১৪ মার্চ ২০২৫, শুক্রবার, ০১:৩০:৫৮ পূর্বাহ্ন
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে সরালেই কী পরিস্থিতি পরিবর্তন হবে, কী বলছেন রাজনীতিবিদরা
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৩-০৩-২০২৫
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে সরালেই কী পরিস্থিতি পরিবর্তন হবে, কী বলছেন রাজনীতিবিদরা

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থির অবনতি ঘটে। চাঁদাবাজি, ছিনতাই, ডাকাতি, হত্যা, ধর্ষণ, মব জাস্টিসসহ বিভিন্ন অপরাধের মাত্রা ক্রমশ বেড়েছে। যদিও এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের অনেককেই আটক করতে সক্ষম হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তারপরেও দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি প্রত্যাশা অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণ নিতে সরকার অনেকটাই ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে করছে সাধারণ মানুষ। এমনকি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিও উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে।


অভিযোগ রয়েছে, এসব অরাজকতার সঙ্গে জড়িতদের বেশিরভাগই পতিত ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ-সংগঠনের নেতাকর্মী। তবে অনেক জায়গায় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধেও এমন অভিযোগ উঠেছে। যদিও এমন অভিযোগ উঠায় বেশ কিছু নেতাকে দল থেকে বহিষ্কারও করেছে দলটি। অপরদিকে, কমবেশি জামায়াতের বিরুদ্ধেও ফ্যাসিস্টদের দোসরদের শেল্টার দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। 


এমন পরিস্থিতির মাঝেই কয়েকদিন ধরে দেশে ধর্ষণসহ বিভিন্ন অপরাধের সংখ্যা ফের বেড়ে গেছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে সরিয়ে দেওয়ার দাবিটি নতুন করে আবারও সামনে এসেছে। রাজনীতিকদের অনেকে মনে করছেন, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার কারণে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অন্তর্বর্তী সরকারের জন্যই এক ধরনের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। এসবের দায় নিয়ে তাকে পদত্যাগ করা উচিৎ। তবে এই দাবি মানতে নারাজ অন্তর্বর্তী সরকারসহ বেশ কিছু রাজনীতিক দলও। 


তারা বলছেন, অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে বড় কোনো ষড়যন্ত্র থাকতে পারে। সরকারকে এসব ব্যাপারে আরও কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। শুধু স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে সরিয়ে কোনো সমাধান আসবে না।


যদিও এর আগে ছাত্র-শিক্ষকসহ নানা পেশার মানুষের বিভিন্ন সংগঠনের পাশাপাশি জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে অংশ নেওয়াদেরও অনেকে তার পদত্যাগের দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছিলেন।


দেশে সেনা-পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনীর যৌথ অভিযানের এক মাস পার হলেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন সেভাবে হয়নি; বরং সাধারণ নাগরিকের মধ্যে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ বেড়েছে।


ফলে সরকারও পরিস্থিতিটাকে একেবারে নাকচ করে দিতে পারছে না। তাদের দিক থেকে বার বার কঠোর হওয়ার কথা বলা হচ্ছে। সরকারের এমন সব কথায়ও মানুষ আস্থায় নিতে পারছে না বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন।


তারা বলছেন, মব বা দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলা ঠেকানোসহ বিভিন্ন অপরাধের ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের সাত মাসে তাদের দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। সেকারণে সামাজিক নৈরাজ্যের বিস্তৃতি ঘটেছে।


রাজনীতিকদেরও অনেকে মনে করেন, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা পরিস্থিতির দায় এড়াতে পারেন না।


অন্যতম প্রধান দল বিএনপির নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, সরকার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে যদি ঢেলে সাজাতে চায়, তা বিবেচনা করা যেতে পারে।


তবে জামায়াতে ইসলামীসহ ইসলামপন্থী বিভিন্ন দল ভিন্ন অবস্থান নিচ্ছে। তারা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে সরানোর পক্ষে নয়।


দলগুলোর মতপার্থক্য কোথায়


এখনো পর্যন্ত সবকটি সক্রিয় রাজনৈতিক দল অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রেখেছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির ব্যাপারে কোনো দলেরই দ্বিমত নেই। তবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে সরানোর বিভিন্ন পক্ষের দাবির ব্যাপারে দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য আছে।


কোনো কোনো দল স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে সরিয়ে দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছে। আবার কোনো কোনো দল বলছে, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ কোনো সমাধান নয়।


বিএনপি নেতারা মনে করেন, পরিস্থিতি সামলাতে অপরাধীদের বিরুদ্ধে সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ দৃশ্যমান করতে হবে। একইসঙ্গে প্রয়োজনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পরিবর্তন আনতে চাইলে, সেটাও বিবেচনা করা যেতে পারে।


দলটির মিত্রদের কেউ কেউ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবির পক্ষে সরাসরি অবস্থান তুলে ধরছে।


গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেছেন, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর পদত্যাগের দাবির যৌক্তিকতা আছে। কারণ তিনি মনে করেন, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী পরিস্থিতির দায় এড়াতে পারেন না।


এ ধরনের অবস্থানের ক্ষেত্রে বাস্তবতাকে বিবেচনায় নেওয়ার কথা উল্লেখ করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, ব্যর্থতার কারণে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অন্তর্বর্তী সরকারের জন্যই বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছেন।


এখন রোজার মধ্যে দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখাসহ কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকার সফল হলেও তা নিচে চাপা পড়ে যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কারণে। এই ইস্যুতেই অন্য সব কিছু ছাপিয়ে সরকারের সমালোচনা বাড়ছে।


দলগুলো মনে করছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সরকারের প্রতি আস্থার যে সংকট তৈরি হয়েছে, সেখানে কঠোর নানা পদক্ষেপের কথা বলা হলেও মানুষ তাতে আস্থা পাচ্ছে না। ফলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পরিবর্তন করা হলে কিছুটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।


তবে এর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্র নেতাদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি এবং জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামপন্থি কয়েকটি দল।


জাতীয় নাগরিক পার্টির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেন, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে সরালে সমাধান হবে না। সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হইতেছে; আরও কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।


ইসলামপন্থী দলগুলোও একইরকম বক্তব্য দিচ্ছে। জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে কোনো ষড়যন্ত্র থাকতে পারে। সেখানে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে সরিয়ে কোনো সমাধান আসবে না।


জামায়াতের পাশাপাশি বিএনপিসহ অন্য দলগুলোও পরিস্থিতির পেছনের ষড়যন্ত্র তত্ত্বের ব্যাপারে একমত বলে মনে হয়েছে।


সরকারের দিক থেকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এবং এমনকি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসও তাদের গত কয়েকদিনের বক্তব্যে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনেছেন।


রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, কোনো কোনো রাজনৈতিক দল যখন নিজেরাই বলছে যে, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা দায় এড়াতে পারেন না, সেখানে দায় এড়ানো চেষ্টা হলে সেটা ভিন্ন বার্তা দিতে পারে। অপরাধীরা আরও সুযোগ নিতে পারে।


স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগে আপত্তি কোথায়


আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যেহেতু সংস্কার-নির্বাচনসহ অন্যান্য বিষয়ে বিতর্ক বা আলোচনাকে পেছনে ফেলে এখন বড় ইস্যু হয়ে উঠেছে। এমন প্রেক্ষাপটে ব্যর্থতার দায় নিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে সরানো হলে বা তিনি পদত্যাগ করলে সরকারের দুর্বলতা প্রকাশ পাবে। সরকারের আপত্তির ক্ষেত্রে এটিই অন্যতম বড় কারণ। সরকারের ভেতরে একাধিক সূত্রে এমন ধারণা পাওয়া গেছে।


তবে অন্তর্বর্তী সরকারের সাত মাসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দুজন উপদেষ্টা দায়িত্ব পালন করেন। তাদের দুজনই সাবেক সেনা কর্মকর্তা। বর্তমানে দায়িত্বে থাকা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী অবসরপ্রাপ্ত লেফটেনেন্ট জেনারেল। তার আগে ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগ্রেডিয়ার জেনারেল সাখাওয়াত হোসেন।


অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম দিকেই সাখাওয়াত হোসেনকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তবে তাকে সরানোর প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন।


তিনি ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগকে নিয়ে রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়েছিলেন। তখন অভিযোগ উঠেছিল যে, তার সেই বক্তব্য গণ-অভ্যুত্থানের চেতনার বিপক্ষে যায়।


এই অভিযোগে সরকারে থাকে ছাত্র প্রতিনিধি ও আন্দোলনের ছাত্র নেতৃত্বের চাপের কারণে তখন সাখাওয়াত হোসেনকে সরিয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়।


শেয়ার করুন