আগামী (২০২৪-২৫) অর্থবছরে দেশের প্রায় ৫ কোটি মানুষকে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীতে আনতে যাচ্ছে সরকার। সেই লক্ষ্যে বাড়ানো হচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা। বাজেটে বাড়ছে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বরাদ্দ। আগামী বাজেটে এ খাতের বরাদ্দ ৩ হাজার ৭২৮ কোটি বাড়িয়ে মোট ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
দেশে ১৪ মাস ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপর অবস্থান করছে। বৈশ্বিক দীর্ঘমেয়াদি সংকট, অভ্যন্তরীণ উৎপাদন সীমাবদ্ধতা, ভোগ্যপণ্যের আমদানিনির্ভরতা, ডলারের দাম লাগামহীন বৃদ্ধি এবং সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির বিরূপ প্রভাব পড়ছে সবশ্রেণির ক্রেতা-ভোক্তা তথা সাধারণের আয় এবং জীবন-জীবিকায়। এতে কমছে বিনিয়োগ, কমছে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ। অথচ ক্রমশ বাড়ছে জীবনযাত্রার ব্যয়। বিভিন্ন সংস্থার গবেষণা তথ্য বলছে, এই বাস্তবতায় তাল মেলাতে মানুষের হিমহিম দশা। আগের থেকে দেড়-দুই গুণ বেশি খরচ করেও মানুষকে চাহিদার সঙ্গে আপস করতে হচ্ছে। এসবের দীর্ঘমেয়াদি ধাক্কা—অতিদারিদ্র্য ও দরিদ্র শ্রেণি তো বটেই, নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণিরও পারিবারিক ও সামাজিক ভিত্তি দুর্বল থেকে দুর্বলতর পর্যায়ে পৌঁছেছে। দেশে এই যখন পরিস্থিতি—ঠিক সেই মুহূর্ত সামনে
রেখে আগামী ৬ জুন জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট উপস্থাপন করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা কালবেলাকে জানিয়েছেন, প্রস্তাবিত ওই বাজেটে অর্থমন্ত্রী লাগামহীন এই মূল্যস্ফীতির কশাঘাত মোকাবিলায় ৪ কোটি লাখ ৯১ লাখ ৪৪ হাজার মানুষকে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীমূলক বিভিন্ন কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা সাজিয়েছেন। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছর সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের ১৩০টি কর্মসূচির আওতায় মোট ১ লাখ ২৬ হাজার ২৭২ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে এই বরাদ্দ ৩ হাজার ৭২৮ কোটি টাকা বাড়িয়ে মোট ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা করার প্রস্তাব দেবেন অর্থমন্ত্রী।
এদিকে বাজেটীয় উদ্যোগে সরাসরি নগদ অর্থ তথা ভাতার উপকারভোগীর আওতা বাড়িয়ে ১ কোটি ৩৮ লাখ ৭৩ হাজার মানুষকে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীমূলক বিভিন্ন কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। আর টিসিবির ভর্তুকি মূল্যের কার্যক্রম এবং ওএমএসসহ বিভিন্ন রকম খাদ্য সহায়তা ও কর্মসংস্থানমূলক কর্মসূচির আওতায় আসছে ৩ কোটি ৭২ লাখ ৯৭ হাজার মানুষ।
জানা গেছে, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছর এই দুই কর্মসূচিতে মোট সুবিধাভোগী রয়েছেন ৪ কোটি ৭১ লাখ ১৭ হাজার ২০০ মানুষ। অর্থাৎ আগামী অর্থবছর সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর বিভিন্ন কর্মসূচিতে আরও ২০ লাখ ২৬ হাজার ৮০০ জন যুক্ত করা হচ্ছে। এর মধ্যে বিভিন্ন ভাতা বা নগদ অর্থের আওতায় আসবে ১০ লাখ ২৬ হাজার ৮০০ জন। যারা সবাই অতিদরিদ্র। বাকি বাকি ১০ লাখ মানুষকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির মুখে ওএমএসসহ বিভিন্ন খাদ্য সহায়তা কর্মসূচিতে যুক্ত করা হবে। চলতি অর্থবছরে খাদ্য নিরাপত্তা ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিমূলক কর্মসূচির আওতায় ১৬ হাজার ৮১৪ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। আগামী অর্থবছরের বাজেটে এটা ১৮ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ ও পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমেদ কালবেলাকে বলেন, প্রতিবছর বাজেট সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বাড়ে এবং কিছু ক্ষেত্রে আওতা ও ভাতার পরিমাণও বাড়ে—এটা বর্তমান সরকারের একটা নিয়মিত দর্শন হয়ে উঠেছে। তবে আমি মনে করি, আগামী বাজেটে সবচেয়ে ভালো উদ্যোগ হবে যদি শেষ পর্যন্ত ওএমএসসহ বিভিন্ন খাদ্য সহায়তা কর্মসূচিতে নতুন অন্তর্ভুক্তির সংখ্যা ১০ লাখ বহাল থাকে। এতে দেশের অধিকাংশ অতিদরিদ্র ও দরিদ্র শ্রেণির মানুষের কাজের বিনিময়ে খাদ্য এবং অর্থ পাওয়ার একটা নিশ্চিত ক্ষেত্র তৈরি হবে, যা বর্তমান ঊর্ধ্বগতির মূল্যস্ফীতিতে জীবনযাপনে কিছুটা হলেও সহায়ক হবে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) স্টাফ মিশন ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের তৃতীয় কিস্তি ছাড়ে ১৮ দিনের ঢাকা সফর শেষে মিশন প্রধান ক্রিস পাপা জর্জিও সরকারের প্রতি পরামর্শ রেখেছেন, বৈশ্বিক সংকট, ডলারের দাম বৃদ্ধি, মুদ্রা বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা এবং অতিমাত্রার আমদানি নির্ভরতার কারণে আগামী দিনে ভোক্তার ওপর চাপ আরও বাড়বে। এটা সরকারকে সমালোচনার মুখে ফেলবে। তবে এর থেকে উত্তরণে সরকারের উচিত হবে ভিন্ন কোনো উপায়ে জনগণ ও ভোক্তাকে সহায়তা দেওয়া। সেক্ষেত্রে সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচি জোরদার একটা ফলপ্রসূ উদ্যোগ হতে পারে।
আগামী অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় অন্যান্য উদ্যোগের মধ্যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে উপকারভোগী বাড়ানোর পাশাপাশি তাদের জন্য সরাসরি নগদ অর্থ তথা ভাতার পরিমাণও বাড়ানো হচ্ছে। এর মধ্যে বয়স্ক ভাতাভোগীর আওতা বাড়িয়ে নতুন যুক্ত করা হচ্ছে আরও দুই লাখ প্রবীণকে। এক্ষেত্রে সাধারণ প্রবীণদের ভাতা আগের মতো ৬০০ টাকা অপরিবর্তিত রাখা হলেও ৯০ বছরের প্রবীণ ও ভাতাভুক্ত সব জনগোষ্ঠীর ভাতার পরিমাণ ৬০০ থেকে বাড়িয়ে ১০০০ টাকায় উন্নীত করা হচ্ছে। অর্থাৎ এই শ্রেণির বয়স্ক ব্যক্তিদের ভাতা বাড়ছে ৪০০ টাকা। সব মিলিয়ে আগামী অর্থবছর এই কর্মসূচির আওতায় দেশের ৬০ লাখ মানুষকে সুবিধা দেওয়া হবে।
এ ছাড়া বাড়ছে বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতদের ক্ষেত্রে ভাতাভোগীর সংখ্যা। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, আগামী বাজেটে বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতদের ভাতাভোগীর সংখ্যা বাড়ছে ২ লাখ ৬০ হাজার ৮০০ জন। এই হিসাবে আগামী অর্থবছর এ কর্মসূচিতে মোট সুবিধা পাবেন ২৭ লাখ ৭৫ হাজার জন। তবে তাদের ভাতার পরিমাণ চলতি বছরের মতো ৫৫০ টাকাই অপরিবর্তিত থাকছে।
মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচির ক্ষেত্রে ভাতার পরিমাণ আগের মতোই রেখে উপকারভোগী বাড়ানো হচ্ছে নতুন করে আরও ২ লাখ ৬০ হাজার ৮০০ জন। বর্তমানে ১৩ লাখ ৪ জন এ সুবিধা পাচ্ছেন। এর ফলে আগামী বাজেটের মাধ্যমে এ কর্মসূচিতে সরাসরি ভাতা সহায়তা পাবেন ১৫ লাখ ৬৪ হাজার মা ও শিশু। এ ছাড়া প্রতিবন্ধী ভাতাভোগীও বাড়ছে। আগামী বাজেটে এ সংখ্যা ৩ লাখ ৩৪ হাজার জন বাড়িয়ে মোট ৩২ লাখ ৩৪ হাজার জনে উন্নীত করা হচ্ছে। বাদ যাচ্ছে না দেশ স্বাধীন করার কারিগর মুক্তিযোদ্ধারাও। বর্তমানে তারা ২০ হাজার টাকা করে প্রতিমাসে ভাতা পাচ্ছেন। আগামী বাজেটে ভাতাভোগী সংখ্যা অপরিবর্তিত রেখে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা আরও ৫ হাজার টাকা বাড়ানোর প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। বর্তমানে ২ লাখ ১৯ হাজার বীর মুক্তিযোদ্ধার ভাতা হিসেবে ৫ হাজার ১৭৬ কোটি ৭১ লাখ টাকা বরাদ্দ রয়েছে। আগামী অর্থবছরের জুলাই থেকে প্রতি মাসে ২৫ হাজার টাকা করে সম্মানী ভাতা পাবেন ওই সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা।