২৩ নভেম্বর ২০২৪, শনিবার, ০৪:০৮:২০ অপরাহ্ন
কৃষিজমিতে সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র: ভালো উদ্যোগে মন্দের ভয়
  • আপডেট করা হয়েছে : ১১-০৫-২০২৪
কৃষিজমিতে সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র: ভালো উদ্যোগে মন্দের ভয়

বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সারা বিশ্বই ঝুঁকছে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে। তার অংশ হিসেবে বাংলাদেশ সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করছে। গত ১৫ বছরে নির্মিত হয়েছে ১০টি বিদ্যুৎকেন্দ্র। ৩৪ জেলায় আরও ৮৬টি সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা করেছে সরকার। মোট সাড়ে ৮ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার এসব কেন্দ্র নির্মাণে প্রয়োজন প্রায় ৩০ হাজার একর জমি। কিন্তু এসব কেন্দ্রের জন্য যে জমি সংগ্রহ করা হচ্ছে, তার বড় অংশই আবাদযোগ্য কৃষিজমি। অথচ সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে অকৃষিজমি ব্যবহারেরই কথা ছিল।


এ ব্যাপারে গত মার্চে বৈদেশিক অর্থায়নপুষ্ট প্রকল্পগুলো যথাসময়ে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের নেতৃত্বে ৫ সদস্যের উচ্চপর্যায়ের কমিটির প্রথম সভায় মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া বলেছিলেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে কৃষিজমিতে কোনো সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা যাবে না।


তবে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলছেন উল্টো কথা। তাঁর দাবি, কৃষিজমি ছাড়া সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সুযোগ নেই।


বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র বলেছে, গত ১৫ বছরে ১০ জেলায় ১০টি সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে, যার সম্মিলিত উৎপাদন ক্ষমতা ৪৬১ মেগাওয়াট। এরপর ২১ জেলায় ৩০টি সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে, যার সম্মিলিত ক্ষমতা ১ হাজার ৭৪৩ মেগাওয়াট। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে পাবনায় ৪টি, পঞ্চগড়, ময়মনসিংহ ও ফেনীতে ৩টি করে এবং নীলফামারী ও জামালপুরে ২টি করে বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে। বাকি ১৩ জেলায় একটি করে বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।


এই ৪০টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে সবচেয়ে বড় ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার তিস্তা সোলার পাওয়ার প্ল্যান্ট। এটি গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে অন্তত ১ হাজার একর জমির ওপর নির্মিত হয়েছে। কেন্দ্রটি গত বছরে উৎপাদনে গেছে। এর জন্য নেওয়া জমির বেশির ভাগই উর্বর কৃষিজমি। লালমনিরহাটের শৈলমারীতেও বেসরকারি উদ্যোগে নির্মিত হচ্ছে সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র। স্থানীয় কৃষকেরা জানিয়েছেন, এই কেন্দ্রের জন্য যেসব জমি সংগ্রহ করা হয়েছে, তার সিংহভাগ তিন ফসলি জমি।


এ ব্যাপারে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতের বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী মো. জাকির হোসেন খান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি সৌরবিদ্যুতের রেডিয়েশন যেখানে আছে, সেই পার্বত্য চট্টগ্রামে অকৃষিজমির মাত্র ৫ শতাংশ নিলে ২৮ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। সরকার সেটা না করে কৃষিজমিতে বেসরকারি কোম্পানিগুলোকে সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র করার অনুমতি দিচ্ছে। এতে কৃষি উৎপাদন কমে খাদ্যঘাটতি তৈরি হবে।’


৩৪ জেলায় হবে ৮৬ বিদ্যুৎকেন্দ্র

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র বলেছে, ৩০টি সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প এরই মধ্যে অনুমোদন পেয়েছে। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের নানা পর্যায়ে আছে। এখন নতুন করে ৫৬টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। নতুন এই ৮৬টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হবে দেশের ৩৪ জেলায়। এসব জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ আসবে নোয়াখালী থেকে। এখানে পাঁচটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মোট উৎপাদন ক্ষমতা হবে ১ হাজার ৬১০ মেগাওয়াট।


সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যায় সবচেয়ে এগিয়ে কক্সবাজার। এখানে নির্মাণ করা হবে ৯টি কেন্দ্র, যেগুলোর মোট উৎপাদন ক্ষমতা হবে ১ হাজার ২০ মেগাওয়াট। এখানে এর আগে ২০ মেগাওয়াটের একটি সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র হয়েছে। এই কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদিতও হচ্ছে। এ ছাড়া ফেনীতে হবে চারটি কেন্দ্র, পাওয়া যাবে ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। চট্টগ্রামে ৫ বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে আসবে ৪৪০ মেগাওয়াট। ময়মনসিংহে তিন কেন্দ্র থেকে আসবে ৪৪০ মেগাওয়াট। জামালপুরে তিনটি কেন্দ্র থেকে আসবে ৫১০ মেগাওয়াট। কুড়িগ্রামে তিন কেন্দ্রের মোট উৎপাদন ক্ষমতা হবে ২৩০ মেগাওয়াট। এর বাইরে লালমনিরহাট, ফরিদপুর, দিনাজপুর, রংপুর, নেত্রকোনা, পঞ্চগড়, রাজবাড়ীতে একাধিক সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হবে।


সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে কৃষিজমির ব্যবহার ঠেকানোর একটি কৌশল বাতলে দিয়ে জাকির হোসেন খান বলেন, ‘সারা দেশে একটা ম্যাপ করতে পারে সরকার। সেই ম্যাপের বাইরে সৌরবিদ্যুৎ করা যাবে না। আমরা প্যারিস চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে কৃষককে কৃষি থেকে উচ্ছেদ করে খাদ্যসংকটে ফেলতে পারি না। এর প্রভাব হবে অত্যন্ত নেতিবাচক। এভাবে কৃষিজমিতে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি দেওয়ার পেছনে দুর্নীতি ছাড়া আর কিছুই থাকতে পারে না।’


১৫ বছরে কতটুকু এগোল সৌরবিদ্যুৎ

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর জাইকার অর্থায়নে ও কারিগরি সহায়তায় বিদ্যুতের মহাপরিকল্পনা করে। সেখানে বলা হয়, ২০১৫ সালে মোট বিদ্যুতের ৫ শতাংশ এবং ২০২১ সালে মোট বিদ্যুতের ১০ শতাংশ আসবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে। আর ২০৪০ সাল নাগাদ দেশে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে, যার ৪০ ভাগই আসবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে।


তবে সরকারের সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের গতি এখনো ধীর। দেশের ভেতর স্থাপিত বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং ভারত থেকে আসা বিদ্যুৎ যোগ করলে বাংলাদেশের এখন উৎপাদন ক্ষমতা ২৬ হাজার মেগাওয়াট। মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী এই বিদ্যুতের ১০ শতাংশ, অর্থাৎ ২ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট আসার কথা নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎস থেকে। অথচ বিদ্যুৎ আসে মাত্র ৭২১ মেগাওয়াট।


এর মধ্যে ১০টি সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র সরবরাহ করে ৪৬১ মেগাওয়াট। কক্সবাজারে নির্মিত একটি বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে আসে ৬০ মেগাওয়াট। পাকিস্তান আমলে নির্মিত কাপ্তাই জলবিদ্যুৎকেন্দ্র দেয় বাকিটা। তবে কাপ্তাই লেকে পানি কমে গেলে এই কেন্দ্রের উৎপাদনক্ষমতা কমে ৮০ মেগাওয়াটে নেমে যায়।


অবশ্য বিশ্বে এককভাবে সোলার হোম সিস্টেম বা বাসাবাড়িতে সৌর প্যানেল স্থাপনের রেকর্ডটি বাংলাদেশের। প্রত্যন্ত চরাঞ্চলে এ ধরনের প্যানেল স্থাপন করা হয়েছে। সরকারি হিসাবে ৫০ লাখের মতো পরিবার সৌর প্যানেল ব্যবহার করে। তবে প্রত্যন্ত এলাকায় বিদ্যুতের সরবরাহ পৌঁছে যাওয়ায় এবং সৌর বিদ্যুতে খরচ বেশি হওয়ায় অনেকে আগ্রহ হারাচ্ছে।


সার্বিক বিষয়ে কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সিনিয়র সহসভাপতি ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলম আজকের পত্রিকাকে বলেন, যে প্রক্রিয়ায় সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি হচ্ছে, তাতে গোটা বাংলাদেশ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠবে। এই প্রবণতা এখনই থামাতে না পারলে বড় সর্বনাশ হয়ে যাবে।


শেয়ার করুন