এক সময়ে দেশের অন্যতম রপ্তানি পণ্য ছিল পাট ও পাটজাত পণ্য। এজন্য ‘সোনালি আঁশ’ নামে ভূষিত হয়েছিল পাট। এটি ছিল দেশের প্রধান অর্থকরী পণ্য এবং বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের বড় উৎস। কিন্তু অতীতের সেই স্বর্ণালী দিন হারিয়েছে পাট। একের পর এক হোঁচট খেয়ে রপ্তানি আয়ে অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে খাতটি। পাটপণ্য রপ্তানিতে নগদ সহায়তা থাকা সত্ত্বেও রপ্তানি আয় কেবল কমেছেই। সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগেও ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না খাতটি। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, পাট নিয়ে দেশে আলাদা মন্ত্রণালয় থাকার পরও এমন করুণ দশা বোধগম্য নয়।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে ১০ দশমিক ২৪ শতাংশ কম। লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও তা প্রায় ১২ শতাংশ কম। চলতি অর্থবছরের এই সময়কালে মোট ৪৩ কোটি ৬১ লাখ ডলারের পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে। আগের অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ৪৮ কোটি ৫৮ লাখ ডলার। ইপিবির তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এ সময়ের ব্যবধানে সবচেয়ে বেশি কমেছে কাঁচা পাটের রপ্তানি। আগের অর্থবছরের তুলনায় যা ৩১ দশমিক ৫৭ শতাংশ কম। এছাড়া এ সময়ে পাটের বস্তা ও ব্যাগ ২০ শতাংশ এবং পাটের তৈরি সুতা ও টোয়াইনের (পাটের বিশেষ ধরনের মোটা সুতা) রপ্তানি ৩ দশমিক ১৪ শতাংশ কমেছে।
সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে ভালো রপ্তানি আয়ের দেখা পায় খাতটি। ওই অর্থবছরের জুলাই থেকে জুন পর্যন্ত সময়ে মোট রপ্তানি আয় হয়েছিল ১১৬ কোটি ১৪ লাখ ডলার। এ আয় আগের ২০১৯-২০ অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৩১ দশমিক ৬৩ শতাংশ বেশি ছিল। এরপর থেকেই পতন ঘটতে থাকে, যা আর টেনে তোলা সম্ভব হয়নি। ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, পরের ২০২১-২২ অর্থবছরে এ খাতে রপ্তানি আয় ৩ শতাংশ কমে ১১২ কোটি ৭৬ লাখ ডলারে নেমে আসে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা ১৯ দশমিক ১ শতাংশ কমে ৯১ কোটি ২২ লাখ ডলারে দাঁড়ায়। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও রপ্তানি পিছিয়ে রয়েছে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানির ক্ষেত্রে দেশের সবচেয়ে বড় বাজার হচ্ছে পাশের দেশ ভারত। আফ্রিকা ও ইউরোপের বিকল্প বড় বাজার থাকা সত্ত্বেও রপ্তানিতে ভারতের বাজারের ওপর অতি নির্ভরতার কারণে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের পাটপণ্য আমদানিতে ভারত সরকার অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক আরোপ করলে রাতারাতি কমতে শুরু করে রপ্তানি। এরপর ভারতের বিকল্প বাজার আর গড়ে তোলা যায়নি। বর্তমানে ভারত ব্যতীত সুদানসহ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ এবং তুরস্ক, পাকিস্তান, ইরানসহ আরও কয়েকটি দেশে পাট ও পাট পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। কিন্তু দেশের পাটকলগুলোর অচলাবস্থার ফলে চাহিদামাফিক পণ্য পাচ্ছেন না আমদানিকারকরা। সে সঙ্গে পণ্যের বৈচিত্র্যকরণেও পাটকলগুলো অনেক পিছিয়ে রয়েছে বলে জানান তারা।
বাংলাদেশ পাটপণ্য রপ্তানিকারক অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেজিইএ) চেয়ারম্যান এস আহমেদ মজুমদার বলেন, রপ্তানিতে টানা ধসের পেছনে অন্যতম কারণ হচ্ছে দেশের পাটকলগুলোর অচলাবস্থা। আমাদের অভ্যন্তরীণ সক্ষমতা বৃদ্ধি না করে সরকারকে ভুল তথ্য দিয়ে একের পর এক পাটকলগুলোকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। মিলগুলো থেকে কোনো পণ্যই পাচ্ছেন না আমদানিকারকরা। বিজিএমসি এখন ‘মৃত ঘোড়া’য় পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের বৈদেশিক বাজার রয়েছে এবং ক্রেতা ও চাহিদাও রয়েছে। কিন্তু পণ্যের ঘাটতিতে রাপ্তানি করতে পারছি না। আগে যে রপ্তানিকারক প্রতি মাসে ২০০ থেকে ৩০০ কনটেইনার পণ্য রপ্তানি করতেন, তিনি এখন এখান-ওখান থেকে নিয়ে ২-৪ কনটেইনার রপ্তানি করতে পারেন। অথচ, আমাদের পুরনো মেশিনগুলো দিয়েই চাহিদা মেটানোর মতো উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু সেটা বাড়ানোর দিকে আমাদের নজর কম।
বিজেজিইএ চেয়ারম্যান বলেন, ভারত আমাদের বড় বাজার ছিল। এটা কমতে কমতে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশে নামে। এখন তা ৫ শতাংশে নেমেছে। এর পেছনে একটাই কারণ- এন্টি ডাম্পিং। এছাড়া তুরস্ক, ইরান এবং আফ্রিকা ও ইউরোপে চাহিদা বাড়লেও দেশে উৎপাদনের অভাবে রপ্তানি করা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, চাহিদামাফিক পণ্য পেলে ২ বিলিয়নে রপ্তানি নিতে পারব আমরা।
ভারতের এন্টি ডাম্পিং আরোপে দেশের পাট খাতে বড় প্রভাব পড়েছে বলে জানান মিল মালিকরাও। সে সঙ্গে কাউকে কাউকে সুবিধা দেওয়া হয়। অন্যরা বিপদে পড়ল। মিল মালিকরা বলছেন, ভারতে আড়াই লাখ টনের বাজার ছিল। এখন সেখানে ৭০ থেকে ৮০ হাজার টনে নেমে এসেছে।
বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএমএ) প্রেসিডেন্ট মো. আবুল হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, ভারতের এই এন্টি ডাম্পিং আরোপে আমরা অনেক ক্ষতিগ্রস্ত। আমরা নতুন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করেছি। তিনি ভারত সরকারের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করবেন জানিয়েছেন। বর্তমানে বিজেএমএর সদস্যদের ২৪০টির মধ্যে অর্ধেক মিলই বর্তমানে বন্ধ রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানো।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন মনে করেন, পাটের যে ঐতিহ্য ছিল সেটি একদিনে ফুরিয়ে যায়নি। আমাদের সময়কে তিনি বলেন, বর্তমান পরিবেশবান্ধব সচেতনতা বাড়ায় বিশ্ববাজারে পাট ও পাটজাত পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। সেখানে আমরা উল্টো পিছিয়ে পড়ছি। বিশ্ববাজারের চাহিদাকে কাজে লাগাতে পারছি না। আমাদের পাট নিয়ে আলাদা মন্ত্রণালয় রয়েছে। তারপরও এতদিন ধরে এমন দশা কেন তা বুঝে আসে না। এমনকি বেসরকারি মিলগুলোও শতভাগ উৎপাদনে নেই। এর পেছনের কারণগুলো খুঁজে বের করতে হবে। তিনি আরও বলেন, সরকারের নানা উদ্যোগও আলোর মুখ দেখছে না। আসলে সরষের ভেতরেই ভূত রয়েছে। সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করে তা দূর করতে হবে আগে। তিনি পাটপণ্য রপ্তানিতে নগদ সহায়তা কোথায় যাচ্ছে, তা খতিয়ে দেখার পরামর্শ দিয়েছেন।
রপ্তানিতে উৎসাহ দিতে পাট ও পাটজাত পণ্যের ক্ষেত্রে সরকার ৭ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত নগদ সহায়তা দিচ্ছে। তারপরও রপ্তানি বাড়ছে না। উল্টো কারসাজি করে পণ্যের বিষয়ে ভুল তথ্য দিয়ে কোনো কোনো ব্যবসায়ী বেশি সুবিধা নিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে বিজেএমএর প্রেসিডেন্ট মো. আবুল হোসেন বলেন, আমরা সরকারের কাছে জোর দাবি জানাই, কোনো পণ্যে ৭ শতাংশ, কোনোটায় ২০ শতাংশ না দিয়ে সব পণ্যে একই হারে নগদ সুবিধা দেওয়া প্রয়োজন।