশের প্রায় ২৯টি জেলা এখন সিনেমা হলশূন্য। ইতোমধ্যেই দেশের প্রধান যে সিনেমা হলগুলো বন্ধ হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে ঢাকার গুলিস্তান, বিউটি, রূপমহল, নাজ, শাবিস্তান, মল্লিকা, পূরবী, স্টার, সুরমা, লায়ন, যমুনা, অভিসার, আগমন, ডায়না, জোনাকি, চিত্রামহল, অতিথি, মানসী, পূর্ণিমা, রাজমণি, পদ্মা, মুন’সহ আরও অনেক। ঢাকার মোট সিনেমা হলের সংখ্যা ছিল ৪৪টি। এর মধ্যে বড় সিনেমা হলগুলোর মধ্যে হাতেগোনা কয়েকটি চালু আছে। ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় একাধিক সিনেমা হলের মধ্যে একটি করে চালু আছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিনেমা হল টিকিয়ে রাখতে দরকার কনটেন্ট। কিন্তু সেটা নেই। যেসব সিনেমা নির্মিত হচ্ছে তাও মানসম্মত নয়। বর্তমানে যেকটি সিনেমা হল চালু আছে, তাতে এক কোটি টাকা খরচ করে সিনেমা বানালেও লগ্নিকৃত অর্থ তুলে আনা সম্ভব নয়। ফলে স্বল্প বাজেটে যেনতেনভাবে সিনেমা নির্মাণ করতে গিয়ে মানসম্মত হচ্ছে না। ফলে দর্শক হারাচ্ছে। আর তাতে সিনেমা বন্ধের ধারাবাহিকতা চলছেই।