২৭ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ০৫:১৪:৪৭ অপরাহ্ন
তড়িঘড়ি অভিযানে হঠাৎ ভাটা
  • আপডেট করা হয়েছে : ১১-০৩-২০২৪
তড়িঘড়ি অভিযানে হঠাৎ ভাটা

রাজধানীর বেইলি রোডের এক আগুনে ৪৬ জনের মৃত্যুর পর রাজধানীজুড়ে শুরু হয় সাঁড়াশি অভিযান। ভবনগুলোর অগ্নিনিরাপত্তার ত্রুটির খোঁজে নামে সিটি করপোরেশন, রাজউক, ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ। 


অভিজাত রেস্তোরূা থেকে শুরু করে রাজধানীর অলি-গলির প্রায় দুই হাজার দোকান ও প্রতিষ্ঠানে চলে অভিযান। তবে এক সপ্তাহ পার না হতেই ভাটা পড়ে আকস্মিক অভিযানে। কোনো কোনো সংস্থা ছোট পরিসরে নামমাত্র অভিযান কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এছাড়া ঢাকার বাইরে অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিতে কোনো তৎপরতা নেই বললেই চলে। এ অবস্থায় তড়িঘড়ি অভিযানের প্রাসঙ্গিকতা ও কার্যকরিতা নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে। সংশোধনের সুযোগ না দিয়ে ঢালাও অভিযানের ফলে ব্যবসায়ীরা বর্তমান অবস্থা থেকে কতটা ঘুরে দাঁড়াতে পারবে তা নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়। 


২৯ ডিসেম্বর বেইলি রোডের ‘গ্রিন কোজি কটেজ’ ভবনে আগুনের দুদিন পর থেকে মূলত শুরু হয় অভিযান। এরপর তিন দিন চলে জোরালো অভিযান। এই তিন দিনে কেবল পুলিশই ১ হাজার ৩৪৭টি প্রতিষ্ঠানে অভিযান পরিচালনা করে। এরমধ্যে হোঁটেল-রেস্তোঁরা রয়েছে ১ হাজার ১৩২টি। ঝুঁকিপূর্ণ গ্যাস সিলিন্ডার রাখার ২০৭টি দোকান এবং ৮টি কেমিক্যাল গোডাউনেও চলে অভিযান। এসব অভিযানে ৮৭২ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এভাবে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন, রাজউক, ফায়ার সার্ভিস কয়েকশ অভিযান পরিচালনা করে। এরই মধ্যে নানা মহল থেকে বিচ্ছিন্ন এ অভিযান নিয়ে শুরু হয় প্রতিক্রিয়া ও সমালোচনা। 


ব্যবসায়ীরা এর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে সরব হন। ভাটা পড়ে অভিযান কার্যক্রমে। এ অবস্থায় দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে সমন্বিত অভিযানের বিষয়ে ভাবছে সংস্থাগুলো। আগামী ১৪ মার্চ রাজউক সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে এ সংক্রান্ত একটি বৈঠক ডেকেছে। তাছাড়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও তদারক কর্তৃপক্ষ ও সেবা সংস্থাগুলোকে নিয়ে খুব শীঘ্রই বসবে।


সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বড় দূর্ঘটনার পর সংস্থাগুলোর এমন অভিযান অনেকটাই লোকদেখানো। এবারের অপরিকল্পিত অভিযান মূলত রেস্তোঁরার বিরুদ্ধে। যেহেতু সর্বশেষ বড় ঘটনাটি রেস্তোঁরা ঘিরে একারণেই এমনটি করা হয়। যেমন এর আগে বঙ্গবাজারে ভয়াবহ আগুনের পর টার্গেট করা হয় মার্কেটগুলোকে। 


কিছুদিন পরই সেই প্রক্রিয়া থমকে যায়। প্রায় একই অবস্থা দেখা যাচ্ছে রেস্তোরার ক্ষেত্রেও। চলমান অভিযানে বিপদে পড়ে যায় ঢাকা ও আশপাশের এলাকার ৩০ হাজার রেস্তোঁরার ব্যবসায়ী। ঈদের আগে কর্মহীন হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ে রেস্তোঁরার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রায় ৫ লাখ কর্মী। অথচ এই রেস্তোরাগুলো বহু বছর ধরে গড়ে উঠেছে। তখন তদারক সংস্থাগুলো অনেকটাই চুপ ছিল। 


তদারকির অভাবে যখন বড় দুর্ঘটনা ঘটলো, তখন জনরোষের মুখে রাতারাতি প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে তৎপরতা দেখায় সংশ্লিষ্টরা। যেমন এবার যেহেতু আগুনের ঘটনায় তিতাস গ্যাসের সংশ্লিষ্টতা সেভাবে মেলেনি, এ কারণে অবৈধ গ্যাস সংযোগ নিয়ে তিতাসের তৎপরতাও চোখে পড়ছে না। অথচ মগবাজার বিস্ফোরণ, সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণসহ তাদের দিকে অভিযোগের তীর ছিল-এমন ঘটনাগুলোর পর তারা অবৈধ গ্যাস সংযোগ নিয়ে খুবই সোচ্চার ছিল।


এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল যুগান্তরকে বলেন, নিয়মনীতি না মেনে ভবন নির্মাণ ও এর ব্যবহারের বিষয়গুলোর নিয়মিত তদারকি হয় না। যখন বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটে তখন সবাই নড়েচড়ে বসে। অভিযান শুরু হয়। প্রকৃত অর্থে এই অভিযান অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়। কারণ কয়েকদিন জোরেশোরে চলা অভিযান কিছুদিন গেলেই থেমে যেতে থাকে। এভাবে না করে বছরজুড়ে নিয়মিত তদারকি প্রয়োজন। সকল তদারক কর্তৃপক্ষকে যদি সক্রিয় না করা যায়, তাহলে শুধু কর্মচারী কিংবা ভবন মালিকদের ধরেও খুব বেশি লাভ নেই। এজন্য তদারক সংশ্লিষ্টদেরও জবাবদিহিতার আওতায় আনা জরুরি।


রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীরা বলছেন, একটি হোটেল বা রেস্টুরেন্ট করতে বর্তমানে ১০-১১ জায়গা থেকে অনুমতিপত্র বা ছাড়পত্র নিতে হয়। যত বেশি দপ্তরের অনুমতির প্রয়োজন হবে, ততো টাকার বিষয়। ব্যবসায়ী পেলেই অনুমতি প্রদানের দায়িত্বে থাকা পক্ষ টার্গেট করে। পদে পদে চলে হয়রানি। এ কারণে অনেকে সৎ উদ্দেশ্য থাকার পরেও অনুমতি নিতে ব্যর্থ হন। ফলে সমস্যা আরও প্রকট হয়। এজন্য একটি কর্তৃপক্ষ গঠন করে তাদের নিয়ন্ত্রণে সব সংস্থার অনুমোদনের দাবি দীর্ঘদিনের। তবে তাতে কেউ সাড়া দেয়নি।


এ বিষয়ে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে লোকদেখানো অভিযান চলছে। কারণ দোকান বন্ধ করলেও তাদের লাভ, খোলার অনুমতি নিতে গেলেও লাভ। এজন্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এই অভিযান চালানো হচ্ছে। বছরের পর বছর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো চলছিল, নিয়ম না মানলে তখন কেন ব্যবস্থা নেওয়া হলো না? অনেকে প্রতিষ্ঠানের সব ধরনের সনদ থাকার পরেও দোকান বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। তাহলে যারা সনদগুলো দিল তাদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হয় না? যারা তদারকি করল না তারা কেন পার পেয়ে যায়?


হেলাল উদ্দিন আরও বলেন, হোটেল-রেস্তোঁরাগুলোতে সবচেয়ে কম শিক্ষিত মানুষ কাজ করে। দোকান মালিক কিংবা তারা তো অগ্নিনিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ না। কী করলে ঝুঁকি বাড়ে, কীভাবে কমবে-এর কিছুই তো তারা জানেন না। তাদের জন্য তো সরকার কোনো প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করেনি। অথচ দুর্ঘটনার পর সকল দায় তাদের। পৃথিবীর কোথাও এমন নেই। তদারকি যারা করলো না তাদের বিচার নেই। সব দোষ ব্যবসায়ীদের।


অভিযানে ভাটা কেনঃ অভিযান পরিচালনাকারী সংস্থাগুলো বলছে, শুরুতে অনিয়ম বেশি ছিল বলে অভিযানও বেশি পরিচালনা করা হয়েছে। তবে প্রক্রিয়া থেমে যায়নি। এখন থেকে বছরজুড়ে অভিযান পরিচালনা করা হবে। এখন তারা সমন্বিত অভিযানের কথা ভাবছে। এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অতিরিক্ত আইজিপি পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) ড. খ. মহিদ উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, সবসময় অভিযান একভাবে চলবে এমন তো নয়। এটি প্রয়োজন অনুযায়ী বাড়ে বা কমে। তবে অভিযান থামেনি। বছরজুড়ে আমাদের তদারকি চলবে।


রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)-এর পরিচালক (উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ-২) প্রকৌশলী মো. মোবারক হোসেন যুগান্তরকে বলেন, নির্দিষ্ট ঘটনার পর একই ধরনের প্রতিষ্ঠানে অভিযান চলে বিষয়টি এমন নয়। আমরা বছরজুড়ে কাজ করি। তবে রাজউকের একার পক্ষে সব সম্ভব নয়। সবার দায় দিনশেষে রাজউকের ওপর চাপানো হয়। 


অকুপেন্সি সার্টিফিকেট (ভবন ব্যবহারের অনুমতিপত্র) ছাড়া সেবা সংস্থাগুলো কীভাবে ভবনে সংযোগ দেয়। সেখানে রাজউকের দেওয়া শর্ত মানা হয় কি না-এগুলোও তো দেখা প্রয়োজন। ফায়ার সার্ভিস, তিতাস, সিটি করপোরেশন সবাইকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। শুধু দোষারোপ করে লাভ নেই। ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া সেলের কর্মকর্তা মো. শাহজাহান শিকদার বলেন, অভিযান সারা বছরই হয়। তবে বড় দুর্ঘটনাগুলোর সময় সবার চোখে পড়ে। আর মোবাইল কোর্টের ক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেটদের সময় পাওয়াটাও একটি বিষয়। সে কারণে হয়তো বছরজুড়ে এটা সেভাবে চোখে পড়ে না। যখন যেমন ঘটনা তখন তেমন অভিযান কেন-এ বিষয়ে তিনি বলেন, যে ধরনের দুর্ঘটনা, সে ধরনের অ্যাকশন গ্রহণের বিষয়ে মানুষের প্রত্যাশা থাকে। সেগুলোর সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই আমরা কাজ করি।


এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (অতিরিক্ত সচিব) মীর খায়রুল আলম যুগান্তরকে বলেন, আমরা মূলত সবাইকে নিয়ে সমন্বিত কার্যক্রমের চিন্তা করছি। সিটি করপোরেশন, রাজউক, ফায়ার সার্ভিস এবং সকল সেবা সংস্থাগুলোকে নিয়ে এই কাজটি করতে পারলে ভালো ফলাফল পাওয়া যাবে। আমরা চাই ব্যবসায়ীরাও যেন ব্যবসা করতে পারে। তাদেরকে এজন্য কিছুটা সময় দিতে চাই। যাতে তারা ত্রুটিগুলো কাটিয়ে উঠতে পারে। এরপরেও সংশোধন না হলে আমরা সমন্বিতভাবে ‘স্ট্রাইক’ করব।


শেয়ার করুন