২৪ নভেম্বর ২০২৪, রবিবার, ১১:১৮:৫৬ পূর্বাহ্ন
আতঙ্কে ব্যাংক থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকা তুলেছেন গ্রাহকরা
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৪-১২-২০২২
আতঙ্কে ব্যাংক থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকা তুলেছেন গ্রাহকরা

আগামী দিনে জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) প্রবৃদ্ধি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে যাচ্ছে। যেসব উপাদানের ওপর ভিত্তি করে এতদিন প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে সেগুলো এখন কাজ করছে না। বর্তমানে প্রবৃদ্ধি কিভাবে হচ্ছে সে বিষয়ের বড় অংশ জানার বাইরে রয়ে গেছে। ব্যাংকে টাকা নেই এমন আতঙ্ক ছড়ানোয় এখন পর্যন্ত ৫০ হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন গ্রাহকরা। অবশ্য বুঝতে পেরে তারা আবার ব্যাংকে টাকা জমা দিচ্ছেন।

শনিবার বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা সম্মেলনের শেষ দিনে বক্তারা এসব কথা বলেন। রাজধানীর লেকশোর হোটেলে অনুষ্ঠিত সম্মেলনের দুই অধিবেশনে নানা বিষয় তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, ২০৩০ সালে উচ্চমধ্যম আয় এবং ২০৪১ সালে উচ্চ আয়ের দেশে যেতে হলে বর্তমানকালের ব্যবস্থাপত্র কাজে লাগবে না। এ অবস্থায় তিনটি বিষয়ের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।

এগুলো হলো-উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, সঞ্চয় ও বিনিয়োগ বাড়ানো এবং কর্মসংস্থানে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানো। পাশাপাশি ব্যাংকিং খাতে সংস্কার, নগরায়ণ সংস্কার, রপ্তানি প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। রপ্তানিতে শুল্ক-অশুল্ক বাধা দূর করতে হবে। একই সঙ্গে খেলাপি ঋণকে বর্তমান সময়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলা হয়েছে।

একটি অধিবেশনে দুটি গবেষণাপত্র উপস্থাপন করা হয়। এগুলো হলো-গ্রোথ, এমপয়মেন্ট অ্যান্ড প্রভার্টি এবং এসকাপিং দ্য ফ্যামিলি স্যাডো, ইন্টার জেনারেশনাল মবিলিটি ইন ডেভেলপিং কান্ট্রিস। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. হোসেন জিলুর রহমানের সভাপতিত্বে প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন ইউএসএ’র কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শাহ ইমন, বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন, বিশ্বব্যাংকের কনসালট্যান্ট-নোরা ডিহেল, গায়েন্ত্রী কোলওয়াল এবং বিশ্বব্যাংকের জিওগ্রাফার লন্ডার বোস। আরেক অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন বিআইডিএস’র মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন এবং গবেষক ড. কাজী ইকবাল।

গবেষণাপত্রের বিষয়ে ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, এতদিন যে ফ্রেমওয়ার্ক দিয়ে দেশের অর্থনীতি এগিয়েছে, এখনো কি সেই রকমই চলবে। নাকি নতুন ফ্রেমওয়ার্ক দরকার। যেমন কৃষিতে বোরো ধানের অবদান অনেক বেশি। এখনো কি সেটি থাকবে কিনা সেটি বড় প্রশ্ন। দেখা গেছে, ৯০ দশকে বাংলাদেশে ইনোভেশন অনেক হয়েছে। তবে সাম্প্রতিক সময়গুলোতে সেটি ব্যাপক কমেছে। এর কারণ বের করতে ব্যাস্টিক, সামষ্টিক অর্থনীতি এবং রাজনৈতিক অর্থনীতি বিশেষণ করা দরকার। একইসঙ্গে সামাজিক বিশেষণও জরুরি। ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি যেসব বিষয় দিয়ে চলছে, তা একটা সময় গিয়ে আর কাজ করবে না। উচ্চ আয়ের দেশে যেতে হলে এখানে পথ পরিবর্তন করতে হবে।

১৩০টি উন্নয়নশীল দেশের ওপর পর্যালোচনা করে তৈরি করা গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি অর্জনের হাতিয়ার আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, বিনিয়োগসহ বিভিন্ন সূচকগুলো হিসাব করে দেখা হয়। ১৯৯০ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত ব্যাপক সংস্কার হয়েছিল। যেমন আর্থিক খাত সংস্কার, রপ্তানি, এক্সচেঞ্জ রেট, অবকাঠামোসহ নানা ক্ষেত্রে সংস্কার হয়েছে। কিন্তু ২০০৪ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সংস্কারের ভূমিকা কমেছে।

গবেষণায় দেখা যায়, ২০০৪ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত অতীতের সংস্কারের প্রভাব হিসাবে দেশের প্রবৃদ্ধি অর্জন হয়েছে। কিন্তু ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে সংস্কার প্রভাবের ভূমিকা পাওয়া যায়নি। বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে আগামী ২০-৩০ বছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ হারে হতে পারে। কিন্তু তারপর কমে গিয়ে ৫ শতাংশের ঘরে যাবে। এ অবস্থায় উচ্চ মধ্যম আয় এবং উচ্চ আয়ের দেশে যাওয়া কঠিন হবে। এক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, সঞ্চয় ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি, কর্মে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে।

ড. বিনায়ক সেন বলেন, বিগব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরে আসতে হবে। আমাদের অন্য পথে যেতে হবে। যেসব সমস্যার সামাধান করা সম্ভব নয় বা কঠিন সেগুলো থেকে দূরে থাকতে হবে। এছাড়া যে সমস্যার সমাধান সম্ভব, সেগুলোর সমাধানে উদ্যোগী হতে হবে। ড. কাজী ইকবাল বলেন, পরিবারের মধ্যে যদি বাবা-মা শিক্ষিত ও অর্থশালী হয় তাহলে তার পরবর্তী জেনারেশনও শিক্ষার ক্ষেত্রে বেশি সুযোগ পায়। এতে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল পরিবারগুলোর ছেলেমেয়েরা উপযুক্ত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়। ফলে শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈষম্য বাড়ছে। এজন্য রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকেই এমন ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে শিক্ষায় বৈষম্য কমে যায়। অপর একটি উপস্থাপনায় বলা হয়, বাঁধ নির্মাণ থেকে সরে আসার কথা অনেকেই বলেন। কিন্তু সেটি করা যাবে না। বরং এক্ষেত্রে উন্নত নানা পদ্ধতির ব্যবহার করে পুরোনো বাঁধ সংস্কার এবং নতুন বাঁধ নির্মাণ করতে হবে। সেটি করা না গেলে নিম্ন আয়ের দেশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সংস্কারের তাগিদ : করোনা পরবর্তী অবস্থা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশের বাজেট ব্যবস্থাপনা, আর্থিক ব্যবস্থাপনা এবং পরিকল্পনায় সংস্কার আনা জরুরি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, তৃতীয় ও চতুর্থ জেনারেশনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় লক্ষ্যগুলো সংস্কার করতে হবে।

বিআইডিএস’র মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সমাপনী অধিবেশনে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান। বিশেষ অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী এবং প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস। আলোচক ছিলেন-বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব শরিফা খান, পরিকল্পনা সচিব মামুন-আল-রশীদ প্রমুখ।
ড. মসিউর রহমান বলেন, খেলাপি ঋণ বর্তমানে একটি সিরিয়াস ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। এর ফলে অন্যদের ঋণ গ্রহণের সুযোগ কমে যাচ্ছে। কম সুদের হার যে কোনো ভুল বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে পারে। তাই বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে।
তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেন, ভর্তুকির প্রয়োজন আছে। যেমন বিদ্যুতের ভর্তুকি কার্যকর হচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে উন্নত অনেক দেশও ভর্তুকি দিচ্ছে। সালমান এফ রহমান বলেন, দীর্ঘ মেয়াদে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা ভালো নয়। বর্তমানে ৯ শতাংশ সুদের ঊর্ধ্বসীমা ঠিকই আছে। কেননা শিল্প কারখানাগুলো এখন ধুঁকছে। তিনি বলেন, শ্রীলংকা ও পাকিস্তানের যে অবস্থা হয়েছে সেটির মূল কারণ বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে না পারা।

ড. আহমদ কায়কাউস বলেন-তেল, ডাল এবং গমের ক্ষেত্রে আমাদের দেশে সমস্যা আছে। এছাড়া চাল, মাছ ও মাংসে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ আছি। সুতরাং এত দুশ্চিন্তার কিছু নেই। মানুষ আতঙ্ক ছড়িয়েছে-ব্যাংকে টাকা নেই। ফলে এখন পর্যন্ত ৫০ হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন গ্রাহকরা। পরে বুঝতে পেরে আবার তারা ব্যাংকে টাকা জমা দিচ্ছেন। তপন কান্তি ঘোষ বলেন, এখন তিন ধরনের ধাক্কা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। কোভিড, যুদ্ধ ও মূল্যস্ফীতি। তবে যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে বাণিজ্য শুল্ক সুবিধা ছাড়াই আমরা ভালো করছি। ভবিষ্যতে অন্যসব স্থানেও ভালো করা সম্ভব হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, এ সময় সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা জরুরি। মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জনে সমন্বিত একটা পলিসি থাকা দরকার। কৃষি যেহেতু বিপদে আমাদের ভরসার জায়গা। তাই এখানে ভর্তুকি রাখতে হবে।

এফবিসিসিআই সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেন, বর্তমানে এনবিআর’র সংস্কার, অবকাঠামো, লজিস্টিক এবং জ্বালানি সহায়তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী বলেন, শিল্পের কাঁচামাল, গ্যাস, ট্রেড ব্যালেন্স, মূল্যস্ফীতি, রেমিট্যান্স, রিজার্ভ এবং জ্বালানি ব্যবস্থাপনার চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এনবিআর’র কারণে ভয়ে মানুষ ব্যাংকে টাকা রাখতে চাচ্ছে না। বালিশের নিচে টাকা রাখছে। সিপিডি’র ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আগামী ২-৩ বছরের জন্য উত্তরণকালীন প্যাকেজ করা উচিত। বক্তব্য দেন সিপিডির ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান, বিআইজিডির ফেলো ইমরান মতিন, পিআরআই চেয়ারম্যান ড. জাইদী সাত্তার প্রমুখ।

শেয়ার করুন