গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলার পর সাধারণ সূত্র অনুসারে নেতানিয়াহু সরকারের প্রতি জনসমর্থন বাড়ার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে সেটা হয়নি। বরং দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ব্যর্থ হওয়া দেশকে হামাসের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলার দায় জনগণ সরকারকেই দিচ্ছে। কেবল দায় দিয়েই জনগণ ক্ষান্ত হয়নি। সরাসরি দেশটির বিভিন্ন মন্ত্রীকে অপমানও করেছে জনতা। সব মিলিয়ে নেতানিয়াহু তো বটেই তাঁর সরকারের জন্যও ‘কিয়ামত’ বা বিচারের দিন ঘনিয়ে আসছে।
এক মন্ত্রী হামাসের হামলায় আহতদের দেখতে একটি হাসপাতালে গিয়েছিলেন কিন্তু হাসপাতালে প্রবেশের আগেই প্রধান ফটক থেকে তাঁকে ফেরত পাঠায় জনতা। আরেক মন্ত্রী দেহরক্ষীর গায়ে উত্তপ্ত কফি ছুড়ে মেরেছিলেন আরেকজন। হামাসের হামলা থেকে বাঁচাতে গাজা সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে স্থানীয়দের সরিয়ে নেওয়া হচ্ছিল। সেই কার্যক্রম দেখতে গিয়েছিলেন এক মন্ত্রী। সে সময় তাঁকে স্থানীয়রা ‘বিশ্বাসঘাতক’ ও ‘নির্বোধ’ বলে গালি দেয়।
নেতানিয়াহু রাজনীতিবিদ হিসেবে চার্চিলের কৌশল অনুসরণ করে থাকেন। এমনটি করতে গিয়ে তিনি নতুন সরকার গঠনের আগেই দেশের জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়ে ঝুঁকির পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। পরে যেন তারই কথার সূত্র ধরে হামাস ইসরায়েলে হামলা করে এবং এতে দেশটির ১৩ শতাধিক মানুষের প্রাণহানি হয়। পুরো বিষয়টিই ইসরায়েলি জনগণকে ক্ষুব্ধ করেছে। বিশেষ করে, জানা থাকার পরও কেন বিষয়টি ঠেকানো গেল না তা নিয়েই প্রধান ক্ষোভ।
নেতানিয়াহু ও তাঁর সরকারের জন্য আরেকটি বড় বিপদ হয়ে দেখা দিয়েছে, ইসরায়েলের বিচার বিভাগ সংস্কারকে কেন্দ্র করে সামাজিক মেরুকরণ। ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর অনেক রিজার্ভ সৈন্যই সরকারের এই অবস্থানের বিরোধিতা করেছে এমনকি মাঠেও নেমে আন্দোলন করেছে। এই অবস্থায় ইসরায়েল দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিতে যুদ্ধের জন্য কতটা প্রস্তুত ছিল তা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
ইসরায়েলের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় দৈনিক ইয়েদিওথ আরোনাথ ‘অক্টোবর-২০২৩ ডিবাকল’ বা ‘২০২৩ সালের অক্টোবর বিপর্যয়’—শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। যেখানে গত ৭ অক্টোবর হামাসের হামলাকে ১৯৭৩ সালের অক্টোবরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী গোল্ডা মেয়ারের আমলে সিরিয়া ও মিসরের ইসরায়েল হামলার সঙ্গে তুলনা দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, সেই হামলা আগাম অনুমান না করতে পারার ব্যর্থতা নিয়ে গোল্ডা মেয়ার পদত্যাগ করেছিলেন। এখানে ইঙ্গিত স্পষ্ট যে, দেশবাসী ২০২৩ সালের অক্টোবর বিপর্যয়ের পর নেতানিয়াহুকে জবাবদিহির কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চায়।
জেরুসালেমের শালোম হার্টম্যান ইনস্টিটিউটের গবেষণা সহযোগী আমোজ আসা-আল বলেন, সেই ঘটনা গোল্ডা মেয়ারের রাজনৈতিক দল লেবার পার্টির প্রাধান্যকে ব্যাপকভাবে কমিয়ে দিয়েছিল। আসা-আলের মতে, বর্তমান ঘটনাপ্রবাহও নেতানিয়াহুর দীর্ঘ রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ও তাঁর দলের ওপর একই রকম প্রভাব ফেলবে।
আসা-আল আরও বলেন, ‘এই ঘটনায় কার কী ব্যর্থতা তা খুঁজে বের করতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হোক বা না হোক কিংবা তিনি (নেতানিয়াহু) দোষ স্বীকার করেন বা না করেন তাতে কিছু আসে যায় না। বরং মধ্যবিত্ত ইসরায়েলিরা কী ভাবছে সেটি গুরুত্বপূর্ণ। আর মজার ব্যাপার হলো—তাদের অধিকাংশই ভাবছে এই ঘটনার জন্য প্রধানমন্ত্রীই দায়ী।’ আসা-আলের মতে, নেতানিয়াহুকে সরে যেতেই হবে, সঙ্গে সঙ্গে তাঁর যে এস্টাবলিশমেন্ট সেটিকেও বিদায় নিতে হবে।
ইসরায়েলের আরেকটি জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যম মারিভের জরিপ বলছে, মাত্র ২১ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক ইসরায়েলি চান নেতানিয়াহু ক্ষমতায় থাক। বিপরীতে ৬৬ শতাংশ ইসরায়েলি ভোটার চায় নেতানিয়াহুর পরিবর্তে অন্য কেউ আসুক ক্ষমতায় কিন্তু কোনোভাবেই নেতানিয়াহু নয়। এর বাইরে ১৩ শতাংশ লোক দেশের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী বাছাই করা নিয়ে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেননি।
ফলে এই অবস্থায় যদি ইসরায়েলে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তবে নেতানিয়াহুর দল ক্ষমতাসীন লিকুদ পার্টি এক-তৃতীয়াংশ আসন হারাবে এবং মধ্যপন্থী বলে পরিচিত বিরোধী দল ন্যাশনাল ইউনিটি পার্টি এক-তৃতীয়াংশ আসন বেশি পাবে। যা বিরোধীদলীয় নেতা বেনি গান্তেজকে দেশের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে অনেকটাই এগিয়ে দেবে।
তবে এই মুহূর্তে আপাতত ইসরায়েলে নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা নেই, এটি নেতানিয়াহুর জন্য আপাত স্বস্তি। কারণ এরই মধ্যে দেশটিতে জাতীয় সরকার গঠিত হয়েছে। বিরোধী দলগুলোও সরকারের বিরুদ্ধে কোনো আওয়াজ তুলছে না। কিন্তু এই অবস্থা চিরস্থায়ী নয়। এই ঘটনার ডামাডোল ফুরিয়ে গেলে নেতানিয়াহুর ওপর ‘বিচারদিন’ বা ‘রোজ কিয়ামত’ ঘনিয়ে আসতে পারে।