০২ মে ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ০৮:২৮:২৮ পূর্বাহ্ন
নারীর জটিল রোগ প্রসবজনিত ফিস্টুলা
  • আপডেট করা হয়েছে : ২০-০৮-২০২৩
নারীর জটিল রোগ প্রসবজনিত ফিস্টুলা

নারীর জন্য গর্ভধারণ একটি স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া। কিন্তু গর্ভ অথবা প্রসবকাল কম-বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। প্রসবকালে একজন নারীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এই সময়ের অন্য অনেক জটিলতা ও সমস্যার মধ্যে ভয়াবহ একটি হচ্ছে প্রসবজনিত ফিস্টুলা।


জেনিটাল ফিস্টুলা হলো নারীর জননপথের সঙ্গে মূত্রথলি বা মূত্রনালি বা মলদ্বার অথবা উভয়ের একটি অস্বাভাবিক সংযোগ স্থাপিত 

হওয়া। ফলে জননপথ দিয়ে অনবরত নিয়ন্ত্রণহীন প্রস্রাব বা পায়খানা বা উভয়ই ঝরতে থাকে।


এর প্রধান কারণ হচ্ছে বাধাগ্রস্ত প্রসব। তবে অপারেশন অথবা আঘাতের কারণেও এটা হতে পারে। যখন এটা প্রসবের কারণে হয়, তখন 

তাকে বলে প্রসবজনিত ফিস্টুলা। বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশসমূহে প্রসবজনিত ফিস্টুলা রোগী বেশি দেখা যায়। 


যেভাবে হয়

মানবদেহের তলপেট ও কোমরের নিচে যে হাড়গুলো থাকে, সেগুলোকে একত্রে শ্রোণিচক্র বা বস্তিকোটর অথবা ইংরেজিতে পেলভিস বলে। শ্রোণিচক্রের হাড় দিয়ে তৈরি গহ্বরে থাকে নারী-পুরুষের প্রজনন অঙ্গ, মূত্রথলি, মলাশয় ও মলদ্বার। প্রসবকালে জরায়ুর নিচের অংশ স্ফীত হয়ে জননপথের সঙ্গে মিলিত হয়ে পূর্ণাঙ্গ প্রসবপথ তৈরি হয়। প্রাকৃতিক নিয়মে এই পথেই একজন মানবশিশু মাতৃগর্ভ থেকে বের হয়ে পৃথিবীর আলো দেখে। কিন্তু প্রাকৃতিক নিয়মে, অর্থাৎ জননপথে প্রসব হওয়ার বেশ কিছু শর্ত থাকে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান শর্ত হলো, গর্ভস্থ শিশুর ওজন বা মাথার আকৃতির সঙ্গে মায়ের শ্রোণিচক্রের সমতা থাকতে হবে। অর্থাৎ, মায়ের শ্রোণিচক্রের তুলনায় গর্ভস্থ শিশুর মাথা বা শরীর বড় হলে অথবা মায়ের শ্রোণিচক্র প্রয়োজনের তুলনায় ছোট হলে সেই পথে শিশু বের হয়ে আসতে পারে না। এটাকেই বলে বাধাগ্রস্ত প্রসব।


প্রসব যখন বিলম্বিত ও বাধাগ্রস্ত হয়, তখন শিশুর মাথা দীর্ঘক্ষণ প্রসবপথে আটকে থাকে। ফলে মায়ের প্রসবপথের আশপাশের নরম অঙ্গগুলো মায়ের শ্রোণিচক্রের হাড় এবং শিশুর মাথা দিয়ে ক্রমাগত আঘাতপ্রাপ্ত হতে থাকে। অনবরত এই চাপের ফলে মায়ের অঙ্গের পিষ্ট অংশে রক্ত চলাচল ব্যাহত হয় অথবা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। এ অবস্থায় অঙ্গের পিষ্ট অংশে পচন ধরে এবং পরবর্তী সময়ে সাধারণত পাঁচ থেকে সাত দিনের মধ্যে খসে পড়ে। এর ফলে জননপথ এবং প্রস্রাব বা পায়খানার রাস্তা অথবা উভয়ের মধ্যে ছিদ্র তৈরি হয়। আর এই অস্বাভাবিক ছিদ্রপথে অনবরত প্রস্রাব বা পায়খানা বা উভয়ই ঝরতে থাকে। এ রকম অবস্থায় মা সাধারণত মৃত বা মৃতপ্রায় সন্তান প্রসব করে থাকে। 


প্রসবজনিত ফিস্টুলার ঝুঁকি যাদের বেশি


বাল্যবিবাহ এবং কম বয়সে গর্ভধারণ করলে: ১৮ বছর বা তার চেয়ে কম বয়সী নারীর প্রসবপথ অপূর্ণাঙ্গ থাকে, যা স্বাভাবিকভাবে সন্তান জন্মদানের জন্য উপযুক্ত নয়।

বহু সন্তানের জননী: পূর্বে দুই বা তিনের বেশি সন্তান প্রসব করেছেন এমন নারী। সাধারণত প্রথম শিশুর চেয়ে দ্বিতীয়, দ্বিতীয় শিশুর চেয়ে তৃতীয়—এভাবে ক্রমান্বয়ে গর্ভস্থ শিশুর ওজন বাড়তে থাকে। পাশাপাশি মায়ের শ্রোণিচক্রের প্রসারণক্ষমতা কমতে থাকে। ফলে প্রথম বা দ্বিতীয় সন্তান জন্মদানের সময় প্রসবপথে ঝামেলা না হলেও তৃতীয় অথবা চতুর্থ সন্তানের ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত প্রসব হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়।

মায়ের উচ্চতা কম হলে: তার শ্রোণিচক্র দিয়ে স্বাভাবিক ওজনের শিশুর প্রসব ব্যাহত হতে পারে। সাধারণত বিত্তহীন নারীদের মধ্যে প্রসবজনিত ফিস্টুলা বেশি দেখা যায়। গর্ভবতী নারী অথবা তাঁর পরিবারের সদস্যদের গর্ভকালীন, প্রসবকালীন মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে সঠিক তথ্য এবং জ্ঞানের অপ্রতুলতাও এই রোগের জন্য দায়ী। 

রোগের জটিলতা শারীরিক সমস্যা

এই রোগীদের শরীরে প্রস্রাব বা পায়খানা অথবা উভয়ের তীব্র দুর্গন্ধ থাকে। ফিস্টুলা রোগীরা প্রস্রাব হওয়ার ভয়ে কম পানি পান করে বলে প্রস্রাবের ঘনত্ব বেড়ে যায়। ফলে মূত্রথলিতে পাথর হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। অনবরত এই প্রস্রাব ঝরার কারণে জননপথের আশপাশে চুলকানি, এমনকি ঘা পর্যন্ত হতে পারে।


রোগ নির্ণয়

পজিটিভ ডাই টেস্ট: মিথিলিন ব্লু নামক একধরনের রঙিন ওষুধ নল বা ক্যাথেটারের মাধ্যমে মূত্রথলিতে প্রবেশ করানো হয়। যদি ফিস্টুলা থাকে, তাহলে এই রং জননপথে বের হয়ে আসে। এতে বোঝা যায় রোগীর ফিস্টুলা আছে। এই পরীক্ষায় সময় লাগে এক থেকে 

দুই মিনিট। এই টেস্টের পর কেউ পজিটিভ নির্ণীত হলে তাঁদের উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়। 


রোগের চিকিৎসা

নিরাময়যোগ্য ও প্রতিরোধযোগ্য, প্রসবজনিত ফিস্টুলার দুই ধরনের চিকিৎসা আছে। 


নিরাময়যোগ্য

ফিস্টুলা রোগের একমাত্র চিকিৎসা হচ্ছে অপারেশন। বাংলাদেশে ১১টি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং সাতটি বেসরকারি হাসপাতালে সম্পূর্ণ বিনা খরচে এই রোগীদের অপারেশন করা হয়। 


প্রতিরোধযোগ্য


১৮ বছরের আগে নারীদের বিয়ে নয়, ২০ বছরের আগে গর্ভধারণ নয়।

গর্ভাবস্থায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মী দিয়ে কমপক্ষে নিয়মিত চারবার মায়ের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে হবে।

প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের সংখ্যা বাড়াতে হবে।

বাড়িতে প্রসবের সময় অবশ্যই প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী থাকতে হবে।

বিলম্বিত ও বাধাগ্রস্ত প্রসবের ক্ষেত্রে রোগীকে প্রস্রাবের থলিতে নল বা ক্যাথেটার পরিয়ে চার সপ্তাহ নলসমেত রাখতে হবে। এর ফলে মূত্রথলির রক্ত চলাচল প্রক্রিয়া ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসবে। এতে করে ছোট্ট ফিস্টুলা থাকলে সেটা ভালো হয়ে যেতে পারে। আর বড় ফিস্টুলা থাকলে আকারে ছোট হয়ে যেতে পারে। ফলে অপারেশন সফল হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা তৈরি হবে। এই সময়ে মা পর্যাপ্ত পানি ও তরল খাবার খাবেন। 


শেয়ার করুন