রাইসা ইসলাম একজন এনজিও কর্মী। প্রতিদিন সিএনজিতে করে অফিসে যান। অথচ কখনোই সিএনজি চালকদের মিটারে যেতে দেখেননি।
রাইসা বলেন, আমাদের দেশের সিএনজিতে মিটার কেন আছে তা আমি জানি না। আপনি ১০০টি সিএনজিতে উঠলে পাঁচটা সিএনজি মিটারে যাবে কি-না সন্দেহ।
মিটারে না গেলে এ ডিভাইসটির আদৌ কোনো প্রয়োজনীয়তা আছে কি-না এমন প্রশ্ন অনেকেরই। নতুন সড়ক আইন-২০১৮ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, একজন সিএনজি অটোচালক মিটারে যাবেন নাকি যাবেন না, তা নিয়ে নেই কোনো সুনির্দিষ্ট আইন।
এ বিষয়ে ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. মুনিবুর রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নতুন সড়ক পরিবহন আইনে সিএনজিচালিত অটোরিকশার মিটার নিয়ে কোনো কিছু উল্লেখ নেই। সিএনজি চালক মিটারে যাবেন না-কি যাবেন না, তা নিয়েও সুনির্দিষ্ট কোনো আইন নেই। যে কারণে তাদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না এবং চাইলেও আমরা মামলা দিতে পারি না। মিটারের বিষয়টি নিয়ে যদি সঠিক আইন প্রণয়ন করা যেত তাহলে আমরা যাত্রীদের আরও ভালো সেবা নিশ্চিত করতে পারতাম।
তাহলে সিএনজি চালকরা যাত্রীদের ‘পুলিশ ধরলে বইলেন মিটারে যাচ্ছি’ কথাটা কেন বলেন- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, দেখেন, আমরা আইন প্রয়োগকারী। তাই আমাদের আইন সম্পর্কে জানতে হয়। কিন্তু সিএনজি চালকদের আইন সম্পর্কে জানা নেই বিধায় তারা ভয়ে এ কথা বলে থাকতে পারেন। যখন আর ১০টা সিএনজিতে মিটার থাকে তখন সে মনে করে তার মিটার না থাকলে কিংবা মিটার থাকার পরও না গেলে যদি পুলিশ জরিমানা করে, সেই ভয়ে সে এ কথা বলতে পারেন। তবে যদি কেউ মিটারে না যান তাহলে আমাদের মামলা দেয়ার বিধান নেই। এ বিষয়ে আইন সংশোধন না হলে তেমন কিছু করার থাকবে না। তারপরও আমরা মাঝে মাঝে চালকদের ভয় দেখাতে মিটারের জন্য ধরি।
মিটার অনুযায়ী ভাড়া আদায়ের আইন থাকলেও আইনের কোনো প্রয়োগ নেই এ বিষয়ে যখন কথা হচ্ছে তখন জানা গেল, নতুন সড়ক আইনে সিএনজিচালিত অটোতে মিটার নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো আইন-ই নেই।
এদিকে ২০১৫ সালে সিএনজি অটোরিকশার সরকার নির্ধারিত প্রথম ২ কিলোমিটারের ভাড়া ৪০ টাকা, পরে প্রতি কিলোমিটার ১২ টাকা এবং বিরতিকালীন চার্জ প্রতি মিনিটে ২ টাকা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু কোনো সিএনজি চালক এ ভাড়ায় সিএনজি চালান না। তারা চুক্তিতেই যাত্রী পরিবহন করেন। ফলে রাজধানীতে সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলাচলে ভাড়া নিয়ে চলছে চরম নৈরাজ্য। নির্ধারিত ভাড়ার কয়েকগুণ বেশি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে যাত্রীদের কাছ থেকে। যাত্রীরাও বাধ্য হয়েই উঠছেন সিএনজিতে।
মাঠপর্যায়ে ট্রাফিক পুলিশের বক্তব্য
অতিরিক্ত ভাড়া প্রসঙ্গে মাঠপর্যায়ে ট্রাফিক সার্জেন্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কোনো যাত্রী যদি বাড়তি ভাড়ার অভিযোগ করেন, তা হলে চালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়। কিন্তু অভিযোগ করেন না অনেকেই। এ বিষয়ে পুলিশ বলছে, আইন থাকলেও তা সুস্পষ্ট নয়। তাই তারাও নিতে পারছেন না কঠোর কোনো ব্যবস্থা।
এ বিষয়ে রাজধানীর হোটেলে সোনারগাঁও মোড়ে দায়িত্বরত তেজগাঁও জোনের ট্রাফিক সার্জেন্ট মো. রাজীব বলেন, এইতো শনিবার (৩০ অক্টোবর) সদরঘাট থেকে আসা একটি সিএনজি চালককে থামিয়ে যাত্রীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম মিটারে যাচ্ছে কিনা? যাত্রী বললেন, তিনি মিটারেই যাচ্ছেন। তাহলে বলেন, আমরা কী করব? যদি যাত্রী বলতেন তিনি চুক্তিতে যাচ্ছেন তাহলে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারতাম। কিন্তু যাত্রীরাই তো আমাদের সহযোগিতা করছে না।
তাছাড়া ২০১৮ সালের সড়ক আন্দোলনের সময় তড়িঘড়ি করে হওয়া ট্রাফিক আইনেও রয়েছে বেশ কিছু ফাঁকফোকর। যার কারণে আমরা চাইলেও অনেক কিছু করতে পারি না। বিধি অনুযায়ী যে আইন আছে তাতে কিন্তু মিটারে না গেলে চালককে মামলা দেয়ারও উপায় নেই, তবে চাইলে আমি গাড়ি আটকে রাখতে পারি। যাকে আমরা ডাম্পিং বলি।
বিআরটিএ যা বলছে
বিআরটিএ পরিচালক (রোড সেফটি) শেখ মোহাম্মদ মাহবুব ই রব্বানী জানান, সবুজ যে গাড়িগুলো আছে এক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত আমাদের ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হচ্ছে। যাত্রী যারা আছেন তাদেরও সহযোগিতা প্রয়োজন। আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করতে হবে। ভ্রাম্যমাণ আদালতের আওতায় যখন আসে কোনো অটোরিকশা, তখন যেন যাত্রীরাও স্বীকার করেন যে, তারা মিটারে যাচ্ছেন না, চুক্তিতে যাচ্ছেন। তাহলে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি। তবে আইনের সংশোধনটাও দরকার।
চালকদের অভিযোগ
মিরপুর আনসার ক্যাম্পে যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করছিলেন জামাল নামের এক সিএনজি চালক। মিটারে কেন যান না-জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, মিটারে গেলে পোষায় না। তাই যাই না। ভাড়া অনেক কম আসে। প্রতিদিন জমা দিতে হয় ১২০০ টাকা। গ্যাস ৬০০ টাকা। গাড়ির পেছনে আরও খরচ হয়। মিটারে গেলে এই টাকা উঠানোই কষ্টকর হয়ে যায়।
সিদ্দিক নামের আরেক সিএনজি চালক বলেন, জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। মিটারে গেলে যে ভাড়া পাই তাতে সংসার চালানোই কঠিন হয়ে পড়ে।
এদিকে মিটারে যাচ্ছেন না জানালে পুলিশ গাড়ি আটকে রাখবে। এতে গন্তব্যে যেতে দেরি হবে কিংবা চালক যেতে চাইবে না বিধায় যাত্রীরাও পুলিশকে সহযোগিতা করেন না বলে জানিয়েছেন সিএনজিতে চলাচলরত অনেক যাত্রী।
যাত্রীদের কথা
মিটারে না গিয়ে চুক্তিতে যাওয়ার তথ্য দিয়ে যাত্রীরা কেন পুলিশকে সহযোগিতা করছে না-এ বিষয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা এনামুল করিমকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, কী করব বলেন? মিটারে না গিয়ে যদি বলি চুক্তিতে যাচ্ছি তাহলে তো আমার গন্তব্যেই যাওয়া হবে না। গাড়ি আটক করে রাখা হবে। তখন আমি গন্তব্যে যাব কীভাবে? তাই পুলিশকে বলি মিটারে যাচ্ছি।
একাধিক সিএনজি অটোরিকশার যাত্রীর সঙ্গে আলাপে জানা যায়, যে গন্তব্যে মিটারে ভাড়া আসে ১০০ থেকে ১২০ টাকা, সেখানে পৌঁছাতে চুক্তিতে ভাড়া নেয়া হচ্ছে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। তারপরও তারা বাধ্য হয়ে সিএনজিতে যাতায়াত করেন। যদি সরকার যথাযথ আইন করে এর বাস্তবায়ন করতো তাহলে যাত্রীরা স্বস্তি পেত বলে মনে করেন অনেকে।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, রাজধানীতে চলাচলরত অটোরিকশার ৯৮ শতাংশই চুক্তিতে চলে। যে ২ শতাংশ মিটারে চলাচল করে তারা ২০ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত মিটারের অতিরিক্ত ভাড়া বা বকশিশ দাবি করে। তবে বৃষ্টি বা সরকারি ছুটির আগের দিন অথবা গণপরিবহন সংকটকালীন এই বকশিশের পরিমাণ ১০০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে যায়। যাত্রীদের পছন্দমতো গন্তব্যে যেতে রাজি হয় না ৮৮ শতাংশ অটোরিকশা।
কী বলছে যাত্রী কল্যাণ সমিতি?
এ বিষয়ে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, আসলে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। তারা যেমন দুর্বৃত্ত হয়ে পড়েছে, আমরা তেমন ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। আমরা সরকারের সঙ্গে নানা পদক্ষেপ নিয়েও এটাকে নিয়মের মধ্যে এখনও আনতে পারিনি। এর অন্যতম কারণ অবৈধ অটোরিকশার সংখ্যা প্রায় বৈধ অটোরিকশার সমান। এ ছাড়া সরকারের যথাযথ পর্যবেক্ষণেরও অভাব রয়েছে।
সিএনজিতে মিটারের প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা-জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, মূলত যাত্রীদের সুবিধার্থে ও চালকদের শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্যই মিটারটা চালু করা হয়েছিল। এই মিটারচালিত যানে যাত্রীরা বিনা প্রশ্নে যাতায়াত করতে পারবেন। মানে যাত্রী যেখানে যেতে চায় চালক সেখানে যেতে বাধ্য থাকবেন। যাবেন না, এ কথা বলা যাবে না। যদি চালক যেতে অস্বীকৃতি জানান তাহলে পরিবহন আইনে সেটা মামলা হয়ে যাবে। এবং ভাড়ার ক্ষেত্রেও আপনি কোনো দরদাম করতে পারবেন না। সরকার নির্ধারিত মিটারে যে ভাড়া আসবে তাতেই আপনাকে যেতে হবে।
মোজাম্মেল হক বলেন, সরকারের এই বিধান পুরোপুরি যাত্রীবান্ধব ছিল কিন্তু এর প্রয়োগের অভাবে তার বাস্তবায়ন হচ্ছে না। কোনো সিএনজি যদি মিটারে না চলে, মিটার না থাকে কিংবা মিটার টেম্পারিং করে তাহলে ৫০ হাজার টাকা জরিমানারও বিধান রয়েছে। আমি মনে করি, সরকার যদি এই ৫০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান মিনিমাম ১০টি সিএনজির ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেন এবং এই জরিমানার তথ্য গণমাধ্যমগুলো যদি বড় আকারে ফলোআপ করে তাহলেই অনেকাংশে এর সমাধান সম্ভব।