২০১৪-১৫ ও ২০১৫-১৬ অর্থবছরে পাঁচটি এমআরআই মেশিন এবং তিনটি সিটি স্ক্যান মেশিন কিনেছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সেন্ট্রাল মেডিকেল স্টোরস ডিপো। এতে তখন খরচ হয় ৮৭ লাখ ৫৫ হাজার ডলার। বিক্রয়োত্তর সেবার মেয়াদ পেরিয়ে যাওয়ায় যন্ত্রগুলো এখন হাসপাতালে অকেজো পড়ে আছে। এতে ব্যাহত হচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা। এ কারণে রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে মেশিনগুলো সচল করার উদ্যোগ নেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। কিন্তু সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান এ জন্য যে অর্থ চেয়েছে তা অস্বাভাবিক, যার পরিমাণ মেশিনগুলোর ক্রয়মূল্যের ৭২ শতাংশ।
সরকারি হাসপাতালের মেডিকেল যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ‘ন্যাশনাল ইলেকট্রো-মেডিকেল ইকুইপমেন্ট মেইনটেন্যান্স ওয়ার্কশপ অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টারের (নিমিউ অ্যান্ড টিসি)। এটি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীন একটি প্রতিষ্ঠান। হাসপাতালের কোনো মেশিনের বিক্রয়োত্তর সেবার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে তা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সংশ্লিষ্ট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে নিমিউ অ্যান্ড টিসি, যাকে বলা হয় ‘কমপ্রিহেন্সিভ মেইনটেন্যান্স কন্ট্রাক্ট (সিএমসি)’।
অকেজো পড়ে থাকা পাঁচটি এমআরআই এবং তিনটি সিটি স্ক্যান মেশিন রক্ষণাবেক্ষণেও সিএমসি করতে চেয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। কিন্তু এ জন্য ৬৩ লাখ ২৮ হাজার ৬৫৭ ডলার খরচ প্রস্তাব করেছে নিমিউ অ্যান্ড টিসি। যদিও মেশিনগুলো কেনাই হয়েছে ৮৭ লাখ ৫৫ হাজার ডলারে। এত বিপুল অর্থে চিকিৎসাযন্ত্র রক্ষণাবেক্ষণের এই প্রস্তাব নাকচ করেছে মন্ত্রণালয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম আজকের পত্রিকাকে বলেন, সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সিএমসি বাবদ যে ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে, সেটি বাস্তবসম্মত নয়। তাই এত উচ্চমূল্যে সিএমসি করা সম্ভব নয়। বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টিতে আনা হয়েছে। এত উচ্চমূল্যে সিএমসি করা হবে, নাকি নতুন মেশিন কেনা হবে—সেই সিদ্ধান্ত মন্ত্রণালয় নেবে। তবে যন্ত্রগুলো বিকল থাকায় বড় হাসপাতালগুলোর স্বাভাবিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যাহত হচ্ছে।
পরপর দুই অর্থবছরে কেনা পাঁচটি এমআরআই মেশিনের মধ্যে দুটি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং একটি করে রাজশাহী ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। একটি মেশিন পাঠানো হয় জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে (পঙ্গু হাসপাতালে)। এ ছাড়া তিনটি সিটি স্ক্যান মেশিনের একটি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে, একটি ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টারে (নিলমার) এবং একটি পঙ্গু হাসপাতালে আছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো একটি এমআরআই মেশিন কেনা হয় ১১ লাখ ৮৯ হাজার ডলারে। আগামী পাঁচ বছর সেটির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দাবি করা হয়েছে ৫ লাখ ২১ হাজার ৭৫০ ডলার। এ ক্ষেত্রে প্রতিবছরের জন্য ক্রয়মূল্যের ৭ দশমিক ৯৯ শতাংশ হারে রক্ষণাবেক্ষণ খরচ প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে থাকা তিনটি এমআরআই মেশিনের প্রতিটি ১২ লাখ ৩০ হাজার ডলারে কেনা হয়েছিল। এখন সেগুলোর জন্য বছরে ৭ দশমিক ৯৪ শতাংশ হারে প্রতিটির পেছনে ৭ লাখ ৭০ হাজার ডলার করে সিএমসি ব্যয় দাবি করছে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। পঙ্গু হাসপাতালে পাঠানো একই ব্র্যান্ডের একই মডেলের এমআরআই মেশিনের ক্রয়মূল্য ছিল ১২ লাখ ৫০ হাজার ডলার। অথচ এটির জন্য বছরে সিএমসি ব্যয় দাবি করা হয়েছে ক্রয়মূল্যের ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ হারে। পাঁচ বছরের জন্য যার পরিমাণ দাঁড়ায় ১১ লাখ ৫৬ হাজার ডলার।
এ ছাড়া ঢামেক হাসপাতালের একটি সিটি স্ক্যান মিশনের ক্রয়মূল্য ছিল ৭ লাখ ৬৮ হাজার ডলার, যার সিএমসি দাবি করা হয়েছে ৩ লাখ ৭৫ হাজার ডলার।ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টারের সিটি স্ক্যান মেশিনের ক্রয়মূল্য ছিল ২ লাখ ৪৩ হাজার ৮৭১ ডলার, সিএমসি দাবি করা হয়েছে ১১ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ হারে, ৩ লাখ ৯৫ হাজার ডলার। এ ছাড়া পঙ্গু হাসপাতালের সিটি স্ক্যান মেশিনটির ক্রয়মূল্য ছিল ১০ লাখ ৯০ হাজার ডলার, এটির সিএমসি দাবি করা হয়েছে ৭ দশমিক ৪০ শতাংশ বা ৬ লাখ ৫১ হাজার ডলার। সিএমসির প্রস্তাবিত এই মূল্য কর্তনযোগ্য এআইটি ও ভ্যাট ছাড়াই।অর্থাৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিলে এআইটি ও ভ্যাট বাবদ এর সঙ্গে আরও অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হবে সরকারকে।
প্রসঙ্গত, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নিয়মানুযায়ী সিএমসির ক্ষেত্রে ক্রয়মূল্যের সর্বোচ্চ ৬ দশমিক ৫ শতাংশ অর্থ বরাদ্দ করা সম্ভব। কিন্তু এই সাতটি মেশিনের কোনোটির প্রস্তাবিত সিএমসি ব্যয় ৬ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে নেই। দুটির ক্ষেত্রে তো ক্রয়মূল্যের ১১ শতাংশের বেশি অর্থ চাওয়া হয়েছে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য।
এ ধরনের অস্বাভাবিক প্রস্তাবের বিষয়ে জানতে নিমিউ অ্যান্ড টিসির চিফ টেকনিক্যাল ম্যানেজার (উপসচিব) জয়ন্ত কুমার মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।