পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা পদের নিয়োগ প্রক্রিয়া সাড়ে ৩ বছর ধরে আটকে আছে। চাকরিপ্রত্যাশীদের লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হলেও অজ্ঞাত কারণে চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করা হচ্ছে না। আবেদনের পর থেকে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ না হওয়ায় হতাশায় ভুগছেন চাকরিপ্রার্থীরা। তাদের অভিযোগ পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের একটি অসাধু চক্রের ইশারায় পরীক্ষা বাতিলের পাঁয়তারা করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে চিকিৎসা শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিব, মো. আজিজুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, বিষয়টি ডিজি সাহেব ভালো বলতে পারবেন। কি ধরনের সমস্যার কারণে দীর্ঘ সাড়ে তিন বছরেও একটি নিয়োগ ঝুলে থাকল জানতে চাইলে সচিব বলেন, আমি তো এখানে এতদিন ছিলাম না। লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা বাতিল হচ্ছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে সচিব বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের ডিজির সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে জানা গেছে তিনি অফিসের বাহিরে আছেন। পরে তার সেল নম্বরে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
জানা গেছে, পরিবারকল্যাণ পরিদর্শিকার ১ হাজার ৮০টি শূন্য পদে নিয়োগের জন্য ২০২০ সালের ১০ মার্চ নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। এ পদে শুধু নারী প্রার্থীদের আবেদনের সুযোগ ছিল। নিয়োগ পাওয়ার পর ১৮ মাসের প্রশিক্ষণ শেষে মাঠপর্যায়ে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রে দায়িত্বপালন করার কথা। তারা মাতৃস্বাস্থ্য, শিশুস্বাস্থ্য, প্রজনন স্বাস্থ্য পরিবার পরিকল্পনা, পুষ্টি, সাধারণ রোগ ব্যাধি ও অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের সেবায় নিয়োজিত হওয়ার কথা। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের দীর্ঘ তিন বছর পর গত ফেব্রুয়ারি মাসে লিখিত পরীক্ষা নেওয়া হয়।
সূত্র জানায়, দেশের সব জেলায় লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেন প্রায় সাড়ে তিন লাখ প্রার্থী। এর মধ্যে ৭ হাজার ৬২১ জন মৌখিক পরীক্ষার জন্য নির্বাচিত হন। কিন্তু লিখিত পরীক্ষা নিয়ে নিয়োগ কমিটির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। নিয়োগ কমিটি বাতিল করে সরিয়ে দেওয়া হয় পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের (পরিচালক প্রশাসন ও নিয়োগ কমিটির সভাপতি) মো. রেজাউল করিম খান এবং নিয়োগ কমিটির সদস্য সচিব উপপরিচালক সারাউল্লাহ নদীকে। এরপর নতুন নিয়োগ কমিটি গঠন করে ২২ মে থেকে ১৮ জুন পর্যন্ত ৫টি ভাইভা বোর্ডের মাধ্যমে মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, যেহেতু লিখিত পরীক্ষায় অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ছিল, সেহেতু মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণের সময় লিখিত পরীক্ষার উত্তরপত্র পরীক্ষকদের হাতে রেখেই চাকরিপ্রত্যাশীকে উত্তর লিখতে দেওয়া হয়। যারা লিখতে পেরেছে এবং হাতের লেখা উত্তরপত্রের নম্বরের সঙ্গে মিলে গেছে তারা ভাইভায় ভালো নম্বর পেয়েছেন। এতে অনিয়মের আশ্রয় নেওয়া চাকরিপ্রত্যাশীরা বাদ পড়ে গেছেন। মৌখিক পরীক্ষায় ভালো করতে না পারায় এবার লিখিত পরীক্ষা বাতিলের জন্য তৎপর হয়ে উঠে দুর্নীতিবাজরা। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা এখন পরীক্ষা বাতিলে তৎপর হয়ে উঠেছে বলে জানা গেছে। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসক) এএইচএম লোকমান যুগান্তরকে বলেন, লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর কিছু অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে চিকিৎসা শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিব আগের কমিটি বিলুপ্ত করে ভাইভার জন্য নতুন কমিটি গঠন করেন। একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে মোট পাঁচটি ভাইভা বোর্ড করা হয়।
প্রতিটি ভাইভা বোর্ডে পাঁচজন করে সদস্য ছিলেন। প্রতিটি ভাইভা বোর্ডে জনপ্রশাসন ও বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের একজন করে প্রতিনিধি ছিলেন। স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের দুজন এবং পরিবার-পরিকল্পনা অধিদপ্তরের একজন সদস্য ছিলেন।
প্রতিদিন প্রতিটি বোর্ড মৌখিক পরীক্ষার আগে নিয়োগ কমিটির নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত সভাপতি ও পাঁচটি বোর্ডের পাঁচজন বোর্ড সভাপতির উপস্থিতিতে লটারির মাধ্যমে রোল নম্বর বণ্টন করে স্বচ্ছতার সঙ্গে ভাইভা নেওয়া হয়। কে কোন বোর্ডে পড়ছেন তা আগে থেকে জানার কোনো উপায় ছিল না। এরপরও মৌখিক ও লিখিত পরীক্ষা বাতিল করা হচ্ছে কি না এমন এক প্রশ্নের জবাবে পরিচালক প্রশাসন বলেন, লিখিত পরীক্ষা নিয়ে অভিযোগ উঠার পর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সেই কমিটির রিপোর্ট কয়েক দিন আগে পেয়েছি। কি সিদ্ধান্ত হবে তা এখন বলতে পারছি না। ভাইভা বোর্ডের এক কর্মকর্তা বলেন, লিখিত পরীক্ষায় অনেকে দুর্নীতি করে পার পেলেও মৌখিক পরীক্ষায় শুধু যোগ্য প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়েছেন। লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় আলাদা আলাদাভাবে পাশ-ফেল নিয়ম থাকায় চূড়ান্ত ভাবে নির্বাচিত হতে দুই পরীক্ষাতেই পাশ করতে হবে প্রার্থীদের। একাধিক চাকরি প্রত্যাশী যুগান্তরকে বলেন, শোনা যাচ্ছে চিকিৎসা শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ থেকে পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা নিয়োগের লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা বাতিলের জন্য ফাইল তোলা হচ্ছে। মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্তারাই পরীক্ষা বাতিল করতে চাইছেন। তারা আরও জানান, যখন লিখিত পরীক্ষা নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ ছিল তখন বাতিল না করে ভাইভা নেওয়া হলো। ভাইভা যখন স্বচ্ছ হয়েছে তখন পরীক্ষা বাতিলের চেষ্টা করা হচ্ছে। কারণ যাদের কাছ থেকে টাকা নেওয়া হয়েছে তারা ভাইভায় ভালো করতে পারেনি। সেই কারণে এখন পরীক্ষা বাতিলের চেষ্টা করা হচ্ছে।