১১ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, মঙ্গলবার, ১১:২০:৫৭ অপরাহ্ন
কারাবন্দী ব্যবসায়ীর ৩ ব্যাংক হিসাবে রহস্যময় লেনদেন, ৩৭ লাখ টাকা ‘হাওয়া’
  • আপডেট করা হয়েছে : ১১-০২-২০২৫
কারাবন্দী ব্যবসায়ীর ৩ ব্যাংক হিসাবে রহস্যময় লেনদেন, ৩৭ লাখ টাকা ‘হাওয়া’

রাজশাহীতে হোসেন আলী নামের এক ব্যবসায়ী কারাবন্দী থাকা অবস্থায় তার তিনটি ব্যাংক হিসাব থেকে রহস্যজনকভাবে উধাও হয়ে গেছে ৩৭ লাখ টাকা। এমনকি যে সব চেকে টাকাগুলো তোলা হয়, সেগুলোর ক্লিয়ারেন্স দেওয়া হয় পুলিশের কাছে জব্দ থাকা মুঠোফোন থেকে।


সবশেষ ভুক্তভোগী ওই ব্যবসায়ী কারাগার থেকে জামিনে বেরিয়ে আদালতে করা মামলা দায়েরের পর বিষয়টি নিয়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। হোসেন আলী দাবি করছেন, গ্রেপ্তারের সময় তার গাড়ি থেকে চেক জব্দ করা হয়েছিল। সেই চেকে জাল স্বাক্ষর দিয়ে টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। এই টাকা তোলার জন্যই তাকে পরিকল্পিতভাবে মামলায় ফাঁসানো হয়েছিল।


ভুক্তভোগী হোসেন আলী রাজশাহী মহানগরের চন্ডিপুর মহল্লার বাসিন্দা।


বুধবার (৫ ফেব্রুয়ারি) রাজশাহী মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত—২ এ তিনি দুই ব্যাংকের ব্যবস্থাপক ও দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ ৭ জনের বিরুদ্ধে তিনি মামলাটি দায়ের করেন। মামলা নম্বর ১৬৭/২৫।


মামলায় আসামিরা হলেন— হোসেন আলীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু মাহমুদ হাসান শিশিল, তার দুই ম্যানেজার মাহমুদ হাসান লিমন ও তন্ময় হোসেন, নগরীর বোয়ালিয়া থানার তৎকালীন পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) আমিরুল ইসলাম, উপ-পরিদর্শক (এসআই) আব্দুল আওয়াল ও ইসলামী ব্যাংকের রাজশাহী শাখার ব্যবস্থাপক ও আইএফআইসি ব্যাংকের রাজশাহী শাখার ব্যবস্থাপক।


হোসেন আলীর আইনজীবী লিয়াকত আলী খান বলেন, আদালত মামলাটি গ্রহণ করে তদন্তের জন্য রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরএমপি) গোয়েন্দা শাখায় (ডিবি) পাঠিয়েছেন।


আরএমপির ডিবির পুলিশ পরিদর্শক ইব্রাহিম খলিল বলেন, ‘আদালতে এ রকম কোনো মামলা হয়েছে কি না তা এখনও জানি না। কাগজপত্র পেলে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’


জানা গেছে, হোসেন আলী প্লট এবং পুরনো গাড়ি কেনাবেচার ব্যবসা করেন। গত ১০ আগস্ট নগরীর রেলগেট এলাকায় যানবাহনে তল্লাশি করছিলেন একদল শিক্ষার্থী। ওই সময় হোসেন আলী প্রাইভেটকার চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তার গাড়ি তল্লাশি করে কিছু দেশীয় অস্ত্র পাওয়া যায়। তাছাড়া দুই বোতল ফেনসিডিল পাওয়া যায় ওই গাড়িতে। এসময় ট্রাফিকের দায়িত্বে থাকা শিক্ষার্থীরা তাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে সোপর্দ করেন। পরদিন তার বিরুদ্ধে একটি মামলা করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়।


ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেওয়ার অভিযোগের মামলার আরজিতে হোসেন আলী দাবি করেছেন, তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু শিশির এবং দুই কর্মচারী লিমন ও তন্ময় পরিকল্পিতভাবে তার অগোচরে গাড়ির পেছনে দেশীয় অস্ত্র ও ফেনসিডিল রাখেন। তারপর তারাই তথ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের দিয়ে গাড়িতে তল্লাশি চালায়।


ওই সময় তার গাড়িতে থাকা ব্যাগে ব্যাংকের চেকসহ অন্য জিনিসপত্রও ছিল। তবে চেকগুলো জব্দ তালিকায় দেখানো হয়নি। সেই চেক দিয়েই জাল স্বাক্ষরে টাকা তোলা হয়েছে বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে।


এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়েও অভিযোগ করে ই—মেইল পাঠিয়েছেন হোসেন আলী। অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, ইসলামী ব্যাংকের রাজশাহী শাখা থেকে গত ১৭ সেপ্টেম্বর ৯ লাখ, ১৮ সেপ্টেম্বর ১১ লাখ, ২২ সেপ্টেম্বর ৯ লাখ ও ২৬ সেপ্টেম্বর ৪ লাখ টাকা তোলা হয়েছে। চেকগুলোতে টাকা উত্তোলনকারীর নাম লেখা আছে হাসান। ১৭ সেপ্টেম্বর হোসেনের হিসাবে ছিল ৩৩ লাখ ৪ হাজার ৪৭৪ টাকা। চারটি চেকে ৩৩ লাখ টাকা তুলে নেওয়া হয়। এ ব্যাপারে ইসলামী ব্যাংকের রাজশাহী শাখা ব্যবস্থাপকের কাছেও লিখিত অভিযোগ করেছেন হোসেন।


এদিকে আইএফআইসি ব্যাংকে হোসেন আলীর রাজশাহী শাখার হিসাবে ছিল ৩ লাখ ৩ হাজার ৪৬ টাকা। এরমধ্যে রাজশাহী শাখা থেকে একটি চেকে গত ২৫ সেপ্টেম্বর তুলে নেওয়া হয় ৩ লাখ টাকা। আর ইউসিবি ব্যাংকের হিসাবে ছিল ১ লাখ ১৯ হাজার ৪১৮ টাকা। গত বছরের ১ অক্টোবর ব্যাংকটির রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার বানেশ্বর শাখা থেকে একটি চেকের মাধ্যমে তুলে নেওয়া হয় ১ লাখ ১৫ হাজার টাকা। এ ব্যাপারেও আইএফআইসি ও ইউসিবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপকের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন ব্যবসায়ী হোসেন আলী।


এ বিষয়ে আইএফআইসি ব্যাংকের রাজশাহী শাখা ব্যবস্থাপক রবিউল হোসেন ও ইউসিবি ব্যাংকের বানেশ্বর শাখার ব্যবস্থাপক সুজন মোর্শেদ জানান, স্বাক্ষর তাদের কাছে হোসেনেরই মনে হয়েছে। তারপরও ব্যাংকে চেক আসার পরে টাকা ছাড়ের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে হোসেন আলীর মোবাইলে ফোন করা হয়। এক ব্যক্তি ফোন ধরে নিজের পরিচয় হোসেন আলী নিশ্চিত করেন এবং তিনি টাকা পরিশোধ করে দিতে বলেন। তাই তারা টাকা দিয়ে দেন।


হোসেন আলী বলেন, ঐ সময় তিনি কারাগারে ছিলেন। তার ফোন জব্দ করেছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ব্যাংক কর্মকর্তার সঙ্গে তার কোনো কথাই হয়নি।


হোসেন কারাগারে থাকার ব্যাপারে জানতে চাইলে ইউসিবি ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক সুজন মোর্শেদ বলেন, ‘আমরা তো কণ্ঠ পরীক্ষা করতে পারি না।’ আইএফআইসি ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক রবিউল ইসলাম ‘গ্রাহক হোসেন আলী ই—মেইলে আমাদের প্রধান কার্যালয়েও অভিযোগ করেছেন। প্রধান কার্যালয় আমাকে একটি প্রতিবেদন দিতে বলেছে। এ জন্য কথা বলতে আমি হোসেন আলীকে ডেকেছি। কিন্তু তিনি আসেননি। এ ব্যাপারে তিনি আদালতে কোনো মামলা করেছেন কি না তা আমার জানা নেই।’


ইসলামী ব্যাংকের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও রাজশাহী শাখার ব্যবস্থাপক মো. খালেকুজ্জামান দাবি করেন, ‘চেকের স্বাক্ষর যাচাই—বাছাই করেই টাকা দেওয়া হয়েছে। তবে যেহেতু একাউন্ট হোল্ডার অভিযোগ করেছেন, তাই ব্যাপারটি কমিটি করে তদন্ত করা হচ্ছে।’


যোগাযোগ করা হলে হোসেন আলী বলেন, ‘আমি এলাকায় থাকতে পারছি না। টাকা তুলে নেওয়ার ব্যাপারে যেন কোনো পদক্ষেপ নিতে না পারি তার জন্য কিছু লোককে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারা দফায় দফায় আমার বাড়িতে গিয়ে আমাকে খোঁজাখুঁজি করছে। নানা রকম হুমকি দিচ্ছে। পরে আরও দুটি মামলায় আমাকে আসামি করা হয়েছে। ভয়ে আমার সন্তান স্কুলে যেতে পারছে না। এ ব্যাপারে রাজপাড়া থানায় আমার বাবা একটি জিডিও করেছেন।’


হোসেন আলী দাবি করেন, তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু শিশির ও দুই কর্মচারী তাকে পরিকল্পিতভাবে ফাঁসিয়েছে। তারপর গাড়িতে থাকা চেক নিয়ে তারা দুই পুলিশ কর্মকর্তা এবং ব্যাংকের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে হিসাব থেকে ৩৭ লাখ ১৫ হাজার টাকা তুলে নিয়েছে। ঐ টাকা তারা ভাগ—বাটোয়ারা করে নিয়েছে। এখন তিনি নিঃস্ব। হোসেনের দাবি, তিনি কোনোদিন কোনো রাজনীতি করেননি। তারপরও তার নামে একের পর এক রাজনৈতিক মামলা হচ্ছে।


অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে আসামি মাহমুদ হাসান লিমনের মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তবে মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়। তন্ময় হোসেন ফোন না ধরে কেটে দেন।


মাহমুদ হাসান শিশির বলেন, ‘হোসেন আমার অধীনে ৭ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করত। সে এত টাকা পায় কীভাবে? আমি তার ব্যাংক থেকে কোনো টাকা তুলিনি। তারপরও সে যদি মামলা করে, তাহলে আমার আর কি বলার আছে? আমি ভাষা হারিয়ে ফেলেছি।’


আসামির ব্যাংক থেকে টাকা তোলায় যোগসাজশের অভিযোগ অস্বীকার করেন পুলিশ পরিদর্শক আমিরুল ইসলাম ও এসআই আব্দুল আওয়াল। পরিদর্শক আমিরুল বলেন, ‘জব্দ তালিকা করেছিল অন্য একটি বাহিনী। তারা কি পেয়েছে না পেয়েছে তা জানি না। পুলিশকে কেন আসামি করল তাও জানি না।’


এসআই আব্দুল আওয়াল বলেন, ‘হোসেনের বিরুদ্ধে যে মামলা হয় সেই মামলা তিনি তদন্ত করেছেন। তিনি চেকের বিষয়ে কিছুই জানেন না। কে টাকা তুলেছে সেটাও বলতে পারবেন না।’


শেয়ার করুন