জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা চলতি সপ্তাহেই দুই দিনের এক সফরে প্রতিবেশী ভারতে এসেছিলেন। সেখানে দেয়া বক্তব্যে এ অঞ্চলে জাপানি কৌশলগত বিনিয়োগের বড় ক্ষেত্র হিসেবে বাংলাদেশ ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কানেক্টিভিটিকে চিহ্নিত করেন তিনি। দুই দেশের কানেক্টিভিটি খাতে এরই মধ্যে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেছে জাপান। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে গত এক দশকে শুধু কানেক্টিভিটি গড়ে তুলতে গিয়েই হাজার কোটি ডলারের বেশি ব্যয় করেছে টোকিও। এর মধ্যে উত্তর-পূর্ব ভারতের উন্নয়নে দেশটির ব্যয় এরই মধ্যে ২০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশে জাপানের আঞ্চলিক কানেক্টিভিটি কার্যক্রমের বড় একটি অংশজুড়ে রয়েছে চট্টগ্রাম অঞ্চল। এর প্রধানতম অনুষঙ্গ হলো কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দর এবং বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ ও উন্নয়ন। গভীর সমুদ্রবন্দরটি নির্মাণ ও আনুষঙ্গিক উন্নয়ন কার্যক্রমে মোট ব্যয় হচ্ছে ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাপান দিচ্ছে ১২ হাজার ৮৯২ কোটি টাকা (১২০ কোটি ডলার প্রায়)। মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে জাপানের বিনিয়োগ প্রায় ৪৪ হাজার কোটি টাকা (প্রায় ৪১১ কোটি ডলার)। এছাড়া পরিবহন ও যোগাযোগ খাতেও বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করছে দেশটি।
সামনের দিনগুলোয় এ ধরনের বিনিয়োগ আরো বাড়বে বলে ভারত সফরকালে ইঙ্গিত দিয়েছেন ফুমিও কিশিদা। সেখানে এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘ভূমিবেষ্টিত উত্তর-পূর্ব ভারতের এখনো অনেক অর্থনৈতিক সম্ভাবনা রয়েছে, যা কাজে লাগানো হয়নি। বাংলাদেশসহ অঞ্চলটির দক্ষিণের এলাকাগুলোকে একক একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে বিবেচনায় নিচ্ছি আমরা। এখানে বাংলাদেশ ও ভারতের সহযোগিতায় বঙ্গোপসাগর-উত্তর-পূর্ব ভারতীয় ইন্ডাস্ট্রিয়াল ভ্যালু চেইন ধারণার বিকাশ ঘটাতে চাই আমরা, যাতে করে তা গোটা অঞ্চলের প্রবৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে।’
তিনি আরো বলেন, ‘শিগগিরই স্বল্পোন্নতের তালিকা থেকে উত্তরণ ঘটবে বাংলাদেশের। সামনের দিনগুলোয় দেশটির সঙ্গে নতুন অর্থনৈতিক অংশীদারত্বের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে এরই মধ্যে একটি যৌথ সমীক্ষা গ্রুপ তৈরি করা হয়েছে।’
একই অনুষ্ঠানে জাপানি প্রধানমন্ত্রীর জনসংযোগবিষয়ক মন্ত্রিসভা সচিব নরিয়ুকি শিকাতা বলেন, ‘ভারত ও বাংলাদেশী অর্থনীতির মধ্যে পারস্পরিক কানেক্টিভিটি গড়ে তোলার বিষয়টিতে নজর থাকবে টোকিওর। একই সঙ্গে আরো বেশিসংখ্যক জাপানি কোম্পানি যাতে এ অঞ্চলে বিনিয়োগ নিয়ে এগিয়ে আসে, সে বিষয়ে প্রয়াস চালিয়ে যাবে দেশটি। বর্তমান পরিস্থিতিতে মিয়ানমারের সঙ্গে সহযোগিতার বিষয়টিকে সামনে নিয়ে আসা কঠিন। এ অবস্থায় বাংলাদেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তি সইয়ের সুযোগ খুঁজছে জাপান।’
ভারত সফর চলাকালে জাপানি প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে উত্তর-পূর্ব ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে কানেক্টিভিটিতে সামনের দিনগুলোয় জাপানের বিনিয়োগ বৃদ্ধির ইঙ্গিত পাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের ভাষ্যমতে, ওই অনুষ্ঠানের মূল বিষয়বস্তু ছিল অবাধ ও মুক্ত ইন্দোপ্যাসিফিক (এফওআইপি)। মূলত ইন্দোপ্যাসিফিকে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মোকাবেলায় এ এফওআইপি কৌশল গ্রহণ করেছে বেইজিংয়ের প্রতি বৈরী দেশগুলো। জাপানি প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে উঠে এসেছে বাংলাদেশ ও উত্তর-পূর্ব ভারতকে এ কৌশলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে দেখছেন তিনি। এখন পর্যন্ত চীনের লাগোয়া এ এলাকাটিতেই (বাংলাদেশ ও উত্তর-পূর্ব ভারত) জাপানের বিনিয়োগ সবচেয়ে বেশি। দেশটির প্রধানমন্ত্রীর সামনের দিনগুলোয় তা আরো বাড়ানোর আভাস থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায়, দক্ষিণ এশিয়া তথা গোটা ইন্দোপ্যাসিফিকে চীনের ক্রমবর্ধমান মোকাবেলায় বাংলাদেশ ও উত্তর-পূর্ব ভারতের ওপরেই সবচেয়ে বড় বাজি ধরছে জাপান।
দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক হটস্পটগুলোর অন্যতম এখন উত্তর-পূূর্ব ভারত। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ঠিক সংযোগস্থলে অবস্থিত এলাকাটির ভূগঠন অনেকটাই দুর্গম ও জটিল। অতীতে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভারতের পররাষ্ট্রনীতির মূলমন্ত্র ছিল ‘লুক ইস্ট’ (পুবে দেখ)। এখন এ নীতির আওতা ও পরিধি বেড়ে তা রূপ নিয়েছে ‘অ্যাক্ট ইস্টে’ (পুবে চল)। জাপানের আঞ্চলিক কৌশলের ক্ষেত্রে জাপানও এখন এ নীতির সঙ্গে সংগতি রেখে ভূরাজনৈতিক ও ভূ-অর্থনৈতিক কৌশল গ্রহণ করতে চাচ্ছে। এরই মধ্যে ভারত ও জাপান মিলে একযোগে ‘অ্যাক্ট ইস্ট ফোরামও’ গড়ে তুলেছে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ভারতের উত্তর-পূর্ব এলাকার সীমান্তের বড় একটি অংশ চীনের সঙ্গে। আঞ্চলিক প্রতিবেশী হিসেবে থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারও আছে। উত্তর-পূর্বের সঙ্গে বাংলাদেশের কানেক্টিভিটি আসিয়ান ও ভারতকে সংযুক্ত করতে পারে। এ অঞ্চলটা অনেক বড় ধরনের কৌশলগত একটি জায়গাও বটে। তাছাড়া বড় ধরনের বিনিয়োগ পেলে বাংলাদেশ ও উত্তর-পূর্ব ভারতে একযোগে চীনের প্রতিযোগী একটি কাঠামো দাঁড় করানো সম্ভব। কিন্তু এখানে বিনিয়োগ ভারতের একার পক্ষে সম্ভব নয়। আবার পশ্চিমারাও করবে না। সেক্ষেত্রে বিনিয়োগ করবে জাপান। এটা হলে আবার বাংলাদেশও অনেকটা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে। তারা ভারতে উন্নয়ন করতে গেলে আমাদের দরকার। তারা এক ধরনের বৃহৎ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিষয়টি দেখছে এবং এ দৃষ্টিভঙ্গিটা কৌশলগত বলেই আমার ধারণা।’
কানেক্টিভিটিসহ বিভিন্ন খাতে জাপানের ঋণ ও অনুদান সহায়তা আসে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) মাধ্যমে। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, শুধু উত্তর-পূর্ব ভারতেই সংস্থাটির বিনিয়োগ (২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত) প্রায় ২৪ হাজার ৬০০ কোটি ইয়েন। এ বিনিয়োগের মূল লক্ষ্য হলো বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথভাবে আঞ্চলিক কানেক্টিভিটি ব্যবস্থার উন্নয়ন। মোট পাঁচ ধাপে ‘উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় কানেক্টিভিটি উন্নয়ন প্রকল্পগুলোয়’ বিনিয়োগ করছে জাইকা। এর আওতায় উত্তর-পূর্ব ভারতে জাতীয় মহাসড়কের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিভিন্ন অংশে মোট ৬৫৭ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কপথের উন্নয়ন ও নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
আসামের নয়া ধুবড়ি থেকে মেঘালয়ের ফুলবাড়ী পর্যন্ত নির্মাণ হচ্ছে ১৯ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতু। ভারতের দীর্ঘতম এ সেতু নির্মাণ প্রকল্পে অর্থায়ন করছে জাইকা। প্রকল্পটির সফল বাস্তবায়ন বাংলাদেশ