২৪ এপ্রিল ২০২৪, বুধবার, ০৮:৫৯:৩৮ অপরাহ্ন
কমছে বিদ্যুৎ উৎপাদন, বাড়ছে লোডশেডিং
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৮-০৪-২০২৩
কমছে বিদ্যুৎ উৎপাদন, বাড়ছে লোডশেডিং

বর্তমানে চট্টগ্রামে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) গ্রাহকদের বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে ১৩৫১ মেগাওয়াট। কিন্তু গত ১৪ এপ্রিল চট্টগ্রামের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে পিক আওয়ারে উৎপাদন হয়েছে ১২৬১ মেগাওয়াট। একই চাহিদায় ১৩ এপ্রিল উৎপাদন ছিল ১৩২৩ মেগাওয়াট। এদিন পিডিবি সারাদেশে রেকর্ড ১৫ হাজার ৩০৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের তথ্য দিয়েছে। বর্তমানে সারাদেশে পিডিবির দেড় শতাধিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে ২২ হাজার ৭০০ মেগাওয়াটের। এর মধ্যে চট্টগ্রামের সরকারি বেসরকারি ২২টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতা ২৩৮২ মেগাওয়াট।

পিডিবির সাম্প্রতিক তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, উৎপাদন সক্ষমতা থাকলেও গ্যাস ও ফুয়েল সংকটসহ রক্ষণাবেক্ষণ জটিলতায় পুরো মাত্রায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যর্থ হচ্ছে পিডিবি। এতে লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণায় নাকাল হতে হচ্ছে সাধারণ মানুষের। গত কয়েকদিন তীব্র দাবদাহের পাশাপাশি বিদ্যুতের যাওয়া-আসা নাগরিক জীবনের বাড়িয়েছে দুর্ভোগ। তবে পিডিবি কাগজে-কলমে লোডশেডিংয়ের বিষয়টি স্বীকার করতে চায় না।

চট্টগ্রাম মহানগরীর মাদারবাড়ি এলাকার বাসিন্দা কুতুব উদ্দিন। গত কয়েকদিনে বিদ্যুৎবিভ্রাটের বিষয়ে তিনি বলেন, আমার বাসার বিদ্যুৎ সংযোগ এক লাইনের। আমার পাশের আরেকটি বাসার সংযোগ অন্য লাইনের। কিন্তু বিতরণ বিভাগ একটি। শনিবার সন্ধ্যায় দুই বাসায় একই সঙ্গে বিদ্যুৎ চলে গেলেও ২০ মিনিট পর পাশের বাসার বিদ্যুৎ সচল হয়। কিন্তু আমাদের বাসায় এসেছে আরও ৩০ মিনিট পরে।

তার প্রশ্ন, দুই বাসায় একই বিতরণ বিভাগের বিদ্যুৎ সংযোগ হলেও দুই বাসায় লোডশেডিংয়ের চিত্রে ভিন্নতা কেন?

নগরীর চান্দগাঁও শমশের পাড়ার বাসিন্দা মো. ফারুক। রোববার দুপুর দেড়টায় তিনি বলেন, রোববার সেহরির পর থেকে পাঁচবার বিদ্যুৎ গেছে। দুপুর ১টায় গিয়ে এখনো বিদ্যুৎ আসেনি। বাসায় বিদ্যুৎ না থাকায় মোটর চলছে না। ভবনের টাংকিতে পানি তোলা যাচ্ছে না। অত্যধিক গরম পড়লেও একটু গোসল করতে পারছি না। আমার মতো পুরো চান্দগাঁও এলাকার বাসিন্দাদের একই কষ্ট পোহাতে হচ্ছে।

পাথরঘাটা এলাকার আমদানিকারক ব্যবসায়ী তৌহিদুল আলম বলেন, তিন-চার দিন ধরে লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণায় রাতের বেলা ঘুমাতে পারছি না। একদিকে রমজান মাস, অন্যদিকে তীব্র গরম। এর মধ্যে বিদ্যুতের ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে পরিবারের সদস্যরা অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।

চট্টগ্রাম শহরের বাইরে পটিয়া এলাকার বাসিন্দা দিদারুল আলম বলেন, রমজান মাসে বিদ্যুতের লোডশেডিং হবে না বলে জানানো হয়েছিল। এখন সেহরি, ইফতারের সময়ও বিদ্যুৎ থাকছে না। শনিবার ইফতারের সময়েও বিদ্যুৎ ছিল না। কোনো কোনো দিন সেহরির সময় চার্জার লাইট জ্বালিয়ে খাবার খেতে হয়েছে।

সবশেষ পিডিবির ১৪ এপ্রিলের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এদিন চট্টগ্রামের ২২টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে পিক আওয়ারে মাত্র চারটিতে সক্ষমতার পুরোপুরি বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে। গ্যাস সংকটে পড়ে বন্ধ ছিল রাউজান তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের ১৮০ মেগাওয়াটের দুটি ইউনিট। পাশাপাশি গ্যাস সংকটে শিকলবাহা ২২৫ মেগাওয়াট রিসাইকেল পাওয়ার প্ল্যান্টে উৎপাদিত হয়েছে ১৪৭ মেগাওয়াট। বারবকুণ্ড ২২ মেগাওয়াট রিজেন্ট পাওয়ার প্ল্যান্টে উৎপাদিত হয়েছে ১৪ মেগাওয়াট। একইদিন সারাদেশে গ্যাস সংকটে ১১টি বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন বন্ধ ছিল।

ফুয়েল সংকটে পিকআওয়ারে সক্ষমতা অনুযায়ী উৎপাদন করতে পারেনি চট্টগ্রামের বেসরকারি পাঁচটি পাওয়ার প্ল্যান্ট। এর মধ্যে পতেঙ্গা ৫০ মেগাওয়াট বারাকা পাওয়ার প্ল্যান্টে ১৯ মেগাওয়াট, জুলধা ১০০ মেগাওয়াট একর্ন পাওয়ার প্ল্যান্টে (ইউনিট-১) ৬৫ মেগাওয়াট, চট্টগ্রাম ১০৮ মেগাওয়াট এনার্জি প্যাক কনফিডেন্ট পাওয়ার ভেঞ্চার (ইসিপিভি) পাওয়ার প্ল্যান্টে ১১ মেগাওয়াট, আনোয়ারা ৩০০ মেগাওয়াট ইউনাইটেড পাওয়ার প্ল্যান্টে ২৩২ মেগাওয়াট এবং ১১০ মেগাওয়াট বারাকা কর্ণফুলী পাওয়ার প্ল্যান্টে ৯২ মেগাওয়াট উৎপাদিত হয়েছে। একই দিন সারাদেশে ফুয়েল সংকটে ২০টির বেশি বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রে (আইপিপি) উৎপাদনে ঘাটতি ছিল।

এদিন কাপ্তাই লেকের পানির স্তর কমে যাওয়ায় ২৩০ মেগাওয়াট কাপ্তাই হাইড্রো পাওয়ার প্ল্যান্টে মাত্র ২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে। অন্যদিকে রক্ষণাবেক্ষণ জটিলতায় দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে শিকলবাহা ১৫০ মেগাওয়াট ডুয়েল ফুয়েল পাওয়ার প্ল্যান্ট। শিকলবাহা পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্টের ব্যবস্থাপক পিডিবির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী কামরুদ্দীন আহমদ বলেন, শিকলবাহা ১৫০ মেগাওয়াট পাওয়ার প্ল্যান্টটি কয়েক মাস ধরে বন্ধ। এখন মেনটেনেন্স ওয়ার্ক করছে সিমেন্স। আশা করছি তিন থেকে আগামী চার মাসের মধ্যে আমরা পুনরায় উৎপাদনে যেতে পারবো।’

তাছাড়া যান্ত্রিক সমস্যার কারণে এদিন পিডিবির মালিকানাধীন হাটহাজারী ১০০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্টে ৬৬ মেগাওয়াট, ১০০ মেগাওয়াট দোহাজারি-কালিয়াইশ পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্টে ৬৭ মেগাওয়াট, ১১৬ মেগাওয়াট আনলিমা এনার্জি লিমিটেড পাওয়ার প্ল্যান্টে ১০৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে।

১০০ মেগাওয়াট দোহাজারি-কালিয়াইশ পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্টের ম্যানেজার মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘আমাদের প্ল্যান্টগুলো পুরোনো হচ্ছে। তার ওপর তীব্র গরমে মেশিনগুলোর ওপরও চাপ পড়ছে। এতে সক্ষমতা অনুযায়ী উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে না। তার ওপর মেনটেন্সের কারণে আমাদের ছয়টি জেনারেটরের মধ্যে পাঁচটি জেনারেটর দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে।’

রাউজান তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের ১৮০ মেগাওয়াটের দুটি ইউনিটের একটি শনিবার (১৫ এপ্রিল) থেকে চালু হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎকেন্দ্রটির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. জসীম উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘আমরা নিয়মিত গ্যাস পাই না। গ্যাস স্বল্পতার কারণে আমাদের প্ল্যান্ট দুটি মধ্যখানে অনেকদিন বন্ধ ছিল। এখন শিকলবাহার একটি প্ল্যান্ট বন্ধ থাকায় আমাদের গ্যাস দেওয়া হয়েছে। আমরা শনিবার ১২০-১৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ গ্রিডে সরবরাহ দিয়েছি।’

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাম্প্রতিক ডলার সংকট এবং ডলারের দামের ঊর্ধ্বগতির কারণে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ফার্নেস অয়েল ও ডিজেল আমদানিতে পিছু হটছে। তারা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের মাধ্যমে এসব জ্বালানি সরবরাহ নিতে আগ্রহী। তবে বিপিসি চাহিদা মাফিক তাৎক্ষণিক সরবরাহ দিতে না পারার কারণে আইপিপিগুলোতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ঘাটতি দেখা দিচ্ছে।

এ ব্যাপারে পিডিবির প্রাইভেট জেনারেশন (আইপিপি/পিপিপি) বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী এ বি এম জিয়াউল হক বলেন, আইপিপিগুলোর জ্বালানির সাপ্লাই চেইন রয়েছে। আইপিপিগুলো নিজেরা ফুয়েল আমদানি করে। আবার বিপিসির কাছ থেকেও ফুয়েল নেয়। কিন্তু বিপিসি নিয়মিত ফুয়েল দিতে পারছে না। তাছাড়া ডলারের দামের ঊর্ধ্বগতির কারণেও আইপিপিগুলোকে ফুয়েল আমদানিতে ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে।

তিনি বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষিত ডলারের দর ১০৭ টাকা হলেও ব্যাংকগুলোতে ডলার সংকটের কারণে এলসি খোলা কষ্টসাধ্য হচ্ছে। এতে আইপিপিগুলোকে লোকাল মার্কেট থেকে ডলার কিনে অনেক সময় এলসি খুলতে হয়। লোকাল মার্কেটে ডলার ১২০ টাকা পর্যন্ত কিনতে হয়। এ খাতে আইপিপিগুলোকে অনেক টাকা খরচ করতে হচ্ছে। যে কারণে ফুয়েলের কিছু ক্রাইসিস রয়েছে। তবে গত কয়েকদিন দাবদাহের কারণে বিদ্যুতের চাহিদায় অতিরিক্ত চাপ তৈরি হয়েছে।

পিডিবি কাগজে কলমে লোডশেডিং না দেখালেও সরবরাহ ব্যবস্থায় বিদ্যুতের চরম ঘাটতি তৈরি হয়েছে। যে কারণে দিনে রাতে সব সময় লোডশেডিংয়ের কবলে পড়তে হচ্ছে গ্রাহকদের।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ বিতরণ দক্ষিণাঞ্চলের (চট্টগ্রাম) প্রধান প্রকৌশলী মো. রেজাউল করিম বলেন, আমাদের জেনারেশনে কিছু ঘাটতি রয়েছে। চট্টগ্রামে গত দুদিন ২৫০ মেগাওয়াটের মতো লোডশেডিং হচ্ছে। গত শুক্রবার (১৪ এপ্রিল) লোডশেডিং ছিল ৫০-৬০ মেগাওয়াটের মতো। কিন্তু শনিবার একশ থেকে আড়াইশ মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং করতে হয়েছে। আজও (রোববার) চট্টগ্রামে ২৫০ মেগাওয়াট লোডশেডিং করতে হচ্ছে।

গ্যাস ও ফুয়েল সংকটের কারণ বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন পিডিবির সদস্য (উৎপাদন) এস এম ওয়াজেদ আলী সরকার। তিনি বলেন, ফুয়েল সংকট কিংবা গ্যাস সংকট কোনো ইস্যু নয়। তবে কারিগরি কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে।

তিনি বলেন, আমাদের সরবরাহ নেটওয়ার্কে বিক্ষিপ্তভাবে কিছু জটিলতা রয়েছে। গরমের কারণে লোড বেড়ে যাওয়ায় দেশের বিভিন্ন স্থানে কিছু কারিগরি সমস্যা তৈরি হয়েছে। তাও সাময়িক। আশা করছি দু-একদিনের মধ্যে তা কেটে যাবে।

শেয়ার করুন