১০ মার্চ ২০২৫, সোমবার, ০২:২০:৫৯ অপরাহ্ন
যেভাবে মালখানা থেকে ইয়াবা সরিয়ে বিক্রি করতেন এসপি রহমত
  • আপডেট করা হয়েছে : ১০-০৩-২০২৫
যেভাবে মালখানা থেকে ইয়াবা সরিয়ে বিক্রি করতেন এসপি রহমত

গত বছরের ৮ সেপ্টেম্বর এসপি রহমত উল্লাহ কক্সবাজার জেলা পুলিশের দায়িত্ব নেন। অল্পসময়ের মধ্যেই তিনি থানাগুলোর ওসি ও মালখানার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের সরিয়ে নিজের বিশ্বস্ত লোকদের বসান। 


এরপরই শুরু হয় মূল অপকর্ম। বিশেষ করে টেকনাফ থানার মালখানা ও জেলা পুলিশের প্রধান মালখানা থেকে বিপুল পরিমাণ ইয়াবা সরানোর তথ্য পাওয়া গেছে। ম্যাজিস্ট্রেটের নজর এড়াতে ধ্বংসের পর বেঁচে যাওয়া নষ্ট ও নকল ইয়াবা কৌশলে মালখানায় রাখা হতো, যাতে ওজনে কোনো পার্থক্য না হয়।


কক্সবাজার জেলা পুলিশের সদ্য সাবেক এসপি রহমত উল্লাহ শুধু জব্দ করা ইয়াবা নয়ছয় করেননি, থানার মালখানায় রাখা ইয়াবাও গোপনে বিক্রি করেছেন। এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে যুগান্তরের অনুসন্ধানে। 


অভিযোগ রয়েছে, তিনি নিজের ঘনিষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তাদের দিয়ে থানার মালখানার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আসল ইয়াবা সরিয়ে সেখানে নকল ও নষ্ট ইয়াবা রাখতেন। পরে সেই ইয়াবা গোপনে মাদক কারবারিদের কাছে বিক্রি করা হতো।


প্রত্যক্ষদর্শী পুলিশ কর্মকর্তাদের বয়ানেও উঠে এসেছে এই চাঞ্চল্যকর তথ্য, যা নিয়ে পুলিশের ভেতরেও অস্বস্তি দেখা দিয়েছে। ইয়াবা সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কঠোর হতে চাওয়ায় ডিএসবির ডিআইও-১ মিজানুর রহমানকে মাত্র তিন মাসের মধ্যে বদলি করেন এসপি রহমত। অথচ তার পোস্টিং আদেশে দুই বছর আগে বদলি না করার নির্দেশনা ছিল। 


পুলিশের সোর্স ও প্রত্যক্ষদর্শী (ছদ্মনাম : নুরুল আলম) যুগান্তরকে জানান, প্রতি সপ্তাহে, বিশেষ করে মঙ্গলবার (যেদিন ইয়াবা ধ্বংস করা হয়) মালখানা থেকে আসল ইয়াবা সরানো হতো। মালখানার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সাজ্জাদ নামে এক ব্যক্তির মাধ্যমে এগুলো শহরের সমিতিপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় মাদক কারবারিদের কাছে বিক্রি করতেন।


পুলিশ সূত্র জানায়, টেকনাফ থানায় সবচেয়ে বেশি ইয়াবা জব্দ হয়। এসপি রহমত উল্লাহ বিতর্কিত সাবেক ডিবি ওসি গিয়াস উদ্দিনকে শর্তসাপেক্ষে টেকনাফ থানার ওসি হিসাবে নিয়োগ দেন। একইভাবে থানার মালখানার দায়িত্ব দেওয়া হয় এসআই ননি বড়ুয়াকে এবং জেলা পুলিশের প্রধান মালখানার দায়িত্ব দেওয়া হয় এসআই মিঠুন পালিতকে, যারা এসপি রহমতের ঘনিষ্ঠ হিসাবে পরিচিত।


অনুসন্ধানে জানা যায়, এসপি রহমতের নির্দেশে টেকনাফ থানার মালখানা থেকে কোর্ট মালখানায় ইয়াবা নেওয়ার সময়ই আসল ইয়াবাগুলো সরিয়ে ফেলা হতো। এরপর ধ্বংসের পর বেঁচে যাওয়া নষ্ট ও নকল ইয়াবা কোর্ট মালখানায় পাঠানো হতো। এসআই ননি বড়ুয়া ও এসআই মিঠুন পালিত মিলে এই কারসাজি বাস্তবায়ন করতেন। পরে এসব ইয়াবা পুলিশের ঘনিষ্ঠ মাদক কারবারিদের কাছে বিক্রি করা হতো।


অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করে জেলা পুলিশের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা যুগান্তরের কাছে এসপি রহমতের ইয়াবা সিন্ডিকেট থেকে পুলিশবাহিনীকে রক্ষায় আকুতি জানিয়েছেন।


পুলিশ সূত্রের দাবি, গত তিন মাসে এভাবে লাখ লাখ ইয়াবা সরিয়ে কারবারিদের কাছে বিক্রি করা হয়েছে। ম্যাজিস্ট্রেটদের নজরদারির দায়িত্ব পালন করতেন এনামুল নামে একজন কনস্টেবল। যদিও তার পোস্টিং কোর্টে, তবুও ছুটি না নিয়েই প্রতি বৃহস্পতিবার বা শুক্রবার রাতে নিয়মিত টেকনাফে গিয়ে ইয়াবা সরানোর গোপন বার্তা পৌঁছে দিতেন।


১৭ ফেব্রুয়ারি যুগান্তরে ‘মিলেমিশে সাড়ে ৩ লাখ পিস বিক্রি : এসপির ইয়াবা কারবার’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হলে দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এরপর এসপি রহমত উল্লাহসহ ৮ জনকে প্রত্যাহার করা হয়। দেশের শীর্ষ দুটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে এসপি রহমতের ইয়াবা বাণিজ্যের প্রমাণ। অভিযোগ থেকে বাঁচতে তিনি বিএনপির কয়েকজন শীর্ষ নেতার আশ্রয় নিয়েছেন বলেও গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। দুটি গোয়েন্দা সংস্থার মাঠ পর্যায়ের এবং শীর্ষ কর্মকর্তারা এ তথ্য যুগান্তরকে নিশ্চিত করেছেন।


এ বিষয়ে জানতে চাইলে কোর্ট পুলিশের ওসি গোলাম জিলানী বলেন, তিন মাস ধরে এসআই মিঠুন পালিত মালখানার দায়িত্বে ছিলেন। তার কাছেই মালখানার চাবি থাকে। তাই কোনো ইয়াবা কেলেঙ্কারির দায় আমি নেব না। এসব ঘটনায় আমি জড়িত নই।


গত তিন মাসের মালখানার সিসিটিভি ফুটেজ পাওয়া যাবে কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, এসব ফুটেজ সংরক্ষণ করা হয়নি। সাধারণত কোনো বড় ধরনের দৃশ্যমান অঘটন না ঘটলে ফুটেজ রাখা হয় না।


ওসি গোলাম জিলানী আরও বলেন, এর আগেও মালখানা থেকে ইয়াবা বিক্রির অভিযোগ উঠেছিল। এসআই রাশেদ নামে এক কর্মকর্তা এসআই মিঠুন পালিতের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন।


এদিকে যুগান্তরের অনুসন্ধানের পর জেলা পুলিশের প্রধান মালখানার ইনচার্জ এসআই মিঠুন পালিতকে প্রত্যাহার করে জেলা পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করা হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে এসআই মিঠুন পালিত সব অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, আমি কোনো ইয়াবা বিক্রির সঙ্গে জড়িত নই। তারপরও আমাকে অপবাদ দিয়ে পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করা হয়েছে।


এ বিষয়ে টেকনাফ থানার ওসি গিয়াস উদ্দিন বলেন, মালখানার দায়িত্ব এসআই ননি বড়ুয়ার। ইয়াবা সরানোর কোনো ঘটনা ঘটলে তিনি বলতে পারবেন। তবে আমার জানামতে, এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। একাধিকবার চেষ্টা করেও টেকনাফ থানার মালখানার ইনচার্জ এসআই ননি বড়ুয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।


শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তার আরও ভয়াবহ বর্ণনা : জেলা পুলিশের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, জানুয়ারির প্রথমদিকে সংশ্লিষ্ট একজন পুলিশ পরিদর্শককে ডেকে দীর্ঘদিন ধরে মালখানায় পড়ে থাকা ইয়াবা ‘নষ্ট হয়ে যাচ্ছে’-এমন অজুহাতে বিকল্প ব্যবস্থার পরিকল্পনার কথা জানান এসপি রহমত উল্লাহ। পুলিশ পরিদর্শককে তিনি বলেন, আমি চেঞ্জ করে নতুন ইয়াবার ব্যবস্থা করব, তুমি এখান থেকে পুরোনো ইয়াবাগুলো বের করো। একজন লোক যাবে, তাকে ইয়াবাগুলো বুঝিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করো তুমি।


কিন্তু পরিদর্শক ইয়াবা সরাতে অস্বীকৃতি জানালে এসপি তাকে ধমক দেন ও ভয় দেখান। আতঙ্কিত পরিদর্শক এরপর জেলার এক শীর্ষ কর্মকর্তার কাছে গিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে পুরো ঘটনাটি জানান। পরে ওই শীর্ষ কর্মকর্তা একজন বিচারকের শরণাপন্ন হন এবং তার অনুরোধে বিপুল পরিমাণ ইয়াবা ধ্বংসের আদেশ বের করিয়ে তা ধ্বংস করা হয়। এছাড়াও সাত বস্তা ইয়াবা কঠোর নজরদারিতে রাখা হয়। যদিও এর আগে বিপুল পরিমাণ ইয়াবা সরিয়ে বিক্রি করা হয়েছে।


ঘটনার পুরো বর্ণনা তুলে ধরে জেলা পুলিশের ওই শীর্ষ কর্মকর্তা যুগান্তর প্রতিবেদকের কাছে এসপি রহমতের ইয়াবা সিন্ডিকেট থেকে পুলিশবাহিনীকে রক্ষার আকুতি জানান। প্রথমে তিনি নাম প্রকাশ করে বক্তব্য দেওয়ার সাহস দেখালেও পরে ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে পরামর্শ করে নাম গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি বলেন, ভাই, পুলিশবাহিনীকে মাদকের এই চক্র থেকে বাঁচান। আমি আপনার কাছে, যুগান্তরের কাছে দুই হাত জোড় করে মিনতি করছি-পুলিশবাহিনীটাকে বাঁচান। আপনাদের কলম, লেখনী অনেক কিছু করতে পারে, যেটা আমরা পারি না।


এদিকে রাষ্ট্রীয় দুটি গোয়েন্দা সংস্থা যুগান্তরে প্রকাশিত এসপি রহমত উল্লাহর ইয়াবা কেলেঙ্কারির বিষয়ে বারবার প্রমাণ পেয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সংস্থা দুটির মাঠ ও শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা। একই সঙ্গে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো জানিয়েছে, মালখানা থেকে বিপুল পরিমাণ ইয়াবা বিক্রির তথ্যও তারা পেয়েছে। ইতোমধ্যে সংস্থা দুটির হেডকোয়ার্টারে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে এবং জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।


ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর নির্বাহী পরিচালক ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামান মনে করেন, মাদক কারবারে জড়িত পুলিশের বিরুদ্ধে দায়সারা ব্যবস্থা নেওয়ার ফলে বারবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। 


তিনি বলেন, একটা প্রথা তৈরি হয়েছে-মাদক কারবারের মতো গুরুতর অপরাধে পুলিশের কেউ জড়িত হলে তাকে কেবল প্রত্যাহার করা হয় বা বিভাগীয় মামলা করে দায় এড়ানো হয়। এ কারণে অপরাধীরা বারবার সুযোগ নিচ্ছে। 


এদিকে মালখানা থেকে ইয়াবা সরিয়ে বিক্রির বিষয়টি চট্টগ্রাম ডিআইজি, পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এবং স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার নজরে আনা হয়েছে। তারা জানিয়েছেন, বিষয়টি তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


শেয়ার করুন