বাজার ব্যবস্থাপনায় একধরনের বিশৃঙ্খলা চলছে। রোজায় পণ্যমূল্য সহনীয় রাখতে ভোজ্যতেল, চিনি ও খেজুরের দাম নির্ধারণ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু সেই দামে বাজারে পণ্য নেই। ক্রেতার কিনতে হচ্ছে বাড়তি দরে। পাশাপাশি শুক্রবার ২৯টি পণ্যের যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করে দেয় কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। কিন্তু তদারকি না থাকায় দ্বিতীয় দিনেও খুচরা বাজারে সেই দামে পণ্য পাওয়া যাচ্ছে না। পাশাপাশি সরকার থেকে যেসব নীতিসহায়তা দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর সুফলও ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছায়নি। ফলে রোজার বাজারে একধরনের অস্বস্তিতে ভোক্তা।
শুক্রবার পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে ২৯টি কৃষিপণ্যের যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। কিন্তু বাজার ঘুরে ওই দামে পণ্য পাওয়া যাচ্ছে না। প্রতিটি পণ্যই ৫ থেকে ১০০ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, পণ্যের দাম কারসাজির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার নজির কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের নেই। তাই প্রতিষ্ঠানটিতে জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা এবং শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন। তিনি বলেন, বাজার তার নিজ নিয়মে চলে। পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারলে দাম কম থাকে। আবার সরবরাহে ঘাটতি থাকলে দাম বাড়ে। আমাদের দেখতে হবে জনসংখ্যার তুলনায় পণ্যের চাহিদার পরিসংখ্যান ঠিক আছে কি না। সরবরাহ সেই পরিমাণে হচ্ছে কি না।
তিনি বলেন, দুইদিন আগে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর ২৯ পণ্যের যৌক্তিক মূল্য বেঁধে দিয়েছে। কিন্তু তারা কি একবারও বাজারে গিয়ে দেখেছে, সেই দামে পণ্য বিক্রি হচ্ছে কি না? শুধু দাম নির্ধারণ করলেই হবে না। সেই দামে বিক্রিতে বাধ্য করতে হবে। প্রয়োজনে আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
অধিদপ্তরের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, নতুন নির্ধারিত মূল্য অনুযায়ী খুচরা পর্যায়ে গরুর মাংস কেজিতে সর্বোচ্চ ৬৬৪ টাকা ৩৯ পয়সা এবং খাসির মাংস ১০০৩ টাকা ৫৬ পয়সায় বিক্রি করতে হবে। কিন্তু খুচরা বাজারে প্রতি কেজি গরুর মাংস ৭৫০-৭৮০ ও খাসির মাংস ১১০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। মুগডাল ১৬৫ টাকা কেজি বিক্রির কথা থাকলেও বিক্রি হচ্ছে ১৭০ টাকায়। ছোলা ৯৮ টাকা ৩০ পয়সা নির্ধারণ করা হলেও খুচরা পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে ১১০-১১৫ টাকা। মসুর ডালের (উন্নত) দাম ১৩০ টাকা ৫০ পয়সা, বিক্রি হচ্ছে ১৪০ টাকা। খেসারি ডাল ৯২ টাকা ৬১ পয়সা নির্ধারণ করলেও ১৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
প্রতি কেজি পাঙাশের (চাষের মাছ) দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১৮০ টাকা ৮৭ পয়সা, বিক্রি হচ্ছে ২০০-২২০ টাকা। অধিদপ্তরের তালিকায় কাতলা মাছের কেজি ৩৫৩ টাকা ৫৯ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৪০০ টাকা। ব্রয়লার মুরগির কেজি ১৭৫ টাকা ৩০ পয়সা এবং সোনালি মুরগি ২৬২ টাকা নির্ধারণ করেছে। বিক্রি হচ্ছে ২২০ ও ৩৫০ টাকা। ডিম প্রতিটি ১০ টাকা ৪৯ পয়সা নির্ধারণ করলেও বাজার কিংবা পাড়া-মহল্লার দোকানে ১২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দেশি পেঁয়াজ কেজি ৬৫ টাকা ৪০ পয়সা ধরা হলেও ৮০-৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
অধিদপ্তরের তালিকায় দেশি রসুন প্রতি কেজি ১২০ টাকা ৮১ পয়সা, বিক্রি হচ্ছে ১৫০-১৬০ টাকা। আমদানি করা আদা প্রতি কেজি ১৮০ টাকা ২০ পয়সা, বিক্রি হচ্ছে ২৫০ টাকা। শুকনা মরিচ প্রতি কেজি ৩২৭ টাকা ৩৪ পয়সা, বিক্রি হচ্ছে ৪৫০ টাকা। কাঁচা মরিচ প্রতি কেজি ৬০ টাকা ২০ পয়সার স্থলে বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা। বাঁধাকপি ২৮ টাকা ৩০ পয়সা, বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকা। ফুলকপি কেজি ২৯ টাকা ৬০ পয়সার স্থলে বিক্রি হচ্ছে ৪৫-৫০ টাকা।
এছাড়া বেগুনের কেজি ৪৯ টাকা ৭৫ পয়সা, বিক্রি হচ্ছে ৬০-৮০ টাকা। শিমের কেজি ৪৮ টাকা, বিক্রি হচ্ছে ৫০-৬০ টাকা। আলু ২৮ টাকা ৫৫ পয়সা নির্ধারণ করলেও বিক্রি হচ্ছে ৩০-৩৫ টাকা। টমেটো ৪০ টাকা ২০ পয়সা, বিক্রি হচ্ছে ৬০-৭০ টাকা। জাইদি খেজুর কেজি ১৮৫ টাকা ৭ পয়সা, বিক্রি হচ্ছে ২২০-২৬০ টাকা। প্রতি হালি সাগর কলা ২৯ টাকা ৭৮ পয়সার স্থলে বিক্রি হচ্ছে ৪০-৪৫ টাকা। বেসন ১২১ টাকা ৩০ পয়সা দাম বেঁধে দেওয়া হয়েছে। বিক্রি হচ্ছে ১১০-১২৫ টাকা।
কাওরান বাজারে পণ্য কিনতে আসা মো. ইমতিয়াজ বলেন, পণ্যের মূল্য বেঁধে দেওয়া একটা ‘আই ওয়াশ’। কারণ, সরকারের সংস্থা পণ্যের দাম নির্ধারণ করে বাজারের আর খবর রাখে না। তারা কাগজে-কলমে দাম নির্ধারণ করে দায় সারে। কিন্তু ক্রেতার বাড়তি দরেই পণ্য কিনতে হয়।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মাসুদ করিম বলেন, আমরা দাম বেঁধে দিইনি, যৌক্তিক দাম কত হওয়া উচিত, তা নির্ধারণ করে দিয়েছি। সে অনুযায়ী সংস্থাগুলো অভিযান চালাবে, ব্যবস্থা নেবে। মাঠ থেকে আসা তথ্য বিশ্লেষণ করেই দাম নির্ধারণ করেছি।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ড. এম কে মুজেরী বলেন, বাজার ব্যবস্থাপনায় পণ্যের চাহিদা আছে, ক্রেতাও আছে। বিক্রেতারা তাদের পণ্যের দাম নির্ধারণ করে বিক্রি করবে। সেক্ষেত্রে সরকার পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিয়ে সেই দামে পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য করতে পারবে না। আর এটা সমাধানও নয়। সমাধান হচ্ছে, বাজার ব্যবস্থাপনা উন্নত করতে হবে। পাশাপাশি পণ্যের সরবরাহ বাড়াতে হবে। তাহলে বিক্রেতারা পণ্যের দাম বাড়াতে পারবে না।
চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, জেলা প্রশাসনের নির্দেশের পরও চট্টগ্রামের বেশির ভাগ বাজার, মুদি দোকান ও আড়তে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যতালিকা টানানো হয়নি। ব্যবসায়ী ও আড়তদাররা তাদের মর্জিমাফিক পণ্যের দাম আদায় করছেন। কিছু কিছু বাজারে জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান পরিচালনার সময় ১০-১৫ মিনিটের জন্য তালিকা টানানো হয়। অভিযান শেষে ম্যাজিস্ট্রেট স্থান ত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে তালিকা উধাও হয়ে যাচ্ছে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে হতাশ কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ক্যাব।
এদিকে সাধারণ জনগণের ভোগান্তি রোধে নগরীর পাইকারি ও খুচরা বাজারে আড়তসহ প্রতিটি দোকানে পণ্যমূল্য তালিকা বাধ্যতামূলকভাবে টাঙিয়ে রাখা এবং একই সঙ্গে পণ্য বেচাকেনার রসিদ সঙ্গে রাখতে নির্দেশ দিয়েছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। নির্দেশনা অমান্য করলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণসহ ট্রেড লাইসেন্স অথবা নিবন্ধন সাময়িকভাবে বাতিল এবং পণ্য বাজেয়াপ্ত করা হবে বলেও উল্লেখ করা হয়। তবুও মানতে দেখা যাচ্ছে না এই নির্দেশনা।