২৮ এপ্রিল ২০২৪, রবিবার, ০৫:৩৭:০৪ পূর্বাহ্ন
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি ৩৮ দিন, মনোনয়ন নিয়ে উচ্ছাস
  • আপডেট করা হয়েছে : ৩০-১১-২০২৩
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি ৩৮ দিন, মনোনয়ন নিয়ে উচ্ছাস

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর মাত্র ৩৮ দিন বাকি। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও তৃণমূল বিএনপিসহ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ও জোট প্রার্থী ঘোষণা শেষ করেছে। আজকালের মধ্যে নির্বাচনমুখী অন্য দলগুলোও প্রার্থী ঘোষণা ও মনোনয়নপত্র দাখিল করবে। ইতোমধ্যেই সারাদেশে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের কাছ থেকে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন কয়েক হাজার প্রার্থী। এর মধ্যে অনেকেই মনোনয়নপত্র জমাও দিয়েছেন। মনোনয়নপত্র উত্তোলন, জমা ও গণসংযোগকে কেন্দ্র করে নির্বাচনী হাওয়া বইতে শুরু করেছে। সারাদেশে নির্বাচন কমিশনও (ইসি) ভোটের প্রস্তুতি শেষ করেছে।  

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে কি না এ নিয়ে এক সময় দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মহলে সংশয় থাকলেও এখন আর সে অবস্থা নেই। উৎসবমুখর পরিবেশে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোট মনোনয়নপত্র বিতরণ ও প্রার্থী ঘোষণার পর সারাদেশের চিত্র পাল্টে যায়। নির্বাচন কমিশন, সরকারের প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলাবাহিনীও অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে অধিকতর তৎপর। এ কারণে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে এক সময় বিদেশীদের তৎপরতা বেড়ে গেলেও এখন দৌড়ঝাপ কমে গেছে। 

সূত্র মতে, এবারের নির্বাচনে শুধু দল বা জোটের প্রার্থীরাই নয়, ৩০০ সংসদীয় আসনের মধ্যে অধিকাংশ আসনেই স্বতন্ত্র প্রার্থীর ছড়াছড়ি। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ২৮টি দলসহ অর্ধশতাধিক দল রয়েছে। এরমধ্যে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জাসদ ওয়ার্কার্স পার্টি, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, বিকল্প ধারা, তৃণমূল বিএনপি, বিএনএম, তরিকত ফেডারেশন, সম্মিলিত ইসলামী জোট, যুক্তফ্রন্টসহ বেশক’টি দল ও জোট পুরোদমে নির্বাচনের মাঠে সক্রিয় রয়েছে। অন্যদিকে এখনো পর্যন্ত নির্বাচনে না যাওয়ার পক্ষে রয়েছে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ১২টি দলসহ প্রায় ২০টি দল। এরমধ্যে বিএনপি ছাড়া সবগুলোই ছোট দল। দেশের রাজনীতিতে নাটকীয় কোনো মোড় না নিলে বিএনপি ও তাদের সমমনা এই দলগুলোর নির্বাচনে যাওয়া অনিশ্চিত বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। 

প্রতিটি সংসদীয় এলাকায় নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থী, দলীয় নেতাকর্মী ও স্বজনরা গণসংযোগ জোরদার করেছে। তারা এখন থেকে পাড়া-মহল্লায় বিভিন্ন কৌশলে গণসংযোগের পাশাপাশি সামাজিক মাধ্যমসহ বিভিন্নভাবে প্রচার চালাচ্ছে। রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকার প্রভাবশালী প্রার্থীদের পক্ষে তাদের সমর্থক ও স্বজনরা পাড়া-মহল্লায় অস্থায়ী প্যান্ডেল বানিয়ে আড্ডা  দেওয়ার পাশাপাশি প্রার্থীর পক্ষে প্রচার চালাচ্ছেন। দল ও জোট থেকে মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থীদের মধ্যে অনেকের পক্ষেই মহিলারা দল বেঁধে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোট প্রার্থনা শুরু করেছে। কোনো কোনো প্রার্থী নিজ নিজ সংসদীয় এলাকার ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, ক্লাব, সাংস্কৃতি ও ক্রীড়া সংগঠনসহ বিভিন্ন সংগঠন ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে গিয়ে দোয়া চাচ্ছেন।

নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে করতে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন মহলের চাপ ও কঠোর নজরদারি রয়েছে। সাংবিধানিক শপথ রক্ষায় নির্বাচন কমিশনেরও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার বাধ্যবাদকতা রয়েছে। তাই নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করতে যা কিছু দরকার তার সবই করছে ইসি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনকে ইতোমধ্যেই কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে যে-কোনো মূল্যে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। ইসির সঙ্গে দফায় দফায়  বৈঠককালে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সর্বোচ্চ পর্যায় থেকেও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে ইসিকে সার্বিক সহায়তা দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। 

গ্রহণযোগ্য, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য অনেক বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নিয়েছে ইসি। এর মধ্যে রয়েছে সকল রাজনৈতিক দলের ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর জন্য লেভেলপ্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করা, নির্বাচনের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বিভিন্ন বাহিনীর সাড়ে ৭ লাখ সদস্য নিয়োগ, ভোট কেন্দ্রে সকল প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট নিশ্চিত করা, ভোট গ্রহণের দায়িত্বে নিয়োজিত কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা গ্রহণ, প্রার্থীসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে আচরণবিধি মানাতে ৮০২ জন ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করা হয়েছে। তারা ইতোমধ্যে কাজ  শুরু করেছেন। 

নির্বাচনের ১০ দিন আগে মাঠে নামানো হবে বিজিবির ৪৭ হাজার সদস্য। এছাড়া সেনাবাহিনী থাকবে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু করার লক্ষ্যে ৩০০ আসনের জন্য ৩০০টি অনুসন্ধানী কমিটি গঠন করেছে নির্বাচন কমিশন। সংশ্লিষ্ট আসনে প্রার্থীদের অপরাধ তদন্ত করে আমলে নেওয়ার জন্য এসব কমিটি গঠন করা হয়েছে। ভোটের ফল গেজেট আকারে প্রকাশ করা পর্যন্ত এ কমিটি দায়িত্ব পালন করবে। এই কমিটিতে যুগ্ম-জেলা জজ, প্রয়োজনে সিনিয়র সহকারী জজ দায়িত্ব পালন করবেন। আর যারা ভোট গ্রহণের দায়িত্ব পালন করবেন তাদের সবাইকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। 

নির্বাচন কমিশনের সুষ্ঠু নির্বাচনের পদক্ষেপ দেখে ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশের শতাধিক নির্বাচন পর্যবেক্ষক আসবেন বলে জানিয়েছেন। এছাড়াও কমনওয়েলথের ৫ জনসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা নির্বাচন পর্যবেক্ষণে আসার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এটিও এবারের নির্বাচনের জন্য একটি ইতিবাচক বার্তা বলে নির্বাচন কমিশন মনে করছে।  

প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের সকল প্রস্তুতি ইসির পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সবাই বলেছেন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ ভোটের পরিবেশ নিশ্চিত করতে কাজ করবেন। তবে রাজনৈতিক দলগুলোকেও এ বিষয়ে সহযোগিতা করতে হবে। তাহলেই সবার কাছে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে। 

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের নির্বাচন সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে সারাদেশের মানুষের মধ্যে যে উৎসাহ ও উচ্ছ্বাস তাতে বোমাবাজি ও অগ্নিসন্ত্রাস করে নির্বাচন ঠেকানো যাবে না। ইতোমধ্যেই নির্বাচনের উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পড়েছে গোটা দেশে। এতেই বোঝা যায় নির্বাচন নিয়ে দেশের মানুষের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে। 

ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ এবার ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৮ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। আর বর্তমান জাতীয় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ২৭৯ আসনে প্রার্থী দিয়েছে। এছাড়া তৃণমূল বিএনপি, তরিকত ফেডারেশন, সম্মিলিত ইসলামী জোট ও বিএনএমসহ আরও ক’টি রাজনৈতিক দল ও জোট অধিকাংশ সংসদীয় আসনে প্রার্থী দিচ্ছে। এবার স্বতন্ত্র প্রার্থীর সংখ্যাও আগের নির্বাচনগুলোর চেয়ে বেশি বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।

ঘোষিত তফসিল অনুসারে ৩০ নভেম্বর বৃহস্পতিবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষদিন। মনোনয়নপত্র বাছাই ১ থেকে ৪ ডিসেম্বর। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষদিন ১৭ ডিসেম্বর। ১৮ ডিসেম্বর প্রতীক বরাদ্দ করা হবে। প্রার্থীরা নির্বাচনের প্রচার চালাতে পারবে ৫ জানুয়ারি সকাল ৮টা পর্যন্ত। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটার ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৯১ হাজার ৬৩৩ জন। পুরুষ ভোটার ৬ কোটি ৭ লাখ ৭১ হাজার ৫৭৯ জন ও নারী ভোটার ৫ কোটি ৮৯ লাখ ১৯ হাজার ২০২ জন। আর হিজড়া ভোটারের সংখ্যা ৮৫২। 

নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৪৪টি দলের মধ্যে আওয়ামী লীগও জাতীয় পার্টিসহ ২৮টি দল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। আর বিএনপিসহ ১২টি দল এক দফা দাবিতে রাজপথে আন্দোলন করছে। এর আগে ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিবন্ধিত অধিকাংশ দলই নির্বাচনে অংশ নেয়। ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ নেয় ১২টি নিবন্ধিত দল। আর ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অংশ নেয় ৩৯টি দল। তবে এবারের নির্বাচন আগের ২টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের চেয়ে বেশি জমজমাট বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন। 

উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, সাম্যবাদী দল, বিকল্পধারাসহ বেশ ক’টি রাজনৈতিক দল অংশ নিলেও বিএনপিসহ বেশ ক’টি দল না আসায় নির্বাচন তেমন জমজমাট হয়নি। ওই নির্বাচনে প্রার্থী সংখ্যাও ছিল অনেক কম। এ কারণে ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তবে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিসহ নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত অধিকাংশ দল অংশ নিলেও ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির প্রচার ছিল দুর্বল। ওই নির্বাচনকে গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি বিএনপি।


এ কারণে ওই নির্বাচনটিও তেমন জমজমাট হয়নি। তবে এবারের নির্বাচন নিয়ে বিএনপি ও দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মহল আগেই নানামুখী প্রশ্ন তোলায় ক্ষমতাসীন সরকার ও নির্বাচন কমিশনসহ নির্বাচন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো আগেভাগেই তৎপর হয়। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যাবতীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করে। আর আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও এ নির্বাচন জমজমাট হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিভিন্ন কৌশল গ্রহণ করে। 

এবার আওয়ামী লীগ থেকে যাদের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে তাদের বাইরেও যদি দলের প্রার্থী থাকে তাদের কোনো প্রকার বাধা সৃষ্টি করা হবে না বলে জানিয়েছে দলটি। এতে নির্বাচন জমজমাট হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ছাড়া ছোট ছোট বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও এবার ভোটে অংশ নিচ্ছে। আর এ কারণেই এবারের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যেই সারাদেশে উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পড়ছে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন।


শেয়ার করুন