অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, চট্টগ্রাম বন্দর হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড। হৃৎপিণ্ড দুর্বল হলে ডাক্তার, বৈদ্য, সবকিছু আনো; মেরামত হবে, কিন্তু চলবে না। ছোট্ট একটি হৃৎপিণ্ড, তার মধ্যে হলো রোগাক্রান্ত, এই হৃৎপিণ্ডে যতই ঠেলাঠেলি করো, রক্ত সঞ্চালন হবে না। এটিই যদি একমত হই- বাংলাদেশের অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড হলো চট্টগ্রাম বন্দর, তাহলে যে সাইজের হৃৎপিণ্ড আছে, ওই সাইজে চলে না। এই হৃৎপিণ্ড বিশ্ব সাইজের হৃৎপিণ্ড হতে হবে। তাই এই বন্দরের চিকিৎসা দরকার।
বৃহস্পতিবার (১৫ মে) বিকালে প্রধান উপদেষ্টার ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্ট চীফ অ্যাডভাইজার (জিওবি) থেকে দেওয়া পোস্টে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
পোস্টে বিবৃবিতে বলা হয়, গতকাল বুধবার প্রধান উপদেষ্টা তার চট্টগ্রাম সফরকালে চট্টগ্রাম বন্দর পরিদর্শন করেন। সেখানে এক বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘মাঝেমাঝে প্রশ্ন শুনি যে, বন্দর বিদেশিদের দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আপনারা ভারতে স্বাস্থ্যসেবার জন্য যান না? যখন বন্ধ করে দিয়েছে, তখন দলে দলে হাহাকার করেছেন; কেন বন্ধ করে দিলো। কারণ হচ্ছে, আমাদের এখানে ভালো স্বাস্থ্যসেবা নাই। খবরের কাগজে আমরা দেখি নেতারা সিঙ্গাপুর, ব্যাংককে চিকিৎসার জন্য যাচ্ছে। অথচ বন্দরে কেউ আসতে পারবে না।
তিনি বলেন, ‘যাদের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করেছি তারা পৃথিবীর সেরা। তারা দুনিয়াতে শত শত পোর্ট পরিচালনা করে। যেকোনো বন্দরে যান, তাদের মার্কা দেখবেন। তারা যখন বন্দরের দায়িত্ব নেবে, তারা আমাদের মতো করে বানাবে না। কারণ তাদেরকে রোজগার করে টাকাটা ওঠাতে হবে। সেজন্য তারা সেরা প্রযুক্তি দিয়ে এটাকে বানাবে। তারা আগে যত বন্দর-টার্মিনাল বানিয়েছে, সে অভিজ্ঞতা তারা এখানে কাজে লাগাবে। মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর আমাদের বন্দর আমাদের মতো করে আমরা চালাব। এতে করে আমাদের টাকা লাগল না, তাদের অভিজ্ঞতা দিয়ে শুরু হলো এবং প্রযুক্তির উচ্চতম জায়গা থেকে শুরু করলাম।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘অনেকে বললো, আমাদের চাকরি চলে যাবে? কিন্তু ওরা যে আসছে, ওরা কি নিজেদের দেশ থেকে লোক নিয়ে আসবে? ওরা তো আমাদের এখান থেকেই লোক নিয়ে যায়, ওদের কাজের জন্য। এই বন্দর চালাতে হলে আমাদের লোকই তো চালাবে। কারণ আমাদের লোককে শিখিয়ে দিলে খুব সহজেই তারা শিখে যায়। তাদের লাভ, খরচ কম। ইউরোপ থেকে শ্রমিক এনে আমাদের এখানে চালাতে হলে ওদের ব্যবসা লাটে উঠবে। এখানকার মানুষ দিয়েই চালাতে হবে, যদি চালাতে হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, যদি ৩১ সালের মধ্যে আমরা বন্দরের কাজ শিখে ফেলি- এর পরবর্তী ৫ বছরে অর্থাৎ ৩৬ সালের মধ্যে পৃথিবীর যত দেশে যত বন্দর এই কোম্পানিগুলো চালায়, তাদের বহু বন্দর এই বাংলাদেশিরাই পরিচালনা করবে। আপনারা যে বন্দরেই পা দেবেন, দেখবেন বাংলাদেশিরা আছে। চাকরি কমবে না, চাকরি বাড়বে। তাদের নিজেদের প্রয়োজনেই আমাদের নেবে। দরখাস্ত নিয়ে আমাদের যেতে হবে না, তারা আমাদের সাধবে যে ‘তুমি এখানে কাজ করেছো। তোমাকে অমুক জায়গায় পাঠাতে চাই। পরিবারসহ তুমি চলো, সেখানে কাজ করো’। আগে আমরা যেকোনো জাহাজে চড়লে দেখতাম জাহাজের নাবিক চট্টগ্রামের, সিলেটের। এরপর থেকে আমরা যে বন্দরে যাব দেখব চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশাল- বাংলাদেশের লোক।’
চট্টগ্রাম বন্দরের চারটি টার্মিনাল বিদেশি অপারেটরদের দিয়ে পরিচালনার প্রক্রিয়া চলছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়। এর মধ্যে লালদিয়ার চর ও বে টার্মিনালে অবকাঠামো ও যন্ত্রপাতি খাতে পুরো বিনিয়োগ করতে হবে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোকে। তবে নিউমুরিং টার্মিনালে পুরোদমে চালু থাকায় এই টার্মিনাল বিদেশিদের হাতে ছেড়ে দেওয়া নিয়ে স্থানীয় শ্রমিক ও অপারেটররা আপত্তি জানিয়ে আসছিলেন।
গত বুধবার সকাল ১০টার দিকে চট্টগ্রাম বন্দরে নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালের (এনসিটি) ইয়ার্ড-৫ পরিদর্শনে বিদেশি অপারেটরদের পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়ার প্রসঙ্গটি টেনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমি সাখাওয়াতকে (নৌপরিবহন উপদেষ্টা) বলেছি, আমি আর শুনতে চাই না, অমুক তারিখের মধ্যে সব দিয়ে দিতে হবে। যারা বন্দরের ব্যবস্থাপনায় অভিজ্ঞ, পৃথিবীর সেরা যারা, তাদের দিয়ে এই কাজ করাতে হবে, যেভাবেই হোক। মানুষ যদি রাজি না হয়, জোরাজুরি নয়, রাজি করিয়েই করতে হবে। কারণ, এটা এমন এক বিষয়, পুরো জিনিস শুনলে রাজি না হওয়ার কোনো কারণ নেই।