৩০ এপ্রিল ২০২৪, মঙ্গলবার, ০৭:৪৪:৫৭ অপরাহ্ন
পালটে যাবে পাহাড়ের সামগ্রিক অর্থনীতি
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৩-১২-২০২৩
পালটে যাবে পাহাড়ের সামগ্রিক অর্থনীতি

আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিশ্চিত ও অবৈধ বর্ডার ট্রেড প্রতিরোধে তিন পার্বত্য জেলার সীমান্তে পাহাড় কেটে নির্মাণ কাজ চলছে এক হাজার ৩৬ কিমি. সীমান্ত সড়কের। ইতোমধ্যে ১৭০ কিমি. রাস্তার কাজ শেষ হয়েছে। আগামী জুনে ৩১৭ কিমি. কাজ শেষ হবে। আর এরই মধ্য দিয়ে সীমান্ত সড়কের প্রথম ধাপের সমাপনী ঘটবে। সীমান্ত সড়ক শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, তথ্যপ্রযুক্তির, পর্যটন শিল্পের প্রসারে ব্যাপক পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আর এটি চালু হলে পালটে যাবে পাহাড়ের অর্থনীতি। ইতিবাচক প্রভাব পড়বে জীবনযাত্রা ও কৃষিতে-এমনটি মত পর্যবেক্ষক মহলের।


গত ২৭ নভেম্বর সরেজমিন দেখা গেছে, তৃতীয় বৃহত্তম পর্বতশৃঙ্গ কেওক্রাডংয়ের পাশ দিয়ে একটি লিঙ্ক রোড গিয়ে সংযোগ হয়েছে সীমান্ত সড়কের সঙ্গে। সেখানে সীমান্ত সড়কের কাজ চলছে। প্রথমে পাহাড় কেটে রাস্তা উপযোগী করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সীমান্ত সড়ক নির্মাণ কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত এক কর্মকর্তা জানান, এক কিমি. পাহাড় কেটে রাস্তা নির্মাণ করতেই তিন মাস চলে যায়। দুর্গম পাহাড়, কঠিন যাতায়াত ব্যবস্থা। নেই কোনো পানি ও খাবারের ব্যবস্থা। নির্মাণসামগ্রী ও সরঞ্জাম বহন করে নেওয়া অত্যন্ত কঠিন। নেই মোবাইলফোনের নেটওয়ার্ক। বর্ষাকালে পাহাড়ি এ জনপদ হয়ে ওঠে আরো বিভীষিকাময়। এমন বাস্তবতা মেনেই চলছে সীমান্ত সড়কের কাজ।


বান্দরবান মুনলাই পাড়ার ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার মিনরাং বোম জানান, তিনি কাজুবাদ ও আনারসের চাষ করেন। বছরে অন্তত চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা আয় হয়। তার স্বপ্ন সীমান্ত সড়ক হলে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হবে। এতে তার উৎপাদিত পণ্য মধ্যস্বত্বভোগীকে না দিয়ে সরাসরি মোকামে বিক্রি করবেন।


জানতে চাইলে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মশিউর রহমান শনিবার যুগান্তরকে জানান, সীমান্ত সড়ক চালু হলে অর্থনীতি ও জীবনযাত্রায় ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন হলে অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়ে। পাহাড়ি অঞ্চলে পৌঁছাতে হেঁটে যেখানে তিন দিন সময় লাগে, এখন সড়ক চালু হলে তিন ঘণ্টায় পৌঁছে যাবে। কৃষিপণ্য বাজারজাত করতে প্রত্যন্ত পাহাড় থেকে নিয়ে আসা যাবে। আর নিরাপত্তাও নিশ্চিত হবে। কারণ নিরাপত্তার পূর্বশর্ত হচ্ছে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নতি করা। রাস্তা না থাকায় চোরাচালান বেশি হচ্ছে। আগামীতে সেগুলো থাকবে না।


জানা গেছে, বর্তমান বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ির বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় পুরোপুরি বাউন্ডারি নেই, কাঁটাতার নেই। শুধু পিলার দেওয়া আছে। এখানে অবাধ চলাচলের সুযোগ আছে। এছাড়া শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের অন্তরায় কেএনএফ সীমান্তঘেঁষে সাতটি উপজেলাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। বেশ কয়েকটি উপজেলা মিজোরামের সঙ্গে লাগানো। এই সীমান্ত সড়ক হলে নিরাপত্তার জন্য নতুন সেনা, বিজিবি ও পুলিশ এক সঙ্গে নিরাপত্তার কাজ করবে। এতে অভ্যন্তরীণ চলাফেরা অনেকটা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে। সীমান্ত দিয়ে চলাফেরা অনেক সহজ হবে।


পরিকল্পনা বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালে সীমান্ত সড়ক নির্মাণ কাজের সূচনা হয়। এতে ব্যয় হবে তিন হাজার ৮৬০ কোটি টাকা। এর মধ্যে রাজস্ব ব্যয় ১২২ কোটি টাকা, মূলধনী ব্যয় তিন হাজার ৬৯০ কোটি টাকা, ফিজিক্যাল কনটিনজেন্সি ব্যয় ১০ কোটি ২০ লাখ টাকা এবং প্রাইস কনটিনজেন্সি ব্যয় ৩৮ কোটি টাকা। তবে মূলধনী ব্যয়ের মধ্যে ২২১টি কালভার্ট নির্মাণ করা হবে এই সীমান্ত সড়কে, ব্যয় হবে ২১৬ কোটি টাকা। পানি নিষ্কাশন কাঠামো নির্মাণে ব্যয় ধরা হয় ৫৬০ কোটি টাকা। রাস্তা অনুপোযোগী মাটি কাটা ব্যয় হবে ৩১৫ কোটি টাকা, রাস্তার পাশে মাটির বাধ নির্মাণ ব্যয় ৩৭৪ কোটি টাকা, এইচবিবি সোল্ডারসহ ফ্লেক্সিবল পেভমেন্ট নির্মাণ ব্যয় এক হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা। আর রিটেইনিং ওয়াল, টো-ওয়াল ও বেস্ট ওয়াল নির্মাণ খাতে ২৩৪ কোটি টাকা। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের ১৬, ২০ ও ২৬ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্যাটালিয়ন।


বান্দরবান পাবর্ত্য জেলা পুলিশ সুপার সৈকত শাহীন যুগান্তরকে জানান, সীমান্ত সড়ক বাস্তবায়ন হলে পাহাড়ের সীমানা দিয়ে মাদক প্রবেশ পুরোপুরি বন্ধ হবে। কারণ সেখানে পুলিশ, সেনা ও বিজিবি টহল থাকবে। এই তিন বাহিনী পাহারা থাকায় মাদক চোরাচালন ও সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা প্রবেশ করতে পারবে না।


বান্দরবান ট্যুরিস্ট পুলিশ সুপার শেখ মোহাম্মদ মনজুর মোরশেদ জানান, তিন পাবর্ত্য জেলার মধ্যে বান্দরবান পর্যটনের জন্য সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনাময়। অনেক দুর্গম জায়গায় ভালোমানের রিসোর্ট হয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশের লোকজন আসছে। এখন সীমান্ত রোড হচ্ছে। এটি চালু হলে আরও পর্যটক বাড়বে। এই সড়কে সব বাহিনী কাজ করছে। কোনো ধরনের সমস্যা হবে না।


বর্তমান সড়ক নির্মাণে এক ধরনের জোয়ার চলছে পাবর্ত্য অঞ্চলগুলোতে। বর্তমান তিন পাবর্ত্য অঞ্চলে তিন হাজার ৩৫৫ কিমি. পাকা রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। কাঁচা রাস্তার দৈর্ঘ্য ছয় হাজার ৩৩৪ কিমি.। কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে এক হাজার ৩৮টি এবং ব্রিজ এক হাজার ১৯০টি। নতুন করে সীমান্ত সড়ক নির্মাণ হলে আরও এক হাজার ৩৬ কিমি. রাস্তা যোগ হবে এ অগ্রযাত্রায়।


সীমান্ত সড়কের বিষয়ে বান্দরবান সদরের কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী অরুণ দত্ত এন্টারপ্রাইজের মালিক বিল্পব বড়ুয়া যুগান্তরকে জানান, ২০ বছর ধরে ব্যবসা করছেন তিনি। এ সময় ছোট ব্যবসায়ী অনেক বেড়েছে। এই বাজারে পর্যটকরাও আসে। সীমান্ত সড়ক হলে যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও ভালো হবে। অনেক প্রত্যন্ত অঞ্চলে রাস্তা হয়েছে, যা যোগ হবে সীমান্ত সড়কে। এতে ব্যবসায় বাণিজ্য আরও বাড়বে।


বান্দরবান পাবর্ত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্যশৈহলা যুগান্তরকে জানান, সীমান্ত রক্ষা করতে এই সড়ক অবশ্যই প্রয়োজন। কারণ পাশেই আছে চীন, আরাকান ও মিজোরাম। এটি হলে পর্যটক সংখ্যাও বাড়বে।


শেয়ার করুন