গাজীপুর সিটি করপোরেশন (জিসিসি) নির্বাচনের ভোটগ্রহণ আজ। সিটি করপোরেশন গঠেনের পর তৃতীয়বারের মতো এ নির্বাচন হচ্ছে। নগরীর ৪৮০টি কেন্দ্রে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট হবে। সকাল ৮টায় শুরু হয়ে চলবে একটানা বিকাল ৪টা পর্যন্ত। প্রতি কেন্দ্রেই রয়েছে সিসি ক্যামেরা। এবারের নির্বাচনে অবশ্য ৩৫১টি ভোট কেন্দ্রকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে নির্বাচন সুষ্ঠু, সুন্দর ও সফল করার লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশনসহ (ইসি) সংশ্লিষ্টরা এরই মধ্যে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেলা হয়েছে পুরো নগরী। নির্বাচনী এলাকায় দায়িত্ব পালন করছেন পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, এপিবিএন ও আনসার-ভিডিপিসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রায় ১৩ হাজার সদস্য।
জিসিসি নির্বাচনে মেয়র পদে লড়ছেন আটজন। তবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে আওয়ামী লীগের প্রার্থী অ্যাডভোকেট মো. আজমত উল্লা খান ও সাবেক মেয়র মো. জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুনের মধ্যেই। এ নির্বাচনে আজমত উল্লা খান দলীয় প্রতীক ‘নৌকা’ এবং জায়েদা খাতুন লড়ছেন ‘টেবিল ঘড়ি’ প্রতীক নিয়ে। এছাড়া জাতীয় পার্টির প্রার্থী (লাঙল প্রতীক) সাবেক সচিব এমএম নিয়াজ উদ্দিন, হাতপাখা প্রতীকে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের গাজী আতাউর রহমান, গোলাপ ফুল প্রতীকে জাকের পার্টির রাজু আহাম্মেদ, মাছ প্রতীকে গণফ্রন্টের আতিকুল ইসলাম প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। স্বতন্ত্র মেয়র পদে ঘোড়া প্রতীকে হারুন-অর রশীদ ও হাতি প্রতীকে লড়ছেন সরকার শাহনূর ইসলাম। এর আগে গত মঙ্গলবার মধ্যরাতে এ নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রচার শেষ হয়। ৯ মে থেকে টানা ১৫ দিন প্রচার চালিয়েছেন প্রার্থীরা। ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থীরাও ব্যাপক প্রচার চালিয়েছেন। প্রায় ৪০ লাখ নগরবাসীর সেবা করার জন্য কারা হচ্ছেন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, সেটাই নির্ধারণ হবে আজকের ভোটে।
নির্বাচন উপলক্ষে গতকাল সকালে শহীদ বরকত স্টেডিয়ামে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ব্রিফ করেন গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) কমিশনার মোল্যা নজরুল ইসলাম। নিরাপত্তার বিষয়ে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিয়ে মোল্যা নজরুল ইসলাম বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এখানে আপনারা দায়িত্ব পালনের জন্য এসেছেন। একটি সুষ্ঠু ও সুন্দর নির্বাচন যাতে হয়, সে বিষয়ে আমাদের সজাগ থাকতে হবে। আমাদের মূল উদ্দেশ্য হলো একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহযোগিতা করা। জনগণ ভোট কেন্দ্রে এসে নিরাপদে যাতে ভোট দিয়ে চলে যেতে পারে, সে ব্যবস্থা করা। পুরো গাজীপুরসহ সারা বিশ্বের লোকজন তাকিয়ে আছে এ নির্বাচনের দিকে। আমরা আমাদের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করব একটি সুন্দর নির্বাচন উপহার দেয়ার।’
ব্রিফিংকালে জিসিসি নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. ফরিদুল ইসলাম, গাজীপুর জেলা প্রশাসক আনিসুর রহমানসহ পুলিশ, বিজিবি, আনসার বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন। পরে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের নিজ নিজ কেন্দ্রের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে।
গাজীপুর সিটি নির্বাচনের সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা এইচএম কামরুল ইসলাম জানান, এ সিটিতে মোট সাধারণ ওয়ার্ডের সংখ্যা ৫৭ এবং সংরক্ষিত ওয়ার্ডের সংখ্যা ১৯। এ নির্বাচনে সর্বশেষ হালনাগাদকৃত ভোটার সংখ্যা ১১ লাখ ৭৯ হাজার ৪৭৬। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৫ লাখ ৯২ হাজার ৭৬২, নারী ৫ লাখ ৮৬ হাজার ৬৯৬ ও হিজড়ার সংখ্যা ১৮। নির্বাচনে ভোটগ্রহণের জন্য মোট ৪৮০টি কেন্দ্র নির্ধারণ করা হয়েছে। এসব কেন্দ্রে মোট ভোটকক্ষ ৩ হাজার ৪৯৭টি, যেখানে ব্যবহারের জন্য ৫ হাজার ২৪৬টি ইভিএম প্রস্তুত রাখা হয়েছে। প্রতি কেন্দ্রে একজন করে মোট ৪৮০ জন ট্রাবল শ্যুটার, প্রতি দুই কেন্দ্রে একজন করে মোট ২৪০ জন (ভ্রাম্যমাণ) টেকনিক্যাল এক্সপার্ট, ১৪ জন সহকারী প্রোগ্রামার ও চারজন থাকবেন প্রোগ্রামার; যাতে কোনো ইভিএমে সমস্যা দেখা দিলে তা দ্রুত সমাধান করা যায়। প্রতি কেন্দ্রে একটি এবং কক্ষে একটি করে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে।
সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের কাছে সব ভোট কেন্দ্রই গুরুত্বপূর্ণ। তবে এ নির্বাচনে মোট ৪৮০টি ভোট কেন্দ্রের মধ্যে ৩৫১টিকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ (ঝুঁকিপূর্ণ) বিবেচনা করা হচ্ছে। বাকি ১২৯টি সাধারণ কেন্দ্র। সাধারণ ভোট কেন্দ্রগুলোয় পুলিশ, আনসারসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ১৬ সদস্য দায়িত্ব পালন করবেন। এর মধ্যে পুলিশ চারজন, আনসারের একজন করে প্লাটুন কমান্ডার ও সহকারী প্লাটুন কমান্ডার এবং আনসার-ভিডিপির ছয়জন পুরুষ ও চারজন নারী সদস্য নিয়োজিত থাকবেন। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রগুলোয় পুলিশের একজন সদস্য বাড়িয়ে মোট ১৭ জন নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করবেন।’
রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. ফরিদুল ইসলাম বলেন, ‘গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সংরক্ষিত ৫৭টি ওয়ার্ডে নির্বাহী হাকিম থাকবেন ৭৬ জন, সঙ্গে বিচারিক হাকিমও থাকবেন। র্যাবের ৩০টি টিম থাকবে। বিজিবির থাকবে ১৩টি প্লাটুন। প্রতিটিতে ২০ জনের বেশি সদস্য থাকবেন। এছাড়া থাকবে পুলিশের ১৯টি স্ট্রাইকিং ফোর্স এবং মোবাইল টিম থাকবে ৫৭টি। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রচুর সদস্য মোতায়েন থাকবে, যাতে কোনো রকম বিশৃঙ্খলা না হয়। যারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করবে, তারা যে দলেরই হোক না কেন তাদের আইনের আওতায় আনার জন্য বলা হয়েছে।’
এদিকে গতকাল বিকালে গাজীপুর সার্কিট হাউজে নির্বাচন নিয়ে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় উপস্থিত সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানা বলেছেন, ‘আমাদের কাছে সব ইলেকশনই সমান গুরুত্বপূর্ণ। গাজীপুর সিটি নির্বাচনের ক্ষেত্রে আমাদের আলাদা কোনো চ্যালেঞ্জ নেই। আমাদের ওপর কোনো চাপ নেই। আমাদের পক্ষ থেকেও কারো ওপর কোনো চাপ নেই। যার যার মতো সে সে নির্বাচনের কাজ করছেন। তাতে কোনো অসুবিধা নেই।’
ভোটারদের নির্ভয়ে, নিঃসংকোচে কেন্দ্রে আসার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা চাই ভোটারদের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু, সুন্দর ও নিরপেক্ষ একটা ভোট হোক। এটা নিয়ে আমাদের নির্বাচন কমিশনের মেসেজ হলো সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান। এতে কোনো ধরনের ব্যত্যয় হওয়ার সুযোগ নেই। আমরা এটাই করব, এটা করার জন্যই সচেষ্ট। অবশ্যই আপনারা (ভোটার) কেন্দ্রে নির্ভয়ে আসবেন।’
তিনি আরো বলেন, ‘গাজীপুর মহানগর পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। ওনাকে আমি বলেছি, নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ যাতে কোনোভাবেই বিঘ্নিত না হয়। উনি আমাকে নিশ্চিত করে বলেছেন, ভোটাররা যাতে সুষ্ঠু পরিবেশে ভোট দিতে পারে, তা নিশ্চিত করব।’
মেয়র প্রার্থীরা কে কোথায় ভোট দেবেন: আওয়ামী লীগ প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খান টঙ্গীর আরিচপুর মসজিদ রোডের দারুস সালাম মাদ্রাসা কেন্দ্রে ভোট দেবেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুন ও তার ছেলে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর আলম ভোট দেবেন জয়দেবপুরের কানাইয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্কুল কেন্দ্রে। এছাড়া জাতীয় পার্টির এমএম নিয়াজ উদ্দিন টঙ্গীর আউচপাড়ার কলেজ রোড এলাকার নিউ ব্লোন স্কুল কেন্দ্রে, স্বতন্ত্র প্রার্থী সরকার শাহনূর ইসলাম রনি সরকার টঙ্গীর শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতাল কেন্দ্রে, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের গাজী আতাউর রহমান আরিচপুর এলাকায় সিরাজ উদ্দিন সরকার বিদ্যা নিকেতন অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে ভোট দেবেন।