ন্যাশনাল সিঙ্গেল উইন্ডো (এনএসডব্লিউ) প্রকল্পে স্বার্থের দ্বন্দ্ব প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে। সফটওয়্যার কেনার কাজ পাইয়ে দিতে প্রকল্পে দায়িত্বরত অবস্থায় যেসব কর্মকর্তা পেছন থেকে কলকাঠি নেড়েছেন, অবসরে গিয়ে তারা সেই প্রতিষ্ঠানের পরামর্শক হিসাবে কাজে যোগ দিয়েছেন। এখন ওই কর্মকর্তারাই আবার প্রভাব খাটিয়ে নিজের প্রতিষ্ঠানকে হার্ডওয়্যার (কম্পিউটার সামগ্রী) কেনার কাজ পাইয়ে দিতে তদবির শুরু করছেন। যদিও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এক প্রভাবশালী সদস্যের ‘সুনজর’ থাকায় প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা এ বিষয়ে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে নারাজ।
অনুসন্ধানে জানা যায়, এনবিআর-এর সিস্টেম ম্যানেজার হিসাবে একসময় দায়িত্ব পালন করেন একেএম জাহিদ হোসেন। ওই সময় তাকে এনএসডব্লিউ প্রকল্পের সফটওয়্যার কেনার সর্বোচ্চ ব্যয় প্রাক্কলনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই কর্মকর্তার সম্ভাব্য সর্বোচ্চ দর এবং সফটওয়্যারের সরবরাহের কাজ পাওয়া প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাবিত দর ছিল প্রায় কাছাকাছি। সফটওয়্যার কেনার টেন্ডারের শর্তে উল্লেখ ছিল-স্থানীয় কাস্টমস কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের অর্থ স্থানীয় মুদ্রায় টেন্ডার ডকুমেন্টে উল্লেখ করতে হবে। কিন্তু আইটি কর্মকর্তা অজ্ঞাত বা ভুলবশত স্থানীয় মুদ্রার বিষয়ে তার গোপনীয় নথিতে উল্লেখ করেননি। যেই প্রতিষ্ঠান সফটওয়্যার সরবরাহে কাজ পেয়েছে, সেই প্রতিষ্ঠানও ‘কাকতালীয়ভাবে’ দরপত্রে স্থানীয় মুদ্রা উল্লেখ করেনি। এ বিষয়ে জানতে পেরে টেন্ডারে অংশ নেওয়া বাকি প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো যোগসাজশের অভিযোগ এনে এনবিআর চেয়ারম্যানের কাছে লিখিত অভিযোগ করে। কিন্তু তৎকালীন প্রকল্প পরিচালক জাকিয়া সুলতানার অদৃশ্য ইশারায় সেই অভিযোগ ধামাচাপা পড়ে যায় বলে অভিযোগ ওঠে।
চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর পিআরএল শেষে তিনি এখন ওয়েব ফন্টেইনের পরামর্শক হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি এখন ওয়েব ফন্টেইনের হয়ে সফটওয়্যারের মডিউল ডেভেলপের পাশাপাশি এনবিআর-এর বর্তমান আইটি কর্মকর্তাদের সঙ্গে লিয়াজোঁ স্থাপনের কাজ করছেন। জাহিদ হোসেনের পর এনবিআর-এর সিস্টেম ম্যানেজার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন ফজলুর রহমান। তিনিও এখন ওয়েব ফন্টেইনে দৈনিক চুক্তিভিত্তিক কাজ করছেন বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে জাহিদ হোসেন বলেন, ‘প্রকল্পে থাকা অবস্থায় আমি ওয়েব ফন্টেইনকে চিনতাম না। তাছাড়া সফটওয়্যার কেনার কোনো ইভালুয়েশন কমিটিতেও আমি ছিলাম না। পিআরএলে থাকা অবস্থায় স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের একটি প্রকল্পে কাজ শুরু করি। পরে ওয়েব ফন্টেইনের পক্ষ থেকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে আমি ওদের পরামর্শক হিসাবে কাজ করছি।’
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, সদ্য অবসরে যাওয়া এনবিআর-এর সদস্য জাকিয়া সুলতানা দীর্ঘদিন এনএসডব্লিউ প্রকল্পের পরিচালক এবং পরবর্তী সময়ে এনবিআর-এর এনএসডব্লিউ শাখার সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। প্রকল্প পরিচালক থাকা অবস্থায় পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দিতে তিনি প্রকিউরমেন্ট গাইডলাইনের তোয়াক্কা না করে দরপত্রে একটি ব্র্যান্ড বা পণ্যের বাণিজ্যিক নাম উল্লেখ করে দেন। এ বিষয়ে তৎকালীন পরামর্শক প্রতিষ্ঠান থেকে আপত্তি জানানো হলেও গোপনীয়তার অজুহাতে সফটওয়্যার কেনার টেন্ডার মূল্যায়ন কার্যক্রম থেকে তাদের কৌশলে বাইরে রাখা হয়। মূলত একক হস্তক্ষেপে দরপত্রের শর্ত পূরণে ব্যর্থ প্রতিষ্ঠানকে সফটওয়্যার সরবরাহের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এ নিয়ে অর্থ লেনদেনের অভিযোগ উঠলে সেটি সামাল দেন এনবিআর-এর অপর প্রভাবশালী সদস্য।
অবসরে যাওয়ার পরপরই বিশ্বব্যাংকের পরামর্শক হিসাবে এনএসডব্লিউ প্রকল্পে যুক্ত হওয়া, আপনার বিরুদ্ধে উত্থাপিত এক কোম্পানিকে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ সমর্থন করে কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে জাকিয়া সুলতানা যুগান্তরকে বলেন, ‘কার স্বার্থে রিপোর্ট করছেন জানি না। আপনি মনের মাধুরী মিশিয়ে যা ইচ্ছা তাই লিখতে পারেন। আমি কিছুই বলব না।’