সনাতনী পদ্ধতির পরিবর্তে সৃজনশীল মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু হয়েছে প্রায় দেড় দশক আগে। কিন্তু এখনো অন্তত ৩৮ শতাংশ শিক্ষক এই পদ্ধতি আয়ত্ত করতে পারেননি। খোদ সরকারি সমীক্ষায় এ তথ্য উঠে এসেছে। গত মে মাসে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সমীক্ষাটি চালায় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। সম্প্রতি এটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দাখিল করা হয়েছে।
অন্যদিকে ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে একই ধরনের আরেক সমীক্ষায় দেখা যায়, ৫৮ দশমিক ২৭ শতাংশ শিক্ষক সৃজনশীল বিষয়ের দক্ষতা অর্জন করেছেন। বাকি ৪১ দশমিক ৭৩ শতাংশ শিক্ষক সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরি করতে পারেন না। অর্থাৎ পৌনে ৪ বছরে এ বিষয়ে দক্ষতা অর্জনের হার সাড়ে ৩ শতাংশের মতো।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সৃজনশীল মূল্যায়ন পদ্ধতি জানা ও বোঝার ক্ষেত্রে শিক্ষকদের আগ্রহের যে প্রচণ্ড অভাব আছে, এটি তারই প্রমাণ। যে কারণে এই পদ্ধতিতে প্রশ্ন করার প্রভাব পড়ছে অভ্যন্তরীণ বা পাবলিক পরীক্ষায়ও। চলতি এইচএসসি পরীক্ষায় অন্তত তিনটি শিক্ষা বোর্ডের বাংলা প্রথম পত্রের প্রশ্ন নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
এর মধ্যে একটি বোর্ডের প্রশ্নে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের অপচেষ্টা দেখা যায়। আরেকটি বোর্ডের প্রশ্নে একজন বরেণ্য সাহিত্যিককে হেয়প্রতিপন্ন করা হয়েছে। এখানেই শেষ নয়, রাজধানীর যাত্রাবাড়ী আইডিয়াল স্কুল ও কলেজে দশম শ্রেণির নির্বাচনি পরীক্ষায় জীববিজ্ঞান প্রশ্নপত্রে জনপ্রিয় খেলা ক্রিকেট নিয়ে নেতিবাচক প্রশ্ন যুক্ত করা হয়েছে। এ ঘটনায় ওই প্রতিষ্ঠানকে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড শোকজ করেছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার।
সৃজনশীল প্রশ্ন ও পদ্ধতি সম্পর্কে আলাপকালে বৃহস্পতিবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. আবু বকর ছিদ্দীক যুগান্তরকে বলেন, পদ্ধতিটি চালু করা হয়েছে ১৪ বছর আগে। অধিকাংশ শিক্ষক প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। এরপরও যে বা যারা উদ্দীপক প্রশ্নপত্র জুড়ে দিচ্ছেন তাদের কাজকে সহজভাবে দেখার উপায় নেই। দেশে ভালো ও দক্ষ শিক্ষকের অভাব নেই। যারা এ ধরনের প্রশ্ন করছেন, তাদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হবে। বিষয়টি শিক্ষা মন্ত্রণালয় আলাদা তদন্ত করবে।
২০০৮ সালে নবম শ্রেণিতে এই পদ্ধতিটি চালু হয়। আর ২০১০ সালের এসএসসি পরীক্ষায় প্রথম প্রবর্তন ঘটে। এর আগে ২০০৭ সালের জুনে এ পদ্ধতি প্রবর্তনের সরকারি আদেশ জারি হয়। সেই হিসাবে এ পদ্ধতি প্রবর্তনের প্রায় দেড় দশক পূর্ণ হতে যাচ্ছে।
জানা যায়, সেসিপ নামে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে ‘একমুখী শিক্ষা কার্যক্রম’ বাস্তবায়নের অংশ হিসাবে এই পদ্ধতি চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল ২০০৪ সালে। তখন এর নাম ছিল কাঠামোবদ্ধ পদ্ধতি।
২০০৬ সালে এটি চালু হওয়ার কথা ছিল। এর সঙ্গে পরিচিত করতে শিক্ষক প্রশিক্ষণ, গ্রন্থ প্রণয়ন, এমনকি বেসরকারি প্রকাশকরা গাইডবই পর্যন্ত তৈরি করে ফেলেছিলেন। তখন একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের নেতৃত্বে এই পদ্ধতির প্রবর্তন বন্ধ করতে গড়ে উঠে আন্দোলন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ২০০৬ সালে তখনকার সরকার একমুখী শিক্ষা আর চালু করতে পারেনি।
পরে অবশ্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমানের উদ্যোগে দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের সমন্বয়ে একটি কমিটি হয়। ওই কমিটির সঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সভা করে। সেই সভায় আন্দোলনকারী ওই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকও যোগ দেন। সেখানেই কাঠামোবদ্ধ পদ্ধতির পরিবর্তে সৃজনশীল নামকরণ করা হয়। এরপরই তা চালু হয়। কিন্তু এতদিনেও এ পদ্ধতি পুরোপুরি আয়ত্তই করতে পারেননি শিক্ষকরা।
এ ব্যাপারে মাউশির ‘একাডেমিক তদারকি প্রতিবেদন’ শীর্ষক সমীক্ষা বলছে, ৬১ দশমিক ৮৪ শতাংশ শিক্ষক সৃজনশীল বিষয়ের দক্ষতা অর্জন করেছেন। তারা এ পদ্ধতিতে প্রশ্ন তৈরি করতে পারেন। বাকি ৩৮ দশমিক ১৬ শতাংশ শিক্ষক সৃজনশীল বিষয়ের প্রশ্ন তৈরি করতে পারেন না। এদের মধ্যে আবার ১৪ দশমিক ৮৬ শতাংশের অবস্থা খুবই নাজুক। এ ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা নতুন পদ্ধতিতে প্রশ্নপত্র তৈরি করতে পারেন না। তারা শিক্ষকদের বিভিন্ন সমিতি থেকে ‘রেডিমেড’ প্রশ্ন কিনে পরীক্ষা নেন।
যদিও প্রতিবেদনে এ সম্পর্কে বলা হয়, তারা ‘সৃজনশীল প্রশ্ন বাইরে থেকে সংগ্রহ’ করে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নেন। এছাড়া ২৩ দশমিক ৩০ শতাংশ শিক্ষক অন্যের (সহকর্মী) সহায়তা নিয়ে প্রশ্ন প্রণয়ন করেন। মাউশির আওতাধীন নয়টি অঞ্চলের ৬ হাজার ৭৮৪টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ওই সমীক্ষা পরিচালিত হয়।
এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, নিজস্ব শিক্ষকদের দিয়ে প্রশ্ন প্রণয়নের হার সবচেয়ে বেশি কুমিল্লা অঞ্চলে, ৭৯ দশমিক ৫০ ভাগ। সবচেয়ে কম বরিশাল অঞ্চলে, মাত্র ৩৪ দশমিক ৫৫ ভাগ।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বরিশাল অঞ্চলে কর্মরত একজন মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, আসলে সৃজনশীল বোঝে এবং প্রশ্ন করতে পারে-এমন শিক্ষকের সংখ্যা ২০ শতাংশের মতো হতে পারে। অন্যদিকে বরিশালের তথ্যকে যদি প্রকৃত চিত্র ধরা হয়, তাহলে এই হার ৩৫ শতাংশের বেশি হবে না। বাস্তব অবস্থা খুবই করুণ। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, সৃজনশীল প্রবর্তনের আগে বলা হয়েছিল যে, শিক্ষার্থীদের গাইডবই আর কোচিং নির্ভরতা কমবে। বাস্তবে দুটিই অনেকটা ‘মহামারি’র আকার ধারণ করেছে। ৯০ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থীকে শিক্ষকের কাছে ক্লাসের বাইরে কোচিং বা প্রাইভেট পড়তে হয়। আর পাবলিক পরীক্ষার পরীক্ষার্থীরা তো রীতিমতো একাধিক সেট গাইড কেনে কেবল বেশি বেশি উদ্দীপক অনুশীলনের জন্য।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. এম তারিক আহসান যুগান্তরকে বলেন, ‘আসলে সৃজনশীলের মূল সমস্যা ছিল এর পদ্ধতিতে। এই পদ্ধতি শিক্ষককে সৃজনশীল হতে বলা হয়েছে। তাকে প্রশিক্ষণে অনেক তত্ত্বকথা শোনানো হয়েছে। এরপর বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তাকে প্রশ্নপত্র তৈরি করতে বলা হয়েছে। যে কারণে সৃজনশীলে প্রশ্ন প্রণয়ন অত সহজ নয়। এর জন্য শিক্ষকের বিষয়ের ওপর গভীর জ্ঞান থাকা দরকার। বুঝতে হবে শিক্ষা মনস্তত্ত্ব।’
তার মতে, ব্যর্থতার নানা কারণ আছে। এর অন্যতম হচ্ছে-যেনতেন উপায়ে নিয়োগ পাওয়া দুর্বল শিক্ষকরা এই পদ্ধতি আয়ত্ত করতে পারেননি। দ্বিতীয়ত, যারা বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন, তাদেরও অনেকে কষ্ট করতে চাননি। হাতের নাগালে গাইডবই পেয়ে সেখান থেকে উদ্দীপক এনে প্রশ্ন তৈরি করেন। এর প্রামাণ হলো-কয়েক বছর আগে একটি পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন গাইডবই থেকে দেওয়া হয়েছিল।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মূল্যায়ন এবং পাঠদান উভয় ক্ষেত্রে শিক্ষকের ভূমিকা একজন ‘ফ্যাসিলিটেটর’ (সহায়তাকারী) হিসাবে। এজন্যই এখন দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতাকে ভিত্তি করে পাঠদান আর ‘শিখনকালীন মূল্যায়ন’ কথা এসেছে। আগামী বছর এই পদ্ধতি চালু করা হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, সৃজনশীল প্রশ্ন বা মূল্যায়ন পদ্ধতির সফল বাস্তবায়নের জন্য সরকারি কড়া নির্দেশনা ছিল। সে অনুযায়ী শিক্ষকরা পরীক্ষার প্রশ্ন নিজেরাই তৈরি করবেন। আগামী বছর ‘অভিজ্ঞতামূলক শিখন/শিক্ষণ ও মূল্যায়ন’ চালু হলেও পাবলিক পরীক্ষায় এই পদ্ধতি প্রবর্তন হতে লাগবে আরও অন্তত ৩ বছর। অর্থাৎ আগামী বছর প্রথম এবং ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন শিক্ষাক্রমের বই দেওয়া হবে।
২০২৪ সালে প্রাথমিকের দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণি এবং অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে পাইলটিং হবে। ২০২৫ সালে পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে যুক্ত হবে। ২০২৬ সালে একাদশ ও ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণি যুক্ত হবে। এই হিসাবে ২০২৫ সালে এসএসসি পরীক্ষাও হবে সৃজনশীল পদ্ধতিতে।
জানা যায়, বেশকিছু কারণে সৃজনশীল পদ্ধতির যথাযথ বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এর মধ্যে প্রধান হলো শিক্ষকদের সদিচ্ছার অভাব। এছাড়া আছে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ না পাওয়া, মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের দুর্বল মনিটরিং, শিক্ষকদের কোচিং মানসিকতা এবং বিভিন্ন শিক্ষক সমিতির প্রশ্নপত্র ব্যবসা। এর বাইরে গাইডবইয়ের ব্যবসা তো আছেই।
সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে শুরু থেকেই কাজ করছে বাংলাদেশ পরীক্ষা উন্নয়ন ইউনিট (বেডু)। এ সংস্থার পরিচালক অধ্যাপক রবিউল কবীর চৌধুরী বলেন, সত্যি কথা হচ্ছে-এই পদ্ধতির ক্ষেত্রে বড় সমস্যা হলো শিক্ষকের মান। সাধারণ শিক্ষক দূরের কথা, মাস্টার ট্রেনার প্রশিক্ষণেও আমরা এমন অনেক শিক্ষক পেয়েছি, যারা ঠিকমতো সৃজনশীল পদ্ধতি বোঝেন না। এমনকি প্রশিক্ষণের ভাষা না বোঝা শিক্ষকও পেয়েছি। এমন পরিস্থিতিতে এ পদ্ধতি বাস্তবায়নের অগ্রগতি নিয়ে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। তবে এবারের এইচএসসি পরীক্ষার বাস্তবতা সামনে রেখে আবারও এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ শুরুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ মাসের শেষে এটি শুরু হবে।