২১ নভেম্বর ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ০৬:১৮:১৭ অপরাহ্ন
নিত্যপণ্য ঘিরে ভয়াবহ মূল্য কারসাজি
  • আপডেট করা হয়েছে : ৩১-০৮-২০২২
নিত্যপণ্য ঘিরে ভয়াবহ মূল্য কারসাজি

গত এক মাসে স্থানীয় বাজারে ৮টি অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ঘিরে বড় ধরনের মূল্য কারসাজি হয়েছে। এগুলো হচ্ছে-চাল, মসুর ডাল, পেঁয়াজ, চিনি, আটা, ময়দা, সিমেন্ট ও রড। এসব পণ্য বিশ্ববাজারে যে হারে বেড়েছে, এর চেয়েও বেশি স্থানীয় বাজারে বাড়ানো হয়।

পাশাপাশি একাধিক পণ্যের মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে কমলেও বিপরীতে অভ্যন্তরীণ বাজারে প্রভাব পড়েনি। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে মূল্য বাড়ানো হয়েছে। এমন কারসাজির ঘটনা উঠে এসেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব অনুসন্ধানে।

অনুসন্ধানকালে তিনটি বিষয়কে সামনে রেখে আট পণ্যের মূল্য পর্যালোচনা করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে-দেশের অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন কতটুকু হয়েছে, জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব এবং বিশ্ববাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধির তথ্য সমন্বয়। এসব তথ্য পর্যালোচনা করেছে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিসি)। সেখানে দেখা গেছে, এই তিন সূচকের প্রভাবে বাজারে নিত্যপণ্যের মূল্য যেটুকু বৃদ্ধির কথা, কিন্তু তার চেয়ে বেশি বাড়ানো হয়েছে। আর এভাবে মূল্য বাড়িয়ে ভোক্তার পকেট থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়েছে অসাধু ব্যবসায়ীরা।

দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি নিয়ে মঙ্গলবার বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, মূল্য বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা সুযোগ নিয়েছে। কয়েকটি পণ্যের মূল্য বেড়েছে তা গ্রহণযোগ্য নয়। কিছু পণ্যে দাম বেশি নেওয়া হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, অসাধু ব্যবসায়ীদের আর জরিমানা নয়, এখন থেকে সরাসরি মামলা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরকে। কারণ কিছু ব্যবসায়ী মূল্য বাড়িয়ে বাজারকে অস্থিতিশীল করেছে। তিনি আরও বলেন, ডলার কারসাজির সঙ্গে ৬টি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধান জড়িত থাকায় তাদের বরখাস্ত করা হয়েছে। তাদের কারসাজির কারণেও বাজারে ডলারের সংকট সৃষ্টি হয়ে দাম বেড়েছে। এর প্রভাব পণ্যের বাজারে এসে পেড়েছে।

জানতে চাইলে কনজুমারর্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান যুগান্তরকে বলেন, দেশে অনেক ভুঁইফোঁড় সমিতি ও অ্যাসোসিয়েশন হয়েছে। অনেক পণ্যের মূল্য এসব সংগঠন নির্ধারণ করে।

তাদের কর্মকাণ্ডের কারণেও পণ্যের মূল্য বাড়ছে। এছাড়া একশ্রেণির ব্যবসায়ী অতিমুনাফার প্রবণতা সৃষ্টি করেছে। অপরদিকে অনেক ধরনের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছেন গুটিকয়েক ব্যবসায়ী। অসাধু ব্যবসায়ী এবং সিন্ডিকেটের প্রভাবে আজ বাজারে পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে না।

সূত্র মতে, গত এক মাসে বিশ্ববাজারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশের স্থানীয় বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য কতটুকু বেড়েছে এ নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সেখানে দেখা গেছে, এক মাসে (২৮-৭-২০২২ থেকে ২৮-০৮-২০২২) বিশ্ববাজারে মসুর ডালের মূল্য বেড়েছে দশমিক ৭৮ শতাংশ। বিপরীতে দেশের বাজারে ডালের দাম বেড়েছে বড় দানা-২ দশমিক ৩৮ শতাংশ ও ছোট দানা ১ দশমিক ৮৯ শতাংশ। দেশে মোট মসুর ডালের প্রায় ৫ লাখ মেট্রিক টন চাহিদার বিপরীতে আমদানি করা হচ্ছে ৩ লাখ ৭০ হাজার মেট্রিক টন। বাকিটা উৎপাদন হচ্ছে দেশেই। এই আমদানিকে ঘিরেই সর্বক্ষেত্রে মূল্য কারসাজি করা হয়।

এদিকে চাহিদা মেটাতে প্রতিবছর বিদেশ থেকে মাত্র ৭ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ আমদানি করা হয়। দেশে উৎপাদন হয় ২৭ লাখ ৩০ হাজার টন। এই পেঁয়াজের মূল্য ঘিরেও কারসাজি হয়েছে এ বছর। পেঁয়াজের মূল্য একই সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়েছে ৯ দশমিক ০৯ শতাংশ। কিন্তু দেশের বাজারে বেড়েছে আমদানিকৃত পেঁয়াজের মূল্য ১৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ এবং দেশীয় পেঁয়াজ ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দেখতে পায় গত এক মাসে বিশ্ববাজারে চিনির মূল্য ৩ দশমিক ৩৪ শতাংশ কমেছে। অথচ দেশের বাজারে এর প্রভাব নেই। চিনির দাম না কমে উলটো বেড়েছে ৯ দশমিক ৮৮ শতাংশ। চাহিদা মেটাতে প্রতিবছর ২০ থেকে ২২ লাখ মেট্রিক টন অপরিশোধিত চিনি বিদেশ থেকে আমদানি করা হচ্ছে। বিপুল অঙ্কের এই আমদানি ঘিরেই বড় ধরনের মূল্য কারসাজি হয়েছে। তবে আখ থেকে স্থানীয়ভাবে চিনি উৎপাদন হয় মাত্র ৩০ হাজার টন।

আরও দেখা গেছে, সরু, মাঝারি ও মোট এই তিন ধরনের চালের ক্ষেত্রে গত এক মাসে স্থানীয় বাজারে গড় মূল্য বৃদ্ধি পায় ১০ দশমিক ৩৩ শতাংশ। অথচ একই সময়ে বিশ্ববাজারে বেড়েছে ৫ দশমিক ৬৮ শতাংশ। প্রতিবছরই প্রায় ১০ থেকে ১১ লাখ মেট্রিক টন চাল আমদানি করা হয়। উৎপাদন হয় ৩৭ কোটি ৬০ লাখ মেট্রিক টন। এই আমদানি নিয়ে মূল্য কারসাজির কারণে পুরো চালের বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে।

সবচেয়ে বেশি মূল্য কারসাজি হয়েছে আটা ও ময়দার বাজার ঘিরে। দেশে গমের চাহিদা ৬৫ লাখ মেট্রিক টনের মধ্যে আমদানি করা হচ্ছে ৫৯ লাখ টন। কিন্তু ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে গমের আন্তর্জাতিক বাজারের মূল্য অনেক বেশি বৃদ্ধি পায়। তবে সম্প্রতি সেটি পর্যায়ক্রমে কম আসে। পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এক মাসের ব্যবধানে বিশ্ববাজারে গমের মূল্য বেড়েছে ২ দশমিক ৫৭ শতাংশ। বিপরীতে দেশের বাজারে খোলা আটার মূল্য ২৮ শতাংশ এবং ময়দা (প্যাকেট) ১৭ শতাংশ বাড়ানো হয়।

উন্নয়ন উপকরণ নির্মাণসামগ্রী রড ও সিমেন্টের বাজারও পর্যালোচনা করা হয়। দেশের বাজারে রডের মূল্য বেড়েছে ৩ শতাংশ। কিন্তু বিশ্ববাজারে বেড়েছে এক মাসে মাত্র দশমিক ৭৮ শতাংশ। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে ২ দশমিক ২৯ শতাংশ মূল্য বৃদ্ধি পায় সিমেন্টের ক্ষেত্রে। অথচ দেশের বাজারে বেড়েছে ১৩ শতাংশ।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পণ্যমূল্য কারসাজির অনুসন্ধান প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত এক কর্মকর্তা জানান, এখন থেকে প্রতি এক মাস অন্তর ৯টি পণ্যে প্রকৃত মূল্য বের করা হবে। বিশেষ করে বিশ্ববাজারে কতটা দাম আছে, দেশের বাজারে প্রকৃতপক্ষে কত টাকা মূল্য হওয়া উচিত সেটি নির্ধারণ করা হবে। আর তা করবে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন। প্রতি এক মাস অন্তর পর্যালোচনা করে এসব পণ্যের মূল্য বের করার পর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে সেটি ঘোষণা দেওয়া হবে।

শেয়ার করুন