২২ নভেম্বর ২০২৪, শুক্রবার, ০৫:১৭:১৫ পূর্বাহ্ন
হাজার কোটি টাকার তহবিল, ঋণ বিতরণ মাত্র ৫ কোটি
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৫-১০-২০২৩
হাজার কোটি টাকার তহবিল, ঋণ বিতরণ মাত্র ৫ কোটি

দেশের চলচ্চিত্রশিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে সিনেমা হল সংস্কার ও পুনর্নির্মাণে প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার। এর অংশ হিসেবে ২০২১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ১ হাজার কোটি টাকার একটি পুনঃ অর্থায়ন তহবিল গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। উদ্যোগটা এ কারণেই নেওয়া হয়, যাতে দর্শককে সিনেমা হলমুখী করতে হলমালিকদের অর্থসংকটে পড়তে না হয়। কিন্তু দুই বছর পেরিয়ে গেলেও হাজার কোটি টাকার এই তহবিলের সিংহভাগ অর্থই পড়ে আছে হলমালিকদের অনাগ্রহে।


খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত দুই বছরে এই প্রণোদনা তহবিল থেকে কেবল ৫ কোটি টাকার ঋণ নেওয়া হয়েছে। বাকি ৯৯৫ কোটি টাকাই পড়ে আছে ব্যাংকে। হলমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতি সূত্র বলছে, এখন পর্যন্ত অগ্রণী ব্যাংকে ৩৪ জন এবং সোনালী ব্যাংকে ১০ জন হলমালিক ঋণের জন্য আবেদন করেছেন। কিন্তু ব্যাংকের পক্ষ থেকে যে ধরনের শর্ত দিয়ে আবেদন করতে বলা হয়েছে, তা কোনো মালিকই পূরণ করতে সক্ষম হচ্ছেন না। এ অবস্থায় ঋণের শর্ত শিথিল চান হলমালিকেরা।


ব্যাংকের দেওয়া শর্তগুলো কী কী, তা জানতে অগ্রণী ব্যাংকের দেওয়া শর্তের একটি তালিকা আজকের পত্রিকার হাতে এসেছে। এতে হলমালিকের ট্রেড লাইসেন্স, চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনের (এফডিসি) অনুমোদনপত্রসহ মোট ২০টি শর্তের উল্লেখ রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি শর্ত হলো রাজউক বা সংশ্লিষ্ট পৌরসভা কর্তৃক অনুমোদিত ভবনের নকশা, বন্ধকীতব্য সম্পত্তির দলিল, খতিয়ানসহ যাবতীয় কাগজপত্র, ঋণ গ্রাহকের আয়কর সনদ, সিআইবি রিপোর্ট এবং প্রতিষ্ঠানের প্যাডে তিন বছরের সম্ভাব্য আয়-ব্যয়ের তথ্য।


এসব শর্তকে কঠিন দাবি করে হলমালিকেরা শর্তহীন ঋণ চান। এ বিষয়ে বগুড়ার ধুনট উপজেলার ঝংকার সিনেমা হলের মালিক মো. ঈসা খান বলেন, ‘আমরা তো এটা (ঋণ) নেওয়ার জন্য ইচ্ছুক। কিন্তু ব্যাংক হাউস বিল্ডিং প্রসেসে আমাদের ঋণ দিতে চায়। আমরা এত শর্তের কাগজপত্র দিতে পারছি না। আমাদের যে জায়গায় সিনেমা হল আছে, সেই জমি দেখুক। তাতে যতটুকু ঋণ পাই সেটা দিয়ে হল সংস্কার করব।’


কী ধরনের শর্ত  মানতে পারছেন না—এমন প্রশ্নে ঈসা খান বলেন, ‘ঋণের শতকরা ৫ ভাগ আগে ব্যাংকে জমা দিতে হবে। ধরেন ১০ কোটি টাকা ঋণ নিলে আগে ৫০ লাখ টাকা জমা দিতে হবে। এই টাকা কোথায় পাব?’


ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে শর্তগুলোকে শিথিল করার দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির নেতারাও। তাঁরা এ ব্যাপারে ব্যাংক ও মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বসার কথাও ভাবছেন। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আওলাদ হোসেন বলেন, ‘সিনেমা হল সংস্কারের জন্য ঋণ নিতে যে শর্তগুলো দেওয়া হয়েছে, সে ব্যাপারে আমাদের কথা ব্যাংকগুলোকে আমরা সমিতির পক্ষ থেকে জানিয়ে আসছি। সহজ শর্তে ঋণ বিতরণ না করলে আমাদের জন্য কঠিন হবে। নিয়মকানুন শিথিল করতে হবে, যাতে হলমালিকেরা সহজেই তাঁদের সিনেমা হল সংস্কার করতে পারেন।’ ঋণ পাওয়ার আগেই ব্যাংকে জামানত হিসেবে যে টাকা রাখতে বলা হয়েছে, সেই শর্তও শিথিল চান তিনি।


এনওসি, আয়কর সনদসহ বেশ কিছু বিষয়ে আপত্তির কথা জানিয়েছেন চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সিনিয়র সহসভাপতি মিয়া আলাউদ্দিন। তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী ১ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেন। আমরা সবাই এটাকে স্বাগত জানাই। নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করি। বিভিন্ন ব্যাংকের এমডির সঙ্গে মিটিংও করেছি। সে হিসাবে অগ্রণী ও সোনালী ব্যাংকে আমরা প্রজেক্ট সাবমিট করি। কিন্তু আমরা যে আশা করে এই পদক্ষেপ নিয়েছি, ব্যাংকের পক্ষ থেকে আশানুরূপ সহযোগিতা পাচ্ছি না। এ কারণে এই জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে।’


মিয়া আলাউদ্দিন আরও বলেন, ‘আয় করার পরে আয়কর দেব। সিনেমা হলে এনওসি পাওয়ার জন্য যে প্রক্রিয়া, সেটা সিনেমা হল সংস্কার শেষ করে তারপর করব। যখন তারা সিনেমা হল পরিদর্শন করতে যাবে, তখনই এইসব কাগজপত্র দেওয়া যাবে। তার আগে দরকার আছে বলে আমরা বিশ্বাস করি না।’


প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণ গ্রহণে হলমালিকদের আগ্রহী করতে কর সুবিধাও চান মধুমিতা সিনেমা হলের কর্ণধার ইফতেখার উদ্দিন নওশাদ। তিনি বলেন, শুধু ঋণ নিলেই হবে না। সেটা পরিশোধও করতে হবে। এই সময়ে হল চালানোই কঠিন। কারণ, নিয়মিত ভালো ছবি তৈরি হচ্ছে না। এ ছাড়া ঋণ নেওয়ার পরে সিনেমা হল সংস্কারের জন্য যা কিনতে হবে, তা বিদেশ থেকে আনতে হয়। সেখানে একটা বড় অঙ্কের ট্যাক্স আছে। লেজার প্রজেক্টর, ডিসিপি, সাউন্ড সিস্টেম—এগুলো কিন্তু বিদেশ থেকে আনতে হয়। বেশ দামি। এগুলো একবারের জন্য ট্যাক্স ফ্রি করে দিলে সবাই টাকাটা নিতে আগ্রহী হবে।’


দেশের চলচ্চিত্রশিল্পে ধসটা নামে নব্বইয়ের দশকে। এ সময় চলচ্চিত্রে অশ্লীলতা ঢুকে পড়লে মুখ থুবড়ে পড়ে এ শিল্প। প্রদর্শক সমিতির তথ্যমতে, নব্বইয়ের দশকে বারো শর মতো সিনেমা হল ছিল সারা দেশে। এরপরে ক্রমেই হলের সংখ্যা কমতে থাকে। ক্রমেই হলমালিক, প্রযোজকেরা ইন্ডাস্ট্রি থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেন। এখন সারা দেশে ৫০ থেকে ৬০টি সিনেমা হল আছে। আর বিভিন্ন উৎসব উপলক্ষে ১০০ থেকে ১৫০টি হলে প্রদর্শনী চলে।


শেয়ার করুন