২৮ এপ্রিল ২০২৪, রবিবার, ১০:১১:৫৮ পূর্বাহ্ন
গরিবের কষ্টার্জিত অর্থ লুট হয়ে যাচ্ছে
  • আপডেট করা হয়েছে : ০২-০৯-২০২৩
গরিবের কষ্টার্জিত অর্থ লুট হয়ে যাচ্ছে

গত ২৭ আগস্ট দৈনিক আজকের পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় একটি সংবাদ শিরোনাম দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। শিরোনামটি ছিল, ‘নাসা গ্রুপের ২৬১ কোটি টাকা সুদ মাফ জনতা ব্যাংকের’। গত কয়েক বছর জনতা ব্যাংকের এমন আরও কিছু অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনা গণমাধ্যমে সংবাদ শিরোনাম হতে দেখেছি। এসব অপকর্ম ব্যাংকটির নামের প্রতি সুবিচার করতে পারছে না। ব্যাংকের নাম ‘জনতা ব্যাংক’ হলেও, দেশের জনতার প্রতিই সবচেয়ে বেশি অবিচার করছে। এ দেশের সাধারণ মানুষের কষ্টে অর্জিত অর্থ লুটপাটে তারাই বেশি সাহায্য করছে। এ ব্যাংকটি দেশের একশ্রেণির অর্থ লুণ্ঠনকারীর দোসর হয়ে লুটপাটে অন্য সব ব্যাংককে ছাড়িয়ে গেছে। এ খাতে ঋণখেলাপির ঘটনাই এর জন্য বেশি দায়ী। এক হিসাবে দেখা গেছে, গত তিন মাসে জনতা ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। গত মার্চে যেখানে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৬ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা, সেখানে জুনে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৮ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকা। সেই হিসাবে ঋণ বাবদ ব্যাংকের মোট যে পরিমাণ অর্থ বিতরণ করা হয়েছে, তার ৩০ দশমিক ৪৩ শতাংশই এখন খেলাপি। গত মার্চেও এ হার ছিল ১৬ দশমিক ১৫ শতাংশ। আশঙ্কার বিষয় হলো, ব্যাংকটির ঋণ বাবদ বিতরণ করা মোট ৯৪ হাজার ২০৭ কোটি টাকার মধ্যে প্রায় ৪২ শতাংশ, অর্থাৎ প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা দেশের চিহ্নিত তিনটি প্রভাবশালী শিল্প গ্রুপকে দেওয়া হয়েছে।


রাষ্ট্রমালিকানাধীন জনতা ব্যাংক একসময় দেশের একটি ভালো ব্যাংক হিসেবে পরিচিতি ছিল। এ ব্যাংকটি একসময় দেশের উদ্যোক্তাদের অর্থ জোগানের প্রধান উৎস ছিল। এই ব্যাংকের অর্থায়নেই অনেক শিল্পপতি সফল বাণিজ্যিক উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন।


আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ধীরে ধীরে ব্যাংকটি বিভিন্ন অর্থ কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ে। এরপরই ব্যাংক ছেড়ে একে একে চলে যেতে থাকে দেশে সুপরিচিত শিল্প গ্রুপগুলো। পরিবর্তে ব্যাংকটির শীর্ষ গ্রাহকের তালিকায় নাম লিখিয়ে নেয় ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের আশীর্বাদপুষ্ট বিতর্কিত ও নামসর্বস্বহীন কিছু প্রতিষ্ঠান। এসব চিহ্নিত গ্রাহকের কাছে শুধু জনতা ব্যাংকই নয়, দেশের সব অর্থনৈতিক খাতই আজ জিম্মি। জনতা ব্যাংকের অবস্থা বর্তমানে এমন জায়গায় এসে পৌঁছেছে, দেশের পুরো ব্যাংক খাতের সার্বিক খেলাপি ঋণ যেখানে ১০ শতাংশেরও কম, সেখানে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ তিন গুণের বেশি। ব্যাংকটি এখন দেশের খেলাপি ঋণে শীর্ষে অবস্থান করছে।


আজকের পত্রিকার সংবাদ শিরোনামের বিষয়ে ফিরে আসি। আলোচিত নাসা গ্রুপ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত জনতা ব্যাংকের পাওনা ছিল ৪১৬ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। জানা গেছে, নাসা গ্রুপের নজরুল ইসলাম মজুমদার প্রথমে সাউথইস্ট ব্যাংক থেকে ৫০ কোটি ৯০ লাখ টাকা এবং ইসলামী ব্যাংক থেকে ৭০ কোটি টাকার প্রকল্প ঋণ নিয়ে যথাসময়ে পরিশোধ করতে ব্যর্থ হন। ২০০৮ সালে জনতা ব্যাংক এই দুটি ব্যাংক থেকে নজরুল ইসলাম মজুমদারের নেওয়া প্রকল্প ঋণ দুটি কিনে নেয়। কিন্তু নাসা গ্রুপ নিয়মিত ঋণ পরিশোধ না করায় ২০১৩ সালে খেলাপিতে পরিণত হয়। এরপর তিনি ঋণ খেলাপিমুক্ত রাখতে উচ্চ আদালতে একের পর এক রিট করে যান। এভাবে তিনি ১১ দফা রিট করে আদালতের সাহায্যে ঋণ নিয়মিত দেখিয়ে আসছিলেন। পরে সুদ মওকুফ সুবিধা পেতে জনতা ব্যাংকে আবেদন করলে, ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদ অর্থ মন্ত্রণালয় এবং জনতা ব্যাংকের নিয়মকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অনুমোদন করে; অর্থাৎ ৪১৬ কোটি ৯৮ লাখ টাকার বিপরীতে আরোপিত সুদের ৭ কোটি ৩০ লাখ এবং অনারোপিত সুদের শতভাগ হিসাবে ২৫৩ কোটি ৫৬ লাখ টাকা, অর্থাৎ মোট ২৬০ কোটি ৮৬ লাখ টাকার সুদ পরিচালনা পর্ষদ মওকুফের সুপারিশ করে। সুদ মওকুফ-সুবিধা দেওয়ার বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষক আপত্তি তোলেন। কিন্তু পরিচালনা পর্ষদ সেই আপত্তি আমলেই নেয়নি। পরে পর্যবেক্ষক বিষয়টি লিখিতভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে জানালে বাংলাদেশ ব্যাংক জনতা ব্যাংকের এমডির কাছে ব্যাখ্যা চেয়ে চিঠি দেয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সেই চিঠি পাত্তা না দিয়ে জনতা ব্যাংকের তৎকালীন এমডি জবাব দেওয়া থেকে বিরত থাকেন। নাসা গ্রুপের ৪১৬ কোটি ৯৮ লাখ টাকা বকেয়া ঋণ থেকে ২৬০ কোটি ৮৬ লাখ টাকা মওকুফ করায় ঋণ কমে দাঁড়ায় ১৫৬ কোটি ১২ লাখ টাকা। সব নিয়ম ভঙ্গ করে অবৈধ পথে পাওয়া এই সুযোগ নজরুল ইসলাম মজুমদার সঙ্গে সঙ্গে কাজে লাগান। তিনি ১৫৬ কোটি ১২ লাখ টাকা জনতা ব্যাংকের লোকাল অফিসে পরিশোধ করে দেন।


দেশে এখন ব্যাংকিং খাতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় লুটপাটের অর্থনীতি চালু আছে। আর এই লুটপাটের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে খেলাপি ঋণ। এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৭৭ শতাংশ খেলাপি ঋণ রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার কারণে হয়েছে। ওই গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০১৯ সালে আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন আ হ ম মুস্তফা কামালকে সরকারের অর্থমন্ত্রীর গদিতে বসান, তারপর থেকেই খেলাপিদের লাই দেওয়া শুরু হয়েছে। দেশে একের পর এক আইনি সুবিধা দিয়ে ক্ষমতার রাজনীতি করেন–এমন বড় বড় চিহ্নিত অর্থ লুটপাটকারী মাফিয়াকে ঋণখেলাপির তালিকার বাইরে রাখার সুবিধা করে দেওয়া হয়েছে। আ হ ম মুস্তফা কামাল অর্থমন্ত্রী হওয়ার পরপরই ঋণের ২ শতাংশ কিস্তি দিয়ে খেলাপি ঋণ নিয়মিত রাখার সুযোগ করে দেওয়া হয়। এই নিয়মে ঋণ পরিশোধের জন্য ১০ বছর সময় দেওয়া হয়েছে, যার প্রথম বছরে কোনো কিস্তি দিতে হয়নি। দেখা গেছে, দেশের মুখ চেনা বড় বড় ঋণখেলাপি এই সুযোগ নিয়ে খেলাপিদের তালিকা থেকে নিজেদের নাম খারিজ করে নিয়েছেন; অর্থাৎ ২০২৯ সাল পর্যন্ত গরিবের অর্থখেকো চিহ্নিত এই লুটেরাদের আর ঋণখেলাপি বলা যাবে না। অথচ এসব লুটেরার দল খেলাপি ঋণের বেশির ভাগ অর্থ মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, কানাডা ও দুবাইয়ে পাচার করে দিয়েছে।


এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত ১৩ বছরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ছয় গুণের বেশি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় আসে, তখন বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার কোটি টাকা। এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ীই তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। কিন্তু দেশের অর্থনীতিবিদেরা এ হিসাব মানতে রাজি নন। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও বলছে, বাংলাদেশ ব্যাংক যে হিসাব দিচ্ছে, তা যথাযথ নয়। তাদের হিসাবে, এর পরিমাণ প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকা। দেশের অর্থনীতিবিদদের মতে, খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। যুক্তি হিসেবে তাঁরা হিসাব মিলিয়ে দিয়ে বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের দেখানো ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকার বাইরেও প্রায় ২ লাখ কোটি খেলাপি ঋণের টাকার বিষয়ে ঋণগ্রাহকেরা বছরের পর বছর ধরে মামলা ঝুলিয়ে রাখছেন; অর্থাৎ যত দিন মামলাগুলো চলবে, তত দিন ওই ২ লাখ কোটি টাকার ঋণ খেলাপি হিসেবে গণ্য করা হবে না। একইভাবে অবলোপন করা ৫৫ হাজার কোটি টাকাও বাংলাদেশ ব্যাংকের রিপোর্টে খেলাপি হিসাবে দেখানো হয় না।


দেশে ও দেশের বাইরের খেটে খাওয়া মানুষ, বিশেষ করে প্রবাসীরা রাত-দিন খেটে যতটুকু বৈদেশিক মুদ্রা ব্যাংকিং চ্যানেল কিংবা হুন্ডির মাধ্যমে দেশে পাঠান, তা ব্যাংকে আমানত হিসেবে জমা হয়। যে কারণে দেশের কোনো ব্যাংকই আমানতের ঘাটতির সম্মুখীন হয় না।


অথচ এই আমানতই লুট করে নিয়ে যাচ্ছে প্রভাবশালী গোষ্ঠী। ঋণের নামে সরকারের ঘনিষ্ঠ কেউ ২২ হাজার কোটি এবং কেউ ৪০ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পর চারদিকে শোরগোল শুরু হলেও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীকে যখন মুখ বুজে থাকতে দেখি, তখন দেশের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে বাদবাকি হিসাবটুকু বুঝে নিতে সমস্যা হয় না।


বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অতিকষ্টে অর্জিত যে অর্থ বিশ্বাস করে ব্যাংকে গচ্ছিত রাখেন, সেই কষ্টে অর্জিত অর্থ চোখের সামনে যখন লুট হয়ে যায়, তখন নাগরিক হিসেবে আমাদের বুকের ভেতর রক্তক্ষরণ হয়। এ দেশের চিহ্নিত লুটেরার দল ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করে দেশের বাইরে পাচার করে দিলেও রাষ্ট্রের ক্ষমতাধরেরা তা দেখেও দেখেন না। অর্থনীতিবিদেরা বলেন, তাঁদেরই কারও না কারও যোগসাজশে গরিবের কষ্টে অর্জিত এই অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। অথচ তারপরও যখন দেখি তাঁদের নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিরা ক্ষমতার জোশে, দেশের কীর্তিমান মানুষদের গরিবের রক্তচোষা বলে গালমন্দ করছেন, তখন তাঁদের লজ্জাবোধ না হলেও, আমাদের হয়।


শেয়ার করুন