পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় দক্ষিণাঞ্চলে যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন এসেছে। এক বছরেই এ অঞ্চলের আর্থসামাজিক উন্নয়নের দুয়ার খুলেছে এই সেতু। ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে জীবনযাপনের ভাবনায়ও।
বছর খানেক আগেও খুলনা অঞ্চলের মানুষ রাজধানী থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। উৎপাদিত কৃষিপণ্যের যথাযথ বাজারজাত করার সুযোগ না থাকায় মুখ থুবড়ে পড়েছিল কৃষি। পদ্মা সেতুর কল্যাণে পিছিয়ে পড়া কৃষিতে গতি পেয়েছে। এতে পাল্টে গেছে অর্থনীতির গ্রাফ ও মানুষের জীবনমান। যাতায়াতে গতি আসায় গড়ে উঠছে নতুন নতুন শিল্প কারখানা।
স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালুর পর দেশের দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থার পুরো চিত্রই পাল্টে গেছে। যাত্রী পরিবহন কিংবা পণ্য পরিবহন এখন অনেক সহজ ব্যাপার। সুন্দরবনে পর্যটক বেড়েছে দেড়গুণেরও বেশি। গত এক বছরে পদ্মা সেতু হয়ে খুলনা থেকে ঢাকা রুটে বিলাসবহুল দ্বিতল বাসসহ নতুন পরিবহন বেড়েছে দেড়শ’রও বেশি। যাত্রীও বেড়েছে। দিনে একটি পরিবহন তিনবারও যাতায়াত করতে পারছে। এতে সন্তুষ্টির হাসি পরিবহন ব্যবসায়ীদের মুখে। এসব পরিবর্তন এ অঞ্চলের মানুষের ভাবনায় ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে।
পরিবহন ব্যবসায়ী নুরুল হক লিপন বলেন, পদ্মা সেতু চালুর পর থেকেই আমরা সুফল পেতে শুরু করেছি। এ অঞ্চলে পরিবহন ব্যবসায় নতুন দিগন্তের সূচনা হয়েছে। ঢাকার সব বড় বড় ব্যবসায়ী খুলনা অঞ্চলে পরিবহন ব্যবসা শুরু করেছেন। নতুন নতুন বাস এসেছে। যাত্রীও বেড়েছে। আগে একটা বাস আমরা দিনে একবার ঢাকায় পাঠাতে পারতাম। এখন দিনে তিনবারও ট্রিপ দেয় একটি বাস। সব মিলিয়ে পরিবহন ব্যবসা চাঙা। সব কিছুই পদ্মা সেতুর জন্য।
শুধু যাত্রী পরিবহন না। পণ্য পরিবহনেও নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে পদ্মা সেতু। বিশেষ করে খুলনা অঞ্চল থেকে কৃষিপণ্য পরিবহনের হার বেড়েছে। ফেরিঘাটে আগে যেখানে অর্ধেক কৃষিপণ্যই নষ্ট হতো, এখন সেখানে পুরো কৃষিপণ্যই টাটকা অবস্থায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চলে যেতে পারছে। ফলে এ অঞ্চলে কৃষিপণ্যের উৎপাদনও বাড়ছে।
কৃষি বিপণন অধিদফতরের খুলনা বিভাগীয় উপপরিচালক জিএম মহিউদ্দিন বলেন, তৃণমূল পর্যায়ে কৃষকরা এখন অনেক ভালো আছেন। আমাদের কাছে থাকা পরিসংখ্যান অনুযায়ী খুলনা থেকে অনেক বেশি কৃষিপণ্য এখন দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হচ্ছে। এতে কৃষকরা কৃষিপণ্য উৎপাদনেও আগ্রহী হচ্ছেন। ফলে কৃষি উৎপাদন বাড়ছে। যা সামগ্রিকভাবে এ অঞ্চলের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে।
পদ্মা সেতুর সুফল পাচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলের পর্যটন খাতও। বিশেষ করে সুন্দরবনকেন্দ্রিক পর্যটক বেড়েছে। বন বিভাগের তথ্যমতে, সবশেষ ১০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক পর্যটক এবার সুন্দরবন ভ্রমণ করেছেন। আর তাতে সর্বোচ্চ রাজস্বও পেয়েছে সরকার।
সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. আবু নাসের মহসিন কামাল বলেন, ‘পর্যটন খাত অনেকটা এগিয়ে গেছে খুলনায়। গত ১০ বছরের মধ্যে এবারই সর্বোচ্চ সংখ্যক দেশি ও বিদেশি পর্যটক সুন্দরবন ভ্রমণ করেছেন। সুন্দরবনে আমাদের নতুন চারটি ইকো ট্যুরিজম সেন্টার তৈরি হচ্ছে। এগুলোর কাজ সম্পন্ন হলে আমাদের পর্যটক সংখ্যা আরও বাড়বে।’
তবে মহাসড়কের পাশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে জমি থাকলেও ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, গ্যাস সরবরাহের অভাবে প্রত্যাশিতভাবে গড়ে উঠেনি শিল্প-কারখানা।
খুলনা চেম্বার অব কমার্সের পরিচালক জেড এ মাহমুদ ডন বলেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রত্যাশার চাইতেও বেশি সুফল পেতে শুরু করেছি পদ্মা সেতুর কল্যাণে। তবে পুরোপুরি সফলতা পেতে আমাদের আরও কিছু সময় লাগবে। মূলত এখানে প্রত্যাশিতভাবে শিল্প কারখানা গড়ে উঠছে না গ্যাস সরবরাহের অভাবে। গ্যাস সরবরাহ শুরু হলেই এ অঞ্চলে একের পর এক শিল্প কারখানা গড়ে উঠবে, তাতে এ অঞ্চল অর্থনীতিতে আরও সমৃদ্ধ হবে।
সামগ্রিকভাবে দক্ষিণাঞ্চলের আর্থসামাজিক অবস্থানের পরিবর্তন হতে শুরু করেছে বলে জানিয়ে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলেন, ‘পদ্মা সেতুর মাধ্যমে দেশের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সমতাভিত্তিক অর্থনীতি বাস্তবায়ন হয়েছে। এ অঞ্চলের মানুষের গড় আয় বাড়তে শুরু করেছে।’
আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করা হয়। সময়টা ছিল ২০২২ সালের ২৫ জুন। সেদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে সেতুর মাওয়া প্রান্তে টোল দিয়ে প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে পদ্মা সেতু পার হন এবং এর মধ্য দিয়ে দক্ষিণের ২১টি জেলার সঙ্গে রাজধানীর সরাসরি সড়কপথে যোগাযোগ উন্মোচিত হয়।
২৬ জুন যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয় পদ্মা সেতু। সেই হিসাবে আজ রোববার (২৫ জুন) পদ্মা সেতুর এক বছর পূর্ণ হলো।
পদ্মা সেতুর নির্মাণ-
বাংলাদেশের ইতিহাসে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ ছিল সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং কাজ। দুইস্তর বিশিষ্ট ইস্পাত ও কংক্রিট নির্মিত এই সেতুর ওপরের স্তরে চার লেনের সড়ক পথ এবং নিচের স্তরে একটি একক রেলপথ রয়েছে। পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদীর অববাহিকায় তৈরি সেতুটি ৪১টি স্প্যান নিয়ে গঠিত, প্রতিটি স্প্যান লম্বায় ১৫০ দশমিক ১২ মিটার বা ৪৯২ দশমিক ৫ ফুট এবং চওড়ায় ২২ দশমিক ৫ মিটার বা ৭৪ ফুট। সেতুটির মোট দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার বা ৩ দশমিক ৮২ মাইল। এটি বাংলাদেশের দীর্ঘতম সেতু। ১২০ মিটার বা ৩৯০ ফুট গভীরতাযুক্ত বিশ্বের গভীরতম পাইলের সেতু এটি।