মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা রাজশাহী অঞ্চলের উপপরিচালক (কলেজ) মাহাবুবুর রহমান শাহ’র বিরুদ্ধে কলেজ শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিও’র ফাইল আটকিয়ে ঘুষ বাণিজ্যের ব্যাপক অভিযোগ উঠেছে।
এমপিও আবেদন ফাইল ছাড় করানোর নাম করে লাখ লাখ টাকা বাণিজ্য করে চলেছেন তিনি। এমনকি কখনো কখনো ওই কর্যালয়ের কর্মকর্তাদের নাম ভাঙিয়েও অর্থ আদায় করেছেন তিনি। এই ধরনের একটি অডিও রেকর্ড হাতে এসে পৌঁছেছে।
বাঘার পাকা কলেজের মকবুল নামের একজন শিক্ষককে তাঁর ভাগ্নি কামরুন্নাহারের এমপিও ছাড়করণের জন্য ফোন করেছিলেন রাজশাহী অঞ্চলের উপপরিচালক (কলেজ) মাহাবুবুর রহমান শাহকে। এসময় মাহাবুবুর রহমান শাহ বলেন, ‘আমি তো ওই ফাইল ছেড়ে দিবো। কিন্তু আপনি তো পরিচালক-সহকারী পরিচালক সম্পর্কে জানেন সবি। উত্তরে শিক্ষক মকবুল হোসেন বলেন, জ্বি জ্বি। এর পর মাহাবুবুর রহমান শাহ’ বলেন, ‘তো তারা এমনি এমনি কাজ করতে চাই না। এইটা মূল সমস্যা। এর জন্য আপনাকে সেক্রিফাইসড করতে হবে। ওটা করলেই কাজটা হয়ে যাবে। জবাবে শিক্ষক মকবুল হোসেন বলেন জ্বি স্যার।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এভাবে নাম ভাঙ্গিয়ে বা কখনো নিজের ক্ষমতাবলে গত ১০ মাসেই রাজশাহী বিভাগের আটটি জেলার শতাধিক কলেজ শিক্ষক-কর্মচারীর এমপিও’র আবেদন ফাইল আটকিয়ে অন্তত অর্ধ কোটি টাকা বাণিজ্য করেছেন উপপরিচালক (কলেজ) মাহাবুবুর রহমান শাহ।
এর মধ্যে পাবনা জেলার ঈশ্বরর্দী উপজেলার বাঁশেরবাদা মহাবিদ্যালয়ের সাত শিক্ষকের নিকট থেকেই আদায় করা হয়েছে অন্তত সাত লাখ টাকা। ওই শিক্ষকরা একযোগে টাকা তুলে সেগুলো মাহাবুবুর রহমান শাহ’র কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেন বলেও একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। এমনকি নিজের ইচ্ছামতো অফিসে যাতায়াত করেন উপপরিচালক। এসব নিয়েও তাঁকে শোকজড করা হয়।
তাঁদের মধ্যে একজন শিক্ষক বলেন, টাকা নিয়ে একদিনেই সাত ফাইল ছাড় করেছেন উপপরিচালক। সমস্ত কাগজপত্র ঠিক ঠাকার পরেও তাঁকে টাকা দিতে হয়েছে।’
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, রাজশাহী বিভাগের আট জেলার কলেজ শিক্ষক- কর্মচারীদের এমপিও’র জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা রাজশাহী অঞ্চলের তিনজন কর্মকর্তাকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাঁরা তিনজনই আলাদা আলাদাভাবে শিক্ষকদের ফাইল যাচাই-বাছাই করে অনলাইনে আর্কাইভসের মাধ্যমে অনুমোদন দিয়ে ঢাকার মহারপরিচালকের দপ্তরে পাঠান। এর পর সেটিকে অনুমোদন দেওয়া হয়। এটি করতে গিয়েই রাজশাহী উপপরিচালক মাহাবুবুর রহমান শাহ ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন।
শিক্ষকদের এমপিওর আবেদন ফাইল প্রথমে সংশ্লিষ্ট কলেজ অধ্যক্ষ মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা রাজশাহী অঞ্চলের পরিচালক অধ্যাপক ডক্টর কামাল হোসেনের কাছে অনলাইনে পাঠান। এর পর পরিচালক সেটি সহকারী পরিচালক আবু রেজা আজাদের কাছে পাঠান। তিনি সেটিকে অনুমোদন দিয়ে বা আপত্তি দিয়ে পুনরায় উপপরিচালকের কাছে পাঠান। আর সেখানে গিয়েই অদৃশ্য কারণে আটকে যায় এমপিও আবেদন ফাইল।
অভিযোগ উঠেছে, টাকা না দিলে এখান থেকে ছাড় হয় না এমপিও ফাইল। এর জন্য কখনো ২-৫ মাস পর্যন্ত পজেটিভ ফাইলও আটকে রাখেন উপপরিচালক মাহাবুবুর রহমান শাহ।
সময় মতো অফিস না করে ফাইল আটকিয়ে রাখা নিয়ে শিক্ষক- কর্মচারীদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পরিচালক কামাল হোসেন একাধিকবার শোকজও করেছেন উপপরিচালক মাহাবুবুর রহমান শাহকে। কিন্তু তার পরেও একই কাজ বন্ধ হয়নি বলে জানিয়েছেন রাজশাহী অঞ্চলের একাধিক কলেজ শিক্ষক।
নাম প্রকাশে অনচ্ছিুক রাজশাহীর দুর্গাপুর ডিগ্রি কলেজের একজন শিক্ষক বলেন, ‘আমার পাইলে কোনো ত্রুটি ছিল না। সহকারী পরিচালক আমার এমপিও আবেদন ফাইলটি পজেটিভ করে ছেড়ে দেওয়ার দুই মাস টাকার বিনিময়ে ছাড় দেন উপপরিচালক মাহাবুবুর রহমান শাহ। অথচ যে মাসে সহকারী পরিচালক ফাইল ছেড়ে দিয়েছেন, ওই মাসেই উপপরিচালককেউ অনুমোদন দিয়ে ছেড়ে দিতে হত। কিন্তু সেটি আটকিয়ে রেখে তিনি আমাকে এক মাস পিছিয়ে দিয়েছেন।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এমপিও আবেদনকারী শিক্ষকদের ডেকে এনে টাকা আদায় করে থাকেন উপপরিচালক মাহাবুবুর রহমান শাহ। এতে সহযোগিতা করেন আরেক সহকারী পরিচালক আব্দুর রহিম, সহকারী পরিদর্শক আসমত আলীসহ আরও তিন-চারজন।
এর আগে এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মাহাবুবুর রহমান শাহ’র সহযোগী বলে পরিচিত সিরাজুল হক সরকার ও মানিক চন্দ্র প্রামাণিককে বদলি করাও হয়। তবে বগুড়া জেলা অফিসে বদলি হওয়া মানিক চন্দ্র প্রামাণিক পুনরায় ফেরত আসেন রাজশাহী আঞ্চলিক কার্যালয়ে। তাঁর পুনরায় যোগদানে পরিচালক কামাল হোসেন অসম্মতি জানালেও সেটি কার্যকর হয়নি।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, অর্থের বিনিমিয়ে কোনো ত্রুটিপূর্ণ আবেদনও অনুমোদনের জন্য পরিচালককে চাপ প্রয়োগ করেন উপপরিচালক মাহাবুবুর রহমান শাহ। এসব নিয়ে পরিচালক কামাল হোসেন ত্রুটিপূর্ণ কয়েকটি ফাইল বাতিল করলে উপপরিচালক একজন সহকারী পরিচালককে ফোন করে হুমকি দিয়ে বলেন, ‘সহকারী প্রোগ্রামার ডলি রানি পাল আমার ফাইলের মাথায় ‘বারি মেরে নষ্ট করে’। এ কারণে তাঁর ফাইল অনুমোদন হচ্ছে না।’ এমন মিথ্যা অভিযোগ ছড়িয়ে ডলি রানি পালকেও ফাঁসানোর চেষ্টা করেছেন উপপরিচালক মাহাবুবুর রহমান শাহ।
তবে প্রকাশকৃত ওডিও সম্পর্কে জানতে চাইলে উপপরিচালক মাহাবুবুর রহমান শাহ বলেন, ‘আমি বলেছিলাম আমার আপত্তি নাই। পরিচালক-সহকারী পরিচালকের সঙ্গে দেখা করতে বলেছিলাম। তবে ওই ফাইল তো ছেড়ে দিয়েছি আমি।’
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘অনেক কাজ করতে হয়। করতে গিয়ে কিছু ফাইল থেকে যায়। তবে কারও নিকট থেকে অবৈধ সুবিধা নেওয়ার সুযোগ নাই। তিন-চার মাস ফাইল আটকিয়ে রাখারও সুযোগ নাই।
তবে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পাবনার সাথিয়া শহীদ নুরুল হোসনে কলেজের শিক্ষক জহিরুল ইসলামের ত্রুটিমুক্ত ফাইল গত ১৫ এপ্রিল সহকারী পরিচালক আবু রেজা আজাদ ছাড় দেওয়ার তিন মাস গত ০৭ জুলাই ছাড় অনুমোদন দেন উপপরিচালক মাহাবুবুর রহমান শেখ। ওই কলেজের আরও চারজন শিক্ষকের ফাইল একইভাবে আটকিয়ে রাখেন তিনি।
এমনকি পাবনার গুরদাসপুর কলেজের মুকুল হোসেন শেখ নামের এক শিক্ষকের পজেটিভ ফাইল ৫ মাস উপপরিচালক আটকিয়ে রেখে সেটি অনুমোদন গত ১ জুলাই। এভাবে চলতি বছরেই অন্তত শতাধিক ফাইল আটকিয়ে রাখেন তিনি। সেসব ফাইল থেকে গড়ে অন্তত ৫০ হাজার টাকা করে আদায় করেছেন উপপরিচালক মাহবুবুর রহমান শহ।
সবমিলিয়ে অন্তত অন্তত অর্ধ কোটি টাকা বাণিজ্য করা হয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে উপপরিচালক মাহবুবুর রহমান শাহ’র বিরুদ্ধে। তবে এ অভিযোগ ঠিক নয় বলেও দাবি করেন তিনি। তিনি বলেন, ফাইলে ত্রুটি থাকলে সেটি পরিচালকের সঙ্গে দেখা করে ঠিক করার পরামর্শ দেয় আমি। এর বাইরে আমি কোনো অনিয়মের সঙ্গে জড়িত নয়। আমি কারও নিকট থেকে টাকাও নেয় না। ’
জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা রাজশাহী অঞ্চলের পরিচালক ডক্টর কামাল হোসেন বলেন, ‘আমার কাছে কোনো পজেটিভ ফাইল আটকে থাকার সুযোগ নাই। উপপরিচালক যেসব ফাইল অনুমোদন করে আমার কাছে পাঠান, আমি ওইদিনই সেগুলো অনুমোদন দিয়ে ঢাকায় পাঠিয়ে দেয়। কাজেই আমার কাছে কোনো ফাইল আটকে থাকে না।’
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এমপিও ফাইল আটকিয়ে বাণিজ্যের অভিযোগ পেলে আমি আইনগত ব্যবস্থা নিব। তবে বেশকিছু কারণে উপপরিচালককে কয়েক বার শোকজড করা হয়েছিল।’